বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬

আন নাস

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ
১) বলো , আমি আশ্রয় চাচ্ছি মানুষের রব ,
مَلِكِ النَّاسِ
২) মানুষের বাদশাহ ,
إِلَٰهِ النَّاسِ
৩) মানুষের প্রকৃত মাবুদের কাছে,
مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ
৪) এমন প্ররোচনা দানকারীর অনিষ্ট থেকে
الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ
৫) যে বারবার ফিরে আসে ,যে মানুষের মনে প্ররোচনা দান করে ,
مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ
৬) সে জিনের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের মধ্য থেকে৷
____________________________________________________

১ . এখানেও সূরা আল ফালাকের মতো ' আউযু বিল্লাহ ' বলে সরাসরি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার পরিবর্তে আল্লাহর তিনটি গুণের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করে তাঁর আশ্রয় নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে , এ তিনটি গুনের মধ্যে একটি হচ্ছে , তাঁর রাব্বুন নাস অর্থাৎ সমগ্র মানব জাতির প্রতিপালক , মালিক ও প্রভু হওয়া৷ দ্বিতীয়টি হচ্ছে , তাঁর মালিকুন নাস অর্থাৎ সমস্ত মানুষের বাদশাহ , শাসক ও পরিচালক হওয়া ৷ তৃতীয়টি হচ্ছে , তাঁর ইলাহুন নাস অর্থাৎ সমগ্র মানব জাতির প্রকৃত মাবুদ হওয়া ( এখানে একথা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে , ইলাহ শব্দটি কুরআন মজীদে দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷ এক , এমন বস্তু বা ব্যক্তি যার ইবাদাত গ্রহণ করার কোন অধিকারই নেই কিন্তু কার্যত তার ইবাদাত করা হচ্ছে৷ দুই , যার ইবাদাত গ্রহণ করার অধিকার আছে এবং যিনি প্রকৃত মাবুদ , লোকেরা তার ইবাদাত করুক বা না করুক৷ ( আল্লাহর জন্য যেখানে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এ দ্বিতীয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে৷ )
এ তিনটি গুনের কাছে আশ্রয় চাওয়ার মানে হচ্ছে : আমি এমন এক আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি, যিনি সমস্ত মানুষের রব বাদাশাহ ও মাবুদ হবার কারণে তাদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব রাখেন , যিনি নিজের বান্দাদের হেফাজন করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন এবং যথার্থই এমন অনিষ্টের হাত থেকে মানুষের রক্ষা করতে পারেন , যার হাত থেকে নিজে বাঁচার এবং অন্যদের বাঁচাবার জন্য আমি তাঁর শরণাপন্ন হচ্ছি৷ শুধু এতটুকু নয় বরং যেহেতু তিনিই রব , বাদশাহ ও ইলাহ ,তিনি ছাড়া আর কেউ নেই যার কাছে আমি পানাহ চাইতে পারি এবং প্রকৃতপক্ষে যিনি পানাহ দেবার ক্ষমতা রাখেন৷

২ . মূলে ( আরবী ------) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ( আরবী ------) এর মানে হচ্ছে , বারবার প্ররোচনা দানকারী ৷ আর " ওয়াসওয়াসাহ " মানে হচ্ছে , একের পর এক এমন পদ্ধতিতে মানুষের মনে কোন খারাপ কথা বসিয়ে দেয়া যে , যার মনে ঐ কথা বসিয়ে দেয়া হচ্ছে , ওয়াসওয়াসাহ সৃষ্টিকারী যে তার মনে ঐ কথা বসিয়ে দিচ্ছে তা সে অনুভবই করতে পারে না৷ ওয়াসওয়াসাহ শব্দের মধ্যেই বারবার হবার অর্থ রয়েছে , যেমন ' যালযালাহ ' ( ভূমিকম্প ) শব্দটির মধ্যে রয়েছে , বারবার ভূকম্পনের ভাব৷ যেহেতু মানুষকে শুধুমাত্র একবার প্রতারণা করলেই সে প্রতারিত হয় না বরং তাকে প্রতারিত করার জন্য একের পর এক প্রচেষ্টা চালাতে হয় , তাই এ ধরনের প্রচেষ্টাকে ' ওয়াসওয়াসাহ ' ( প্ররোচনা ) এবং প্রচেষ্টাকারীকে ' ওয়াসওয়াস' ( প্ররোচক) বলা হয়৷ এখানে আর একটি শব্দ এসেছে খান্নাস৷ ( আরবী ------) এর মূল হচ্ছে খুনূস৷ ( আরবী---------) এর মানে প্রকাশিত হবার পর আবার গোপন হওয়া অথবা সামনে আসার পর আবার পিছিয়ে যাওয়া ৷ আর ' খান্নাস ' যেহেতু বেশী ও অত্যাধিক বৃদ্ধির অর্থবোধক শব্দ , তাই এর অর্থ হয় , এ কাজটি বেশী বেশী বা অত্যাধিক সম্পন্নকারী৷ একথা সুস্পষ্ট , প্ররোচনাদানকারীকে প্ররোচনা দেবার জন্য বারবার মানুষের কাছে আসতে হয়৷ আবার এই সঙ্গে যখন তাকে খান্নাসও বলা হয়েছে তখন এ দু'টি শব্দ পরস্পর মিলিত হয়ে আপনা আপনি এ অর্থ সৃষ্টি করেছে যে , প্ররোচনা দান করতে সে পিছনে সরে যায় এবং তারপর প্ররোচনা দেবার জন্য আবার বারবার ফিরে আসে ৷ অন্য কথায় একবার তার প্ররোচনা দান করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর সে ফিরে যায়৷ তারপর সেই প্রচেষ্টা চালাবার জন্য বারবার সে ফিরে আসে৷

৩ . কোন কোন বিশেষজ্ঞদের মতে এ শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে , প্ররোচণা দানকারীরাও দুই ধরনের লোকদের মনে প্ররোচনা দান করে ৷ এক ,জিন ও দুই,মানুষ৷ এ বক্তব্যটি মেনে নিলে এখানে ---নাস জিন ও মানুষ উভয়কে বুঝাবে এবং তাঁরা বলেন , এমনটি হতে পারে ৷ কারণ , কুরআনে যখন ( আরবী---) ( পুরুষরা ) শব্দটি জিনদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে যেমন সূরা জিনের ৬ আয়াতে দেখা যায় এবং যখন ( আরবী ) ( দল ) শব্দটির ব্যবহার জিনদের দলের ব্যাপারে হতে পারে , যেমন সূরা আহকাফের ২৯ আয়াতে দেখা যায় তখন পরোক্ষভাবে ' নাস ' শব্দের মধ্যে মানুষে ও জিন উভয়ই শামিল হতে পারে৷ কিন্তু এ মতটি সঠিক নয়৷ কারণ ( আরবী ----------) শব্দগুলো আভিধানিক দিকে দিয়েই ( আরবী-----) (জিন ) শব্দের বিপরীতধর্মী৷ জিন - এর আসল মানে হচ্ছে গোপন সৃষ্টি৷ আর জিন মানুষের দৃষ্টি থেকে গোপন থাকে বলেই তাকে জিন বলা হয়৷ বিপরীত পক্ষে ' নাস ' ও 'ইনস ' শব্দগুলো মানুষ অর্থে এ জন্য বলা হয় যে তারা প্রকাশিত , তাদের চোখে দেখা যায় এবং ত্বক অনুভব করা যায়৷ সূরা কাসাসের ২৯ আয়াতে ( আরবী ------------------) বলা হয়েছে৷ এখানে ( আরবী --------) ( আ - নাসা ) মানে (আরবী ---) (রাআ) অর্থাৎ হযরত মূসা ( আ ) "তুর পাহাড়ের কিনারে আগুন দেখেন৷ " সূরা আন নিসার ৬ আয়াতে বলা হয়েছে : ( আরবী -------------) " যদি তোমরা অনুভব করো , এতিম শিশুদের এখন বুঝসুঝ হয়েছে৷
(আরবী ----------) (আ- নাসতুম) মানে ( আরবী ---------) ( আহসাসতুম ) বা ( আরবী -----) ( রাআইতুম)৷ কাজেই আরবী ভাষার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ' নাস' শব্দটির মানে জিন হতে পারে না৷
তাই এখানে আয়াতটি সঠিক মনে হচ্ছে , " এমন প্ররোচনা দানকারীর অনিষ্ট থেকে যে মানুষের মনে প্ররোচনা দান করে সে জিনদের মধ্য থেকে হোক বা মানুষদের মধ্য থেকে ৷" অর্থাৎ অন্য কথায় বলা যায় , প্ররোচনা দান করার কাজ জিন শয়তানরাও করে আবার মানুষ শয়তানরাও করে৷ কাজেই এ সূরায় উভয়ের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ কুরআন থেকে এ অর্থের সমর্থন পাওয়া যায় এবং হাদীস থেকেও ৷ কুরআনে বলা হয়েছে :
আরবী --------------------------------------------------------------------------------
" আর এভাবে আমি জিন শয়তান ও মানুষ শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবী শত্রু বানিয়ে দিয়েছি তারা পরস্পরের কাছে মনোমুগ্ধকর কথা ধোঁকা ও প্রতারণার ছলে বলতে থাকে৷ " ( আল আন আম , ১১২ )
আর হাদীসে ইমাম আহমাদ , নাসাঈ ও ইবনে হিব্বান হযরত আবু যার গিফারী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন৷ তিনি বলেন : আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হলাম৷ তখন তিনি মসজিদে বসেছিলেন৷ তিনি বললেন , আবু যার ! তুমি নামায পড়েছো ? আমি জবাব দিলাম , না৷ বললেন , ওঠো এবং নামায পড়ো ! কাজেই আমি নামায পড়লাম এবং তারপর আবার এসে বসলাম৷ তিনি বললেন :
আরবী --------------------------------------------------------------------------
" হে আবু যার ! মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর পানাহ চাও!" আমি জিজ্ঞেস করলাম , হে আল্লাহর রসূল ! মানুষের মধ্যেও কি আবার শয়তান হয় ? বললেন হাঁ৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন