বৃহস্পতিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬

আন নাস

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ
১) বলো , আমি আশ্রয় চাচ্ছি মানুষের রব ,
مَلِكِ النَّاسِ
২) মানুষের বাদশাহ ,
إِلَٰهِ النَّاسِ
৩) মানুষের প্রকৃত মাবুদের কাছে,
مِن شَرِّ الْوَسْوَاسِ الْخَنَّاسِ
৪) এমন প্ররোচনা দানকারীর অনিষ্ট থেকে
الَّذِي يُوَسْوِسُ فِي صُدُورِ النَّاسِ
৫) যে বারবার ফিরে আসে ,যে মানুষের মনে প্ররোচনা দান করে ,
مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ
৬) সে জিনের মধ্য থেকে হোক বা মানুষের মধ্য থেকে৷
____________________________________________________

১ . এখানেও সূরা আল ফালাকের মতো ' আউযু বিল্লাহ ' বলে সরাসরি আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করার পরিবর্তে আল্লাহর তিনটি গুণের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করে তাঁর আশ্রয় নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে , এ তিনটি গুনের মধ্যে একটি হচ্ছে , তাঁর রাব্বুন নাস অর্থাৎ সমগ্র মানব জাতির প্রতিপালক , মালিক ও প্রভু হওয়া৷ দ্বিতীয়টি হচ্ছে , তাঁর মালিকুন নাস অর্থাৎ সমস্ত মানুষের বাদশাহ , শাসক ও পরিচালক হওয়া ৷ তৃতীয়টি হচ্ছে , তাঁর ইলাহুন নাস অর্থাৎ সমগ্র মানব জাতির প্রকৃত মাবুদ হওয়া ( এখানে একথা সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে , ইলাহ শব্দটি কুরআন মজীদে দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷ এক , এমন বস্তু বা ব্যক্তি যার ইবাদাত গ্রহণ করার কোন অধিকারই নেই কিন্তু কার্যত তার ইবাদাত করা হচ্ছে৷ দুই , যার ইবাদাত গ্রহণ করার অধিকার আছে এবং যিনি প্রকৃত মাবুদ , লোকেরা তার ইবাদাত করুক বা না করুক৷ ( আল্লাহর জন্য যেখানে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এ দ্বিতীয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে৷ )
এ তিনটি গুনের কাছে আশ্রয় চাওয়ার মানে হচ্ছে : আমি এমন এক আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি, যিনি সমস্ত মানুষের রব বাদাশাহ ও মাবুদ হবার কারণে তাদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব রাখেন , যিনি নিজের বান্দাদের হেফাজন করার পূর্ণ ক্ষমতা রাখেন এবং যথার্থই এমন অনিষ্টের হাত থেকে মানুষের রক্ষা করতে পারেন , যার হাত থেকে নিজে বাঁচার এবং অন্যদের বাঁচাবার জন্য আমি তাঁর শরণাপন্ন হচ্ছি৷ শুধু এতটুকু নয় বরং যেহেতু তিনিই রব , বাদশাহ ও ইলাহ ,তিনি ছাড়া আর কেউ নেই যার কাছে আমি পানাহ চাইতে পারি এবং প্রকৃতপক্ষে যিনি পানাহ দেবার ক্ষমতা রাখেন৷

২ . মূলে ( আরবী ------) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে ( আরবী ------) এর মানে হচ্ছে , বারবার প্ররোচনা দানকারী ৷ আর " ওয়াসওয়াসাহ " মানে হচ্ছে , একের পর এক এমন পদ্ধতিতে মানুষের মনে কোন খারাপ কথা বসিয়ে দেয়া যে , যার মনে ঐ কথা বসিয়ে দেয়া হচ্ছে , ওয়াসওয়াসাহ সৃষ্টিকারী যে তার মনে ঐ কথা বসিয়ে দিচ্ছে তা সে অনুভবই করতে পারে না৷ ওয়াসওয়াসাহ শব্দের মধ্যেই বারবার হবার অর্থ রয়েছে , যেমন ' যালযালাহ ' ( ভূমিকম্প ) শব্দটির মধ্যে রয়েছে , বারবার ভূকম্পনের ভাব৷ যেহেতু মানুষকে শুধুমাত্র একবার প্রতারণা করলেই সে প্রতারিত হয় না বরং তাকে প্রতারিত করার জন্য একের পর এক প্রচেষ্টা চালাতে হয় , তাই এ ধরনের প্রচেষ্টাকে ' ওয়াসওয়াসাহ ' ( প্ররোচনা ) এবং প্রচেষ্টাকারীকে ' ওয়াসওয়াস' ( প্ররোচক) বলা হয়৷ এখানে আর একটি শব্দ এসেছে খান্নাস৷ ( আরবী ------) এর মূল হচ্ছে খুনূস৷ ( আরবী---------) এর মানে প্রকাশিত হবার পর আবার গোপন হওয়া অথবা সামনে আসার পর আবার পিছিয়ে যাওয়া ৷ আর ' খান্নাস ' যেহেতু বেশী ও অত্যাধিক বৃদ্ধির অর্থবোধক শব্দ , তাই এর অর্থ হয় , এ কাজটি বেশী বেশী বা অত্যাধিক সম্পন্নকারী৷ একথা সুস্পষ্ট , প্ররোচনাদানকারীকে প্ররোচনা দেবার জন্য বারবার মানুষের কাছে আসতে হয়৷ আবার এই সঙ্গে যখন তাকে খান্নাসও বলা হয়েছে তখন এ দু'টি শব্দ পরস্পর মিলিত হয়ে আপনা আপনি এ অর্থ সৃষ্টি করেছে যে , প্ররোচনা দান করতে সে পিছনে সরে যায় এবং তারপর প্ররোচনা দেবার জন্য আবার বারবার ফিরে আসে ৷ অন্য কথায় একবার তার প্ররোচনা দান করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর সে ফিরে যায়৷ তারপর সেই প্রচেষ্টা চালাবার জন্য বারবার সে ফিরে আসে৷

৩ . কোন কোন বিশেষজ্ঞদের মতে এ শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে , প্ররোচণা দানকারীরাও দুই ধরনের লোকদের মনে প্ররোচনা দান করে ৷ এক ,জিন ও দুই,মানুষ৷ এ বক্তব্যটি মেনে নিলে এখানে ---নাস জিন ও মানুষ উভয়কে বুঝাবে এবং তাঁরা বলেন , এমনটি হতে পারে ৷ কারণ , কুরআনে যখন ( আরবী---) ( পুরুষরা ) শব্দটি জিনদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে যেমন সূরা জিনের ৬ আয়াতে দেখা যায় এবং যখন ( আরবী ) ( দল ) শব্দটির ব্যবহার জিনদের দলের ব্যাপারে হতে পারে , যেমন সূরা আহকাফের ২৯ আয়াতে দেখা যায় তখন পরোক্ষভাবে ' নাস ' শব্দের মধ্যে মানুষে ও জিন উভয়ই শামিল হতে পারে৷ কিন্তু এ মতটি সঠিক নয়৷ কারণ ( আরবী ----------) শব্দগুলো আভিধানিক দিকে দিয়েই ( আরবী-----) (জিন ) শব্দের বিপরীতধর্মী৷ জিন - এর আসল মানে হচ্ছে গোপন সৃষ্টি৷ আর জিন মানুষের দৃষ্টি থেকে গোপন থাকে বলেই তাকে জিন বলা হয়৷ বিপরীত পক্ষে ' নাস ' ও 'ইনস ' শব্দগুলো মানুষ অর্থে এ জন্য বলা হয় যে তারা প্রকাশিত , তাদের চোখে দেখা যায় এবং ত্বক অনুভব করা যায়৷ সূরা কাসাসের ২৯ আয়াতে ( আরবী ------------------) বলা হয়েছে৷ এখানে ( আরবী --------) ( আ - নাসা ) মানে (আরবী ---) (রাআ) অর্থাৎ হযরত মূসা ( আ ) "তুর পাহাড়ের কিনারে আগুন দেখেন৷ " সূরা আন নিসার ৬ আয়াতে বলা হয়েছে : ( আরবী -------------) " যদি তোমরা অনুভব করো , এতিম শিশুদের এখন বুঝসুঝ হয়েছে৷
(আরবী ----------) (আ- নাসতুম) মানে ( আরবী ---------) ( আহসাসতুম ) বা ( আরবী -----) ( রাআইতুম)৷ কাজেই আরবী ভাষার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ' নাস' শব্দটির মানে জিন হতে পারে না৷
তাই এখানে আয়াতটি সঠিক মনে হচ্ছে , " এমন প্ররোচনা দানকারীর অনিষ্ট থেকে যে মানুষের মনে প্ররোচনা দান করে সে জিনদের মধ্য থেকে হোক বা মানুষদের মধ্য থেকে ৷" অর্থাৎ অন্য কথায় বলা যায় , প্ররোচনা দান করার কাজ জিন শয়তানরাও করে আবার মানুষ শয়তানরাও করে৷ কাজেই এ সূরায় উভয়ের অনিষ্ট থেকে পানাহ চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ কুরআন থেকে এ অর্থের সমর্থন পাওয়া যায় এবং হাদীস থেকেও ৷ কুরআনে বলা হয়েছে :
আরবী --------------------------------------------------------------------------------
" আর এভাবে আমি জিন শয়তান ও মানুষ শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবী শত্রু বানিয়ে দিয়েছি তারা পরস্পরের কাছে মনোমুগ্ধকর কথা ধোঁকা ও প্রতারণার ছলে বলতে থাকে৷ " ( আল আন আম , ১১২ )
আর হাদীসে ইমাম আহমাদ , নাসাঈ ও ইবনে হিব্বান হযরত আবু যার গিফারী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন৷ তিনি বলেন : আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে হাযির হলাম৷ তখন তিনি মসজিদে বসেছিলেন৷ তিনি বললেন , আবু যার ! তুমি নামায পড়েছো ? আমি জবাব দিলাম , না৷ বললেন , ওঠো এবং নামায পড়ো ! কাজেই আমি নামায পড়লাম এবং তারপর আবার এসে বসলাম৷ তিনি বললেন :
আরবী --------------------------------------------------------------------------
" হে আবু যার ! মানুষ শয়তান ও জিন শয়তানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর পানাহ চাও!" আমি জিজ্ঞেস করলাম , হে আল্লাহর রসূল ! মানুষের মধ্যেও কি আবার শয়তান হয় ? বললেন হাঁ৷

আল ফালাক

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ
১) বলো ,আশ্রয় চাচ্ছি আমি প্রভাতের রবের ,
مِن شَرِّ مَا خَلَقَ
২) এমন প্রত্যেকটি জিনিসের অনিষ্টকারিতা থেকে যা তিনি সৃষ্টি করেছেন৷
وَمِن شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ
৩) এবং রাতের অন্ধকারের অনিষ্টকারিতা থেকে ,যখন তা ছেয়ে যায়৷

وَمِن شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ
৪) আর গিরায় ফুঁৎকারদানকারীদের ( বা কারিনীদের ) অনিষ্টকারিতা থেকে৷
وَمِن شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ
৫) এবং হিংসুকের অনিষ্টকারিতা থেকে , যখন সে হিংসা করে৷
_____________________________________________________

১ . রিসালাতের প্রচারের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর অহীর মাধ্যমে যে পয়গাম নাযিল হয় ( আরবী ) (বলো ) শব্দটি যেহেতু তার একটি অংশ , তাই একথাটি প্রথমত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে উচ্চারিত হলেও তার পরে প্রত্যেক মু'মিনও এ সম্বোধনের আওতাভুক্ত হয়৷

২ . আশ্রয় চাওয়া কাজটির তিনটি অপরির্হায অংশ রয়েছে৷ এক ,আশ্রয় চাওয়া ৷ দুই , যে আশ্রয় চায়৷ তিন, যার কাছে আশ্রয় চাওয়া হয়৷ আশ্রয় চাওয়ার অর্থ, কোন জিনিসের ব্যাপারে ভয়ের অনুভূতি জাগার কারণে নিজেকে তার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য অন্য কারো হেফাজতে চলে যাওয়া ,তার অন্তরাল গ্রহণ করা , তাকে জড়িয়ে ধরা বা তার ছায়ায় চলে যাওয়া৷আশ্রয় প্রার্থী অবশ্যি এমন এক ব্যক্তি হয় যে অনুভব করে যে সে যে জিনিসের ভয়ে ভীত তার মোকাবেলা করার ক্ষমতা তার নেই৷ বরং তার হাত থেকে বাঁচার জন্য তার অন্যের আশ্রয় গ্রহণ করা প্রয়োজন৷তারপর যার আশ্রয় চাওয়া হয় সে অবশ্যি এমন কোন ব্যক্তিত্ব বা সত্তা হয় যার ব্যাপারে আশ্রয় গ্রহলকারী মনে করে সেই ভয়ংকর জিনিস থেকে সেই তাকে বাঁচাতে পারে৷ এখন এক প্রকার আশ্রয়ের প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী কার্যকারণের জগতে কোন অনুভূত জড় পদার্থ ব্যক্তি বা শক্তির কাছে গ্রহণ করা যেতে পারে৷ যেমন শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোন দুর্গের আশ্রয় নেয়া ,গোলাগুলিও বর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য পরিখা ,বালি ভর্তি থলের প্রাচীর বা ইটের দেয়ালের আড়াল নেয়া ,কোন শক্তিশালী জালেমের হাত থেকে বাঁচার জন্য কোন ব্যক্তি ,জাতি বা রাষ্ট্রের আশ্রয় গ্রহণ করা অথবা রোদ থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য কোন গাছ বা দালানের ছায়ায় আশ্রয় নেয়া৷ এর বিপরীতের দ্বিতীয় প্রকারের আশ্রয় হচ্ছে ,প্রত্যেক ধরনের বিপদ , প্রত্যেক ধরনের বস্তুগত , নৈতিক ও আধ্যাত্মিক এবং ক্ষতিকর বস্তু থেকে কোন অতি প্রকৃতিক সত্তার আশ্রয় এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে গ্রহণ করা যে ইন্দ্রিয় বহির্ভূত অননূভূত পদ্ধতিতে তিনি আশ্রয় গ্রহণকারীকে অবশ্যি সংরক্ষণ করতে পারবেন৷শুধু এখানেই নয়, কুরআন ও হাদীসের যেখানেই আল্লাহর আশ্রয় চাওয়ার কথা এসেছে সেখানেই এ বিশেষ ধরনের আশ্রয় চাওয়ার অর্থেই তা বলা হয়েছে৷ আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে এ ধরনের আশ্রয় প্রার্থনা না করাটাই তাওহীদী বিশ্বাসের অপরির্হায অংগ৷ মুশরিকরা আল্লাহর ছাড়া অন্যান্য সত্তা যেমন জিন ,দেবী ও দেবতাদের কাছে এ ধরনে আশ্রয় চাইতো এবং আজো চায়৷ বস্তুবাদীরা এ জন্য বস্তুগত উপায় - উপকরণের দিকে মূখ ফিরায়৷ কারণ,তারা কোন অতি প্রকৃতিক শক্তিতে বিশ্বাসী নয় ৷ কিন্তু মু'মিন যেসব আপদ - বিপদ ও বালা মুসিবতের মোকাবেলা করার ব্যাপারে নিজেকে অক্ষম মনে করে , সেগুলোর ব্যাপারে সে একমাত্র আল্লাহর দিকে মুখ ফিরায় এবং একমাত্র তাঁরই সঙ্গে আশ্রয় প্রার্থনা করে৷ উদাহরণ স্বরূপ মুশরিকদের ব্যাপরে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে :
আরবী ----------------------------------------------------------------------------------
"আর ব্যাপার হচ্ছে এই যে ,মানব জাতির অন্তরভূক্ত কিছু লোক জিন জাতির অন্তরভূক্ত কিছু লোকের কাছে আশ্রয় চাইতো ৷"( আল জিন ,৬ )
এর ব্যাখ্যায় আমরা সূরা জিনের ৭ টীকার হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা ) বর্ণিত একটি হাদীসে উদ্ধৃত করছি৷তাতে বলা হয়েছে : আরব মুশরিকদের যখন কোন রাতে জনমানবহীন উপত্যকায় রাত কাটাতে হতো তখন তারা চিৎকার করে বলতো : " আমরা এ উপত্যকার রবের ( অর্থাঃ এ উপত্যকার ওপর কর্তৃত্বশালী জিন বা এ উপত্যকার মালিক )আশ্রয় চাচ্ছি৷" অন্যদিকে , ফেরাউন সম্পর্কে বলা হয়েছে : হযরত মূসার (আ ) পেশকৃত মহান নিশানীগুলো দেখে (আরবী --) "নিজের শক্তি সামর্থের ওপর নির্ভর করে সে সদর্পে নিজের ঘাড় ঘুরিয়ে থাকলো৷" (আয যারিয়াত,৩৯ )৷ কিন্তু কুরআন আল্লাহ বিশ্বাসীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মনীতি বর্ণনা প্রসংগে বলা হয়েছে : তারা বস্তগত ,সৈৎনতিক বা আধ্যাত্মিক যে কোন জিনিসের ভীতি অনুভব করলে তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে৷ কাজেই হযরত মারয়াম সম্পর্কে বলা হয়েছ : যখন অকস্মাৎ নির্জনে আল্লাহর ফেরেশতা মানুষের বেশ ধরে তাঁর কাছে এলেন ( তিনি তাঁকে আল্লাহর ফেরেশতা বলে জানতেন না )৷ তখন তিনি বললেন :
আরবী ---------------------------------------------
" যদি তোমার আল্লাহর ভয় থাকে , তাহলে আমি দয়াময় আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি৷" (মারয়াম ,১৮ ) হযরত নূহ (আ ) যখন আল্লাহর কাছে অবাস্তব দোয়া করলেন এবং জবাবে আল্লাহ তাঁকে শাসালেন তখন তিনি সংগে সংগেই আবেদন জানালেন :
আরবী -----------------------------------------
" হে আমার রব! যে জিনিস সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই তেমন কোন জিনিস তোমার কাছে চাওয়া থেকে আমি তোমার পানাহ চাই৷ " ( হুদ, ৪৭ ) হযরত মূসা (আ ) যখন বনি ইসরাঈলদের গাভী যবেহ করার হুকুম দিলেন এবং তারা বললো , আপনি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছেন ? তখন তিনি তাদের জবাবে বললেন :
আরবী ------------------------------------------------------
"আমি মূর্খ - অজ্ঞদের মতো কথা বলা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি৷ (আল বাকারাহ,৬৭ )
হাদীসে গ্রন্থগুলোতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যেসব " তাআউউয " উদ্ধৃত হয়েছে সবগুলো এ একই পর্যায়ের উদাহরণ স্বরূপ তাঁর নিম্মোক্ত দোয়াগুলো দেয়া যেতে পারে :
আরবী ---------------------------------------------------------------------------------
" হযরত আয়েশা (রা ) থেকে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের দোয়াগুলোতে বলতেন : হে আল্লাহ ! আমি যেসব কাজ করেছি এবং যেসব কাজ করিনি তা থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি৷ অর্থাৎ কোন খারাপ কাজ করে থাকলে তার খারপ ফল থেকে পানাহ চাই এবং কোন কাজ করা উচিত ছিল কিন্তু তা আমি করিনি, যদি এমন ব্যাপার ঘটে থাকে তাহলে তার অনিষ্ট থেকে ও তোমার পানাহ চাই ৷ অথবা যে কাজ করা উচিত নয় কিন্তু তা আমি কখনো করে ফেলবো , এমন সম্ভাবনা থাকলে তা থেকেও তোমার আশ্রয় চাই৷ " (মুসলিম)
আরবী ---------------------------------------------------------------------------
" ইবনে উমর থেকে বর্ণিত ৷ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের একটি দোয়া ছিল : হে আল্লাহ ! তোমার যে নিয়ামত আমি লাভ করেছি তা যাতে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে না নেয়া হয় , তোমার কাছ থেকে যে নিরাপত্তা আমি লাভ করেছি তা থেকে যাতে আমাকে বঞ্চিত না করা হয় , তোমার গযব যাতে অকস্মাৎ আমার ওপর আপতিত না হয় সে জন্য এবং তোমার সব ধরনের অসন্তুষ্টি থেকে আমি তোমার আশ্রয় চাচ্ছি" (মুসলিম )
আরবী -------------------------------------------------------------------------------" যায়েদ ইবনে আরকাম (রা) থেকে বর্ণিত ৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন : যে ইলম উপকারী নয় , যে হৃদয় তোমার ভয়ে ভীত নয় , যে সফস কখনো তৃপ্তি লাভ করে না এবং যে দোয়া কবুল করা হয় না , আমি সেসব থেকে তোমার আশ্রয় চাচ্ছি" (মুসলিম )
আরবী -------------------------------------------------------------------------------
" হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত৷ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন : হে আল্লাহ ! আমি ক্ষুধা থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷ কারণ , মানুষ যেসব জিনিসের সাথে রাত অতিবাহিত করে তাদের মধ্যে ক্ষুধা সবচেয়ে খারাপ জিনিস৷ আর আত্মসাৎ থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷ কারণ এটা বড়ই কলুষিত হৃদয়ের পরিচায়ক৷" (আবু দাউদ)৷
আরবী-------------------------------------------------------------------------
" হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত ৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন : হে আল্লাহ ! আমি শ্বেতকুষ্ঠ , উন্মাদনা , কুষ্ঠরোগ ও সমস্ত খারাপ রোগ থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷ " (আবু দাউদ)
আরবী ----------------------------------------------------------------------------
" আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নোক্ত কথাগুলো সহ দোয়া চাইতেন : হে আল্লাহ ! আমি আগুনের ফিতনা এবং ধনী ও দরিদ্র হওয়ার অনিষ্ট থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷" ( তিরমিযী ও আবু দাউদ )
আরবী --------------------------------------------------------------------------
" কুতবাহ ইবনে মালেক বলেন , নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন , হে আল্লাহ ! আমি অসৎ চরিত্র , অসৎ কাজ ও অসৎ ইচ্ছা থেকে তোমার আশ্রয় চাই৷"
শাকাল ইবনে হুমাইদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেন , আমাকে কোন দোয়া বলে দিন৷ জবাবে তিনি বলেন :
আরবী -----------------------------------------------------------------------------
" হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই আমার শ্রবণশক্তির অনিষ্ট থেকে , আমার দৃষ্টিশক্তির অনিষ্ট থেকে , আমার বাকশক্তির অনিষ্ট থেকে , আমার হৃদয়ের অনিষ্ট থেকে এবং আমার যৌন ক্ষমতার অনিষ্ট থেকে ৷ " (তিরমিযী ও আবু দাউদ )
আবরী ---------------------------------------------------------------------------
" আনাস ইবনে মালেক থেকে বর্ণিত ৷ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন : হে আল্লাহ ! আমি অক্ষমতা , কুড়েমি , কাপুরুষতা , বার্ধক্য ও কৃপণতা থেকে আমার আশ্রয় চাই ৷ আর তোমার আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে এবং জীবন ও মৃত্যুর ফিতনা থেকে ৷ ( মুসলিমের অন্য একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে : ) আর ঋণের বোঝা থেকে এবং লোকেরা আমার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করবে , এ থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই৷" বুখারী ও মুসলিম )
-------------------------
"খাওলা বিনতে হুকাইম সুলামীয়া থেকে বর্ণিত৷ তিনি বলেন , আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একথা বলতে শুনেছি : যে ব্যক্তি কোন নতুন মনযিলে নেমে একথাগুলো বলবে -- আমি সৃষ্টির অনিষ্টকারিতা থেকে আল্লাহর নিষ্কলংক কালেমাসমূহের আশ্রয় চাই , সেই মনযিল থেকে রওয়ানা হবার আগে পর্যন্ত তাকে কোন জিনিস ক্ষতি করতে পারবে না৷ " (মসলিম )
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে যেভাবে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন হাদীস থেকে তার কয়েকটি নমুণা এখানে আমরা তুলে ধরলাম৷ এ থেকে জানা যাবে , প্রতিটি বিপদ - আপদ ও অনিষ্টকরিতার মোকাবেলায় আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়াই মু'মিনের কাজ৷ তাছাড়া আল্লাহর প্রতি বিমুখ ও অনির্ভর হয়ে নিজের ওপর ভরসা করাও তার কাজ নয়৷

৩ . মূলে ( আরবী ---) (রব্বিল ফালাক) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ "ফালাক" শব্দের আসল মানে হচ্ছে ফাটানো , চিরে ফেলা বা চিরে ফেলা বা ভেদ করা ৷ কুরআন ব্যাখ্যাদাতাদের বিপুল সংখ্যক অংশ এ শব্দটির অর্থ গ্রহণ করেছেন , রাতরে অন্ধকার চিরে প্রভাতের শুভ্রতার উদয় হওয়া ৷ কারণ , আরবীতে " ফালাকুস সুবহ" শব্দ " প্রভাতের উদয়" অর্থে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয৷ কুরআনেরও মহান আল্লাহর জন্য ( আরবী ---------) ( ফালেকুল ইসবাত ) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর মানে , যিনি রাতের আঁধার চিরে প্রভাতের উদয় করেন৷ " ( আল আন'আম , ৯৬) "ফালাক" শব্দের দ্বিতীয় অর্থ গ্রহন করা হয়েছে সৃষ্টি করা ৷ কারণ দুণিয়ায় যত জিনিসই সৃষ্টি হয় , সবগুলোই কোন না কোন জিনিস ভেদ করে বের হয়৷ বীজের বুক চিরে সব ধরনের গাছ ও উদ্ভিদের অংকুর বের হয়৷ সব ধরনের প্রাণী মায়ের গর্ভশয় চিরে অথবা ডিম ফুটে কিংবা অন্য কোন আবরণ ভেদ করে বের হয়৷ সমস্ত ঝরণা ও নদী পাহাড় বা মাটি চিরে বের হয়৷ দিবস বের হয় রাতের আবরণ চিরে ৷ বৃষ্টির ধরা মেঘের স্তর ভেদ করে পৃথিবীতে নামে ৷ মোটকথা , অস্তিত্ব জগতের প্রতিটি জিনিস কোন না কোনভাবে আবরণ ভেদ করার ফলে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব লাভ করে৷ এমনকি পৃথিবী ও সমগ্র আকাশ মণ্ডলও প্রথমে একটি স্তূপ ছিল৷ তারপর তাকে বিদীর্ণ করে পৃথক পৃথক অস্তিত্ব দান করা হয়েছে৷ (আরবী ---------) এ আকাশ ও পৃথিবী সবকিছুই স্তূপীকৃত ছিল , পরে আমি এদেরকে আলাদা আলাদা করে দিয়েছি৷ ( আল আম্বিয়া ,৩০) কাজেই এ অর্থের প্রেক্ষিতে ফালাক শব্দটি সমস্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে সমানভাবে ব্যবহৃত হয়৷ এখন এর প্রথম অর্থটি গ্রহণ করলে আয়াতের অর্থ হবে , আমি প্রভাতের মালিকের আশ্রয় চাচ্ছি৷ আর দ্বিতীয় অর্থটি গ্রহণ করলেণ এর মানে হবে , আমি সমগ্র সৃষ্টি জগতের রবের আশ্রয় চাচ্ছি৷ এখানে আল্লাহর মূল সত্তাবাচক নাম ব্যবহার না করে তাঁর গুণবাচক নাম " রব" ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর কারণ , আশ্রয় চাওয়ার সাথে আল্লাহর "রব" অর্থাৎ মালিক , প্রতিপালক , প্রভু ও পরওয়ারদিগার হবার গুণাবলীই বেশী সম্পর্ক রাখে৷ তাছাড়া " রব্বুল ফালাক " এর অর্থ যদি প্রভাতের রব ধরা হয় তাহলে তাঁর আশ্রয় চাওয়ার মানে হবে , যে রব অন্ধকরের আরবণ ভেদ করে প্রভাতের আলো বের করে আনেন আমি তাঁর আশ্রয় নিচ্ছি৷ এর ফলে তিনি বিপদের অন্ধকার জাল ভেদ করে আমাকে নিরাপত্তা দান করবেন৷ আর যদি এর অর্থ সৃষ্টিজগতের রব ধরা হয় , তাহলে এর মানে হবে , আমি সমগ্র সৃষ্টির মালিকের আশ্রয় নিচ্ছি৷ তিনি নিজের সৃষ্টির অনিষ্টকারিতা থেকে আমাকে বাঁচাবেন৷

৪ . অন্য কথায় সমগ্র সৃষ্টির অনিষ্টকারিতা থেকে আমি তাঁর আশ্রয় চাচ্ছি৷ এ বাক্যে চিন্তা করার মতো কয়েকটি বিষয় আছে৷ প্রথমত অনিষ্টকারিতা সৃষ্টির ব্যাপারটিকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করা হয়নি৷ বরং সৃষ্টিজগতের সৃষ্টিকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে৷ আর অনিষ্টকারিতাসমূহ সৃষ্টি করেছেন সেগুলো থেকে আশ্রয় চাচ্ছি৷ বরং বলা হয়েছে , আল্লাহ যেসব জিনিস সৃষ্টি করেছেন , তাদের অনিষ্টকারিতা থেকে আশ্রয় চাচ্ছি৷ এ থেকে জানা যায় , মহান আল্লাহ কোন সৃষ্টিকে অনিষ্টকারিতার জন্য সৃষ্টি করেননি৷ বরং তাঁর প্রত্যেকটি কাজ কল্যাণকর এবং কোন না কোন কল্যাণমূলক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্যই হয়ে থাকে৷ তবে সৃষ্টির মধ্যে তিনি যেসব গুণ সমাহিত করে রেখেছেন , যেগুলো তাদের সৃস্টির উদ্দেশ্য পূর্ণ করার জন্য প্রয়োজন , সেগুলো থেকে অনেক সময় এবং অনেক ধরনের সৃষ্টি প্রায়ই অনিষ্টকারিতার প্রকাশ ঘটে৷
দ্বিতীয়ত , যদি শুধু একটি মাত্র বাক্য বলেই বক্তব্য শেষ করে দেয়া হতো এবং পরবর্তী বাক্যগুলোতে বিশেষ ধরনের সৃষ্টির অনিষ্টকারিতা থেকে আলাদা আলাদাভাবে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করার কথা নাই - বা বলা হতো তাহলেও এ বাক্যটি বক্তব্য বিষয় পুরোপুরি প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট ছিল৷ কারণ , এখানে সমস্ত সৃষ্টিলোকের অনিষ্টকারিতা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে নেয়া হয়েছে৷ এই ব্যাপকভাবে আশ্রয় চাওয়ার পর আবার কতিপয় বিশেষ অনিষ্টকারিতা থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা বলা স্বতষ্ফূর্তভাবে এ অর্থই প্রকাশ করে যে , আমি স্বাভাবিকভাবে আল্লাহর প্রত্যেকটি সৃষ্টির অনিষ্টকারিতা থেকে তাঁর আশ্রয় চাচ্ছি , তবে বিশেষভাবে সূরা আল ফালাকের অবশিষ্ট আয়াতসমূহেও সূরা আন নাসে যেসব অনিষ্টকারিতার কথা বলা হয়েছে , সেগুলো এমন পর্যায়ের যা থেকে আমি আল্লাহর নিরাপত্তা লাভের বড় বেশী মুখাপেক্ষী ৷
তৃতীয়ত , সৃষ্টিলোকের অনিষ্টকারিতা থেকে পানাহ লাভ করার জন্য সবচেয়ে সংগত ও প্রভাবশালী আশ্রয় চাওয়ার ব্যাপার যদি কিছু হতে পারে, তবে তা হচ্ছে তাদের স্রষ্টার কাছে আশ্রয় চাওয়া৷ কারণ , তিনি সব অবস্থায় নিজের সৃষ্টির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন৷ তিনি তাদের এমন সব অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে জানেন যেগুলো আমরা জানি, আবার আমরা জানি না এমনসব অনিষ্টকারিতা সম্পর্কেও তিনি জানেন৷ কাজেই তাঁর আশ্রয় হবে , যেন এমন সর্বশেষ্ঠ শাসকের কাছে আশ্রয় যার মোকাবেলা করার ক্ষমতা কোন সৃষ্টির নেই৷ তাঁর কাছে আশ্রয় চেয়ে আমরা দুনিয়ার প্রত্যেকটি সৃষ্টির জানা অজানা অনিষ্টকারিতা থেকে আত্মরক্ষা করতে পারি৷ তাছাড়া কেবল দুনিয়ারই নয় , আখেরাতের সকল অনিষ্টকারিতা থেকেও পানাহ চাওয়াও এর অন্তরভুক্ত হয়েছে৷
চতুর্থত , অনিষ্টকারিতা শব্দটি ক্ষতি , কষ্ট , ব্যথা ও যন্ত্রণার জন্য ও ব্যবহার করা হয়৷ আবার যে কারণে ক্ষতি , কষ্ট , ব্যথা ও যন্ত্রণা সৃষ্টি হয় সে জন্যও ব্যবহার করা হয়,‌ যেমন রোগ , অনাহার , কোন যুদ্ধ বা ঘটনায় আহত হওয়া , আগুনে পুড়ে যাওয়া , সাপ বিচ্ছু ইত্যাদি দ্বারা দংশিত হওয়া , সন্তানের মৃত্যু শোকে কাতর হওয়া এবং এ ধরনের আরো অন্যান্য অনিষ্টকারিতা প্রথমোক্ত অর্থের অনিষ্টকারিতা৷ কারণ , এগুলো যথার্থই কষ্ট ও যন্ত্রণা ৷ অন্যদিকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ কুফরী , শিরক এবং যেসব ধরনের গোনাহ ও জুলুম দ্বিতীয় প্রকার অনিষ্টকারিতা ৷ কারণ , এগুলোর পরিণাম কষ্ট ও যন্ত্রণা৷ যদিও আপাত দৃষ্টিতে এগুলো সাময়িকভাবে কোন কষ্ট ও যন্ত্রণা দেয় না বরং কোন কোন গোনাহ বেশ আরামের৷ সেসব গোনাহ করে আনন্দ পাওয়া যায় এবং লাভের অংকটাও হাতিয়ে নেয়া যায়৷ কাজেই এ দু'অর্থেই অনিষ্টকারিতা থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়৷
পঞ্চমত , অনিষ্টকারিতা থেকে আশ্রয় চাওয়ার মধ্যে আরো দু'টি অর্থও রয়েছে৷ যে অনিষ্ট ইতিমধ্যে হয়ে গেছে৷ বান্দা আল্লাহর কাছে দোয়া করছে , হে আল্লাহ ! তাকে খতম করে দাও৷ আর যে অনিষ্ট এখনো হয়নি , তার সম্পর্কে বান্দা দোয়া করছে , হে আল্লাহ ! এ অনিষ্ট থেকে আমাকে রক্ষা করো৷

৫ . সৃষ্টিজগতের অনিষ্টকারিতা থেকে সাধারণভাবে আল্লাহর আশ্রয় চাওয়ার পর এবার কয়েকটি বিশেষ সৃষ্টির অনিষ্টকারিতা থেকে বিশেষভাবে পানাহ চাওয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে৷ মূল আয়াতে (আরবী ---------------) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ 'গাসেক ' (আরবী -----) এর অভিধানিক অর্থ হচ্ছে অন্ধকার৷ কুরআনে এক জায়গায় বলা হয়েছে : (আরবী ------------------------) " নামায কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত৷ " ( বনি ইসরাঈল ,৭৮)
আর ' ওয়া কাবা ' ----মানে হচেছ , প্রবেশ করা বা ছেয়ে যাওয়া ৷ রাতের অন্ধকারের অনিষ্টকারতা থেকে বিশেষ করে পানাহ চাওয়ার নির্দেশ দেবার কারণ হচ্ছে এই যে , অধিকাংশ অপরাধ ও জুলুম রাতের অন্ধাকরেই সংঘটিরত হয়৷ হিংস্র জীবেরাও রাতের আঁধারেই বের হয়৷ আর এ আয়াতগুলো নাযিল হবার সময় আরবে রাজনৈতিক অরাজকতা যে অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল তাতে রাতের চিত্র তো ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ৷ তার অন্ধকার চাঁদর মুড়ি দিয়ে লুটেরা ও আক্রমণকারীরা বের হতো ৷ তারা জনবসতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো লুটতরাজ ও খুনাখুনি করার জন্য যারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণ নাশের চেষ্টা করছিল , তারাও রাতের আঁধারেই তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা তৈরি করেছিল৷ কারণ , এভাবে হত্যাকারীকে চেনা যাবে না৷ ফলে তার সন্ধান লাভ করা সম্ভব হবে না৷ তাই রাতের বেলা যেসব অনিষ্টকারিতা ও বিপদ - আপদ নাযিল হয় সেগুলো থেকে আল্লাহ কাছে আশ্রয় চাওয়ার হুকুম দেয়া হয়েছে৷ এখানে আঁধার রাতের অনিষ্টকারিতা থেকে প্রভাতের রবের আশ্রয় চাওয়ার মধ্যে যে সূক্ষ্মতম সম্পর্ক রয়েছে তা কোন গভীর পর্যবেক্ষকের দৃষ্টির আড়ালে থাকার কথা নয়৷
এ আয়াতের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন দেখা যায়৷ বিভিন্ন সহীহ হাদীসে হযরত আয়েশার (রা) একটি বর্ণনা এসেছে৷ তাতে বলা হয়েছে , রাতে আকাশে চাঁদ ঝলমল করছিল৷ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার হাত ধরে তার দিকে ইশারা করে বললেন , আল্লাহর কাছে পানাহ চাও : (আরবী ---------------------) অর্থাৎ এ হচ্ছে সেই গাসেক ইযা ওয়াকব ( আহমাদ , তিরমিযী , নাসাঈ , ইবনে জারীর , ইবনুল মুনযির , হাকেম ও ইবনে মারদুইয়া )৷ এর অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে কেউ কেউ বলেছেন , ইযা ওয়াকাব ( আরবী -------) মানে হচেছ এখানে ( আরবী --------) ( ইয়া খাসাকা ) অর্থাৎ যখন তার গ্রহণ হয়ে যায় অথবা চন্দ্রগ্রহণ তাকে ঢেকে ফেলে৷ কিন্তু কোন হাদীসে একথা বলা হয়নি যে , যখন রসূলুল্লাহ (সা) চাঁদের দিকে এভাবে ইশারা করেছিলেন তখন চন্দ্রগ্রহণ চলছিল৷ আরবী আভিধানিক অর্থেও ( আরবী -----------) কখনো ( আরবী ------------) হয় না৷ তাই আমার মতে হাদীটির সঠিক ব্যাখ্যা হচ্ছে : চাঁদের উদয় যেহেতু রাতের বেলায়ই হয়ে থাকে এবং দিনের বেলা চাঁদ আকাশের গায়ে থাকলেও উজ্জ্বল থাকে না , তাই রসূলুল্লাহ (সা) উক্তির অর্থ হচ্ছে এর ( অর্থাৎ চাঁদের )আগমনের সময় অর্থাৎ রাত থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাও৷ কারণ , চাঁদের আত্মরক্ষাকারীর জন্য ততটা সহায়ক হয় না , যতটা সহায়ক হয় আক্রমণকারীর জন্য আর তা অপরাধীকে যতটুকু সহায়তা করে , যে অপরাধের শিকার হয় তাকে ততটুকু সহায়তা করে না৷ এ জন্য রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
আরবী ---------------------------------------------------------------------------
" যখন সূর্য ডুবে যায় , তখন শয়তানরা সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ কাজেই শিশুদেরকে তখন ঘরের মধ্যে রাখো এবং নিজেদের গৃহপালিত পশুগুলো বেঁধে রাখো , যতক্ষণ রাতের আঁধার খতম না হয়ে যায়৷ "

৬ . মূলে ( আরবী ------------) শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়েছে৷ ' উকাদ ' (আরবী -------) শব্দটি "উকদাতুন " ( আরবী -----------) শব্দের বহুবচন৷ এর মানে হচ্ছে গিরা ৷ যেমন সূতা বা রশিতে যে গিরা দেয়া হয়৷ নাফস ( আরবী ------) মানে ফুঁক দেয়া৷ নাফফাসাত ( আরবী --------) হচ্ছে নাফফাসাহ ( আরবী ------) এর বহুবচন৷ এ শব্দটিকে ( আরবী ------ ) ওজনে ধরা হলে এর অর্থাৎ হবে খুব বেশী ফুঁকদানকারী ৷ আর স্ত্রীলিংগে এর অর্থ করলে দাঁড়ায় খুব বেশী ফুঁকদানকারিনীরা অথবা ফুঁকদানকারী ব্যক্তিবর্গ বা দলেরা ৷ কারণ আরবীতে " নফস" ( ব্যক্তি) ও " জামায়াত " (দল স্ত্রীলিংগ অধিকাংশ তথা সকল মুফাসসিরের মতে গিরায় ফুঁক দেয়া শব্দটি যাদুর জন্য রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়৷ কারণ যাদুকর সাধারণত কোন সূতায় বা ডোরে গিরা দিতে এবং তাতে ফুঁক দিতে থাকে৷ কাজেই আয়াতের অর্থ হচ্ছে , আমি পুরুষ যাদুকর বা মহিলা যাদুকরদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য প্রভাতের রবের আশ্রয় চাচ্ছি৷ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর যখন যাদু করা হয়েছিল, তখন জিব্রীল আলাইহিস সালাম এসে তাঁকে সূরা আল ফালাক ও আন নাস পড়তে বলেছিলেন৷ এ হাদীসটি থেকে ও ওপরের অর্থে সমর্থন পাওয়া যায়৷ এ সূরা দু'টির এ একটি বাক্যই সরাসরি যাদুর সাথে সম্পর্ক রাখে৷ আবু মুসলিম ইসফাহানী ও যামাখশারী ' নাফফাসাত ফিল উকাদ ' বাক্যাংশের অন্য একটি অর্থেও বর্ণনা করেছেন৷ তাঁরা বলেন , এর মানে হচ্ছে : মেয়েদের প্রতারণা এবং পুরুষের সংকল্প , মতামত ও চিন্তা ভাবনার ওপর তাদের প্রভাব বিস্তার ৷ একে তারা তুলনা করেছেন যাদুকরের যাদুকর্মের সাথে৷ কারণ , মেয়েদের প্রেমে মত্ত হয়ে পুরুষদের অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় , যেন মনে হয় কোন যাদুকর তাদেরকে যাদু করেছে৷ এ ব্যাখ্যাটি অত্যন্ত রসাত্মক হলেও পূর্ববর্তী ব্যাখ্যাদাতাগণ এর যে ব্যাখ্যা দিয়ে আসছেন , এটি সেই স্বীকৃত ব্যাখ্যার পরিপন্থী ৷ আর ইতিপূর্বে আমরা ভূমিকায় এ দু'টি সূরা নাযিলের যে সমকালীন অবস্থার বর্ণনা দিয়ে এসেছি তার সাথে এর মিল নেই৷
যাদুর ব্যাপারে অবশ্যি একথা জেনে নিতে হবে , এর মধ্যে অন্য লোকের ওপর খারপ প্রভাব ফেলার জন্য শয়তান , প্রেতাত্মা বা নক্ষত্রসমূহের সাহায্য চাওয়া হয়৷ এ জন্য কুরআনে একে কুফরী বলা হয়েছে৷
আরবী ----------------------------------------------------------------------------------
" সুলাইমান কুফরী করেনি৷ বরং শয়তানরা কুফরী করেছিল৷ তারা লোকদেরকে যাদু শেখাতো৷ " ( আল বাকারা , ১০২ ) কিন্তু তার মধ্যে কোন কুফরী কালেমা বা শিরকী কাজ না থাকলেও তা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে এমন সাতটি কবীরা গোনাহের অন্তরভুক্ত করেছেন , যা মানুষের আখেরাত বরবাদ করে দেয়৷ এ প্রসংগে বুখারী ও মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন , সাতটি ধ্বংসকর জিনিস থেকে দূরে থাকো৷ লোকেরা জিজ্ঞেস করলো , হে আল্লাহর রসূল ! সেগুলো কি ? বলবেন , আল্লাহ সাথে কাউকে শরীক করা , যাদু , আল্লাহ যে প্রাণ নাশ হারাম করেছেন ন্যায়সংগত কারণ ছাড়া সেই প্রাণ নাশ করা , সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পত্তি গ্রাস করা , জিহাদে দুশমনের মোকাবিলায় পালিয়ে যাওয়া এবং সরল সতীসাধ্বী মু'মিন মেয়েদের বিরুদ্ধে ব্যভিচারের দোষারোপ করা ৷

৭ . হিংসার মানে হচেছ , কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ যে অনুগ্রহ , শ্রেষ্ঠত্ব বা গুণাবলী দান করেছে তা দেখে কোন ব্যক্তি নিজের মধ্যে জ্বালা অনুভব করে এবং তার থেকে ওগুলো ছিনিয়ে নিয়ে এ দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দেয়া হোক , অথবা কমপক্ষে তার থেকে সেগুলো অবশ্যি ছিনিয়ে নেয়া হোক এ আশা করতে থাকে৷ তবে কোন ব্যক্তি যদি আশা করে , অন্যের প্রতি যে অনুগ্রহ করা হয়েছে তার প্রতিও তাই করা হোক , তাহলে এটাকে হিংসার সংজ্ঞায় ফেলা যায় না৷ এখানে হিংসুক যখন হিংসা করে অর্থাৎ তার মনের আগুন নিভানোর জন্য নিজের কথা ও কাজের মাধ্যমে কোন পদক্ষেপ নেয় , সেই অবস্থায় তার অনিষ্টকারিতা থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় চাওয়া হয়েছে৷ কারণ , যতক্ষণ সে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না ততক্ষণ তার জ্বালা - পোড়া তার নিজের জন্য খারাপ হলেও যার প্রতি হিংসা করা হচ্ছে তার জন্য এমন কোন অনিষ্টকারিতায় পরিণত হচ্ছে না , যার জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া যেতে পারে৷ তারপর যখন কোন হিংসুক থেকে এমন ধরনের অনিষ্টকারিতার প্রকাশ ঘটে তখন তার হাত থেকে বাঁচার প্রধানতম কৌশল হিসেবে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে হবে৷ এই সাথে হিংসুকের অনিষ্টকারিতার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আরো কয়েকটি জিনিসও সহায়ক হয়৷ এক , মানুষ আল্লাহর ওপর ভরসা করবে এবং আল্লাহ চাইলে কেউ তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না , একথায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করবে৷ দুই , হিংসুকের কথা শুনে সবর করবে৷ বেসবর হয়ে এমন কোন কথা বলবে না বা কাজ করতে থাকবে না , যার ফলে সে নিজেও নৈতিকভাবে হিংসুকের সাথে একই সমতলে এসে দাঁড়িয়ে যাবে৷ তিন , হিংসুক আল্লাহভীতি বিসর্জন দিয়ে বা চরম নির্লজ্জতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যতই অন্যায় - অশালীন আচরন করতে থাকুক না কেন , যার প্রতি হিংসা করা হচ্ছে সে যেন সবসময় তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে৷ চার , তার চিন্তা যেন কোন প্রকারে মনে ঠাঁই না দেয় এবং তাকে এমনভাবে উপেক্ষা করবে যেন সে নেই৷ কারণ ,তার চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাওয়াই হিংসুকের হাতে পরাজয় বরণের পূর্ব লক্ষণ৷ পাঁচ , হিংসুকের সাথে অসদ্ব্যবহার করা তো দূরের কথা , কখনো যদি এমন অবস্থায় সৃষ্টি হয়ে যায় যে , যর প্রতি হিংসা করা হচ্ছে যে হিংসাকারীর সাথে সদ্ব্যবহার ও তার উপাকার করতে পারে , তাহলে তার অবশ্যি তা করা উচিত৷ হিংসুকের মনে যে জ্বালাপোড়া চলছে , প্রতিপক্ষের এ সদ্ব্যবহার তা কতটুকু প্রশমিত হচ্ছে বা হচ্ছে সে তাওহীদের আকীদা সঠিকভাবে উপলব্ধি করে তার ওপর অবিচল থাকবে ৷ কারণ , যে হৃদয়ে তাওহীদের আকীদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে আল্লাহর ভয়ের সাথে অপর কারো ভয় স্থান লাভ করতে পারে না৷

আল ইখলাস

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ
الرَّحِيمِ قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ
১) বলো,তিনি আল্লাহ,একক৷
اللَّهُ الصَّمَدُ
২) আল্লাহ কারোর ওপর নির্ভরশীল নন এবং সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল ৷
لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ
৩) তাঁর কোন সন্তান নেই এবং তিনি কারোর সন্তান নন৷
وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ
৪) এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই৷
____________________________________________________________________________
১ . এখানে 'বলো' শব্দে মাধ্যমে প্রথমত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে৷ কারণ তাঁকেই প্রশ্ন করা হয়েছিল রব কে ? তিনি কেমন ? আবার তাঁকে হুকুম দেয়া হয়েছিল , প্রশ্নের জবাবে আপনি একথা বলুন ৷ কিন্তু রসূলের (সা) তিরোধানের পর এ সম্বোধনটি প্রত্যেক মু'মিনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়৷ রসূলুল্লাহকে (সা) যে কথা বলার হুকুম দেয়া হয়েছিল এখন সে কথা তাকেই বলতে হবে৷ 

২ . অর্থাৎ আমার যে রবের সাথে তোমরা পরিচিত হতে চাও তিনি আর কেউ নন , তিনি হচ্ছেন আল্লাহ ৷ এটি প্রশ্নোকারীদের প্রশ্নের প্রথম জবাব ৷ এর অর্থ হচ্ছে , তোমাদের সামনে আমি কোন নতুন রব নিয়ে অসিনি৷ অন্যসব মাবুদদের ইবাদাত ত্যাগ করে কোন নতুন মাবুদের ইবাদাত করতে আমি তোমাদের বলিনি৷ বরং আল্লাহ নামে যে সত্তার সাথে তোমরা পরিচিত তিনি সেই সত্তা৷ আরবদের জন্য ' আল্লাহ ' শব্দটি কোন নতুন ও অপরিচিত শব্দ ছিল না৷ প্রাচীনতম কাল থেকে বিশ্ব - জাহানের সষ্টার প্রতিশব্দ হিসেবে তারা আল্লাহ শব্দটি ব্যবহার করে আসছিল৷ নিজেদের অন্য কোন মাবুদ ও উপাস্য দেবতার সাথে এ শব্দটি সংশ্লিষ্ট করতো না৷ অন্য মাবুদদের জন্য তারা " ইলাহ" শব্দ ব্যবহার করতো৷ তারপর আল্লাহ সম্পর্কে তাদের যে আকীদা ছিল তার চমৎকার প্রকাশ ঘটেছিল আবরাহার মক্কা আক্রমণের সময়৷ সে সময় কা'বাঘরে ৩৬০ টি উপাস্যের মূর্তি ছিল৷ কিন্তু এ বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য মুশরিকরা তাদের সবাইকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিল৷ অর্থাৎ তারা নিজেরা ভালোভাবে জানতো , এ সংকটকালে আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্তাই তাদেরকে সাহায্য করতে পারবে না৷ কা'বা ঘরকেও তারা এসব ইলাহের সাথে সম্পর্কিত করে বায়তুল আ- লিহাহ ( ইলাহ -- এর বহুবচন ) বলতো না বরং আল্লাহর সম্পর্কিত করে একে বলতো বায়তুল্লাহ৷ আল্লাহ সম্পর্কে আরবের মুশরিকদের আকীদা কি ছিল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে তা বলা হয়েছে ৷ যেমন : সূরা যুখরুফে বলা হয়েছে : "যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো , কে তাদের পয়দা করেছে , তাহলে তারা নিশ্চয়ই বলবে আল্লাহ৷" (৮৭ আয়াত ) শূরা আনকাবুতে বলা হয়েছে : " যদি এদেরকে জিজ্ঞেস করো , আকাশসমূহ ও যমীনকে কে পয়দা করেছে এবং চাঁদ ও সূর্যকে কে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছে , তাহলে নিশ্চয়ই তারা বলবে আল্লাহ ৷-------------আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো , কে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলেন এবং কার সাহায্যে মৃত পতিত জমিকে সজীবতা দান করলেন , তহালে তারা নিশ্চয়ই বলবে আল্লাহ ৷ " (৬১-৬৩ আয়াত)
সূরা মু'মিনূনে বলা হয়েছে : " এদেরকে জিজ্ঞেস করো , বলো যদি তোমরা জানো , এ যমীন এবং এর সমস্ত জনবসতি কার ? এরা অবশ্যি বলবে আল্লাহর ৷ --------- এদেরকে জিজ্ঞেস করো , সাত আকাশ ও মহাআরশের মালিক কে ? এরা অবশ্যি বলবে , আল্লাহ ৷ ----------------- এদেরকে জিজ্ঞেস করো , বলো যদি তোমরা জেনে থাকো প্রত্যেকটি জিনিসের ওপর কার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ? আর কে আশ্রয় দান করেন এবং কার মোকাবিলায় কেউ আশ্রয় দিতে পারেন না ? এরা নিশ্চয়ই বলবে , এ ব্যাপারটি তো একমাত্র আল্লাহরই জন্য৷ " (৮৪-৮৯ আয়াত )
সূরা ইউনুসে বলা হয়েছে : "এদেরকে জিজ্ঞেস করো কে তোমাদের আকাশ ও যমীন থেকে রিযিক দেন ? তোমরা যে শ্রবণ ও দৃষ্টিক্ষমতার অধিকারী হয়েছো৷ এগুলো কার ইখতিয়ারভুক্ত ? আর কে জীবিতকে মৃত থেকে এবং মৃতকে জীবিত থেকে বের করেন এবং কে এ বিশ্বব্যবস্থাপনা চালাচ্ছেন ? এরা নিশ্চয়ই বলবে , আল্লাহ৷ " ( ৩১ আয়াত )
অনুরূপভাবে সূরা‌ ইউনুসের আর এক জায়গায় বলা হয়েছে : " যখন তোমরা জাহাজে আরোহণ করে অনুকূলে বাতাসে আনন্দ চিত্তে সফর করতে থাকো আর তারপর হঠাৎ প্রতিকূল বাতাসের বেগ বেড়ে যায় , চারদিকে থেকে তরংগ আঘাত করতে থাকে এবং মুসাফিররা মনে করতে থাকে , তা চারদিকে থেকে ঝনঝা পরিবৃত হয়ে পড়েছে , তখন সবাই নিজের দীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে নিয়ে তাঁরই কাছে দোয়া করতে থাকো এই বলে : " হে আল্লাহ যদি তুমি আমাদের এ বিপদ থেকে উদ্ধার করো তাহলে আমরা কৃতজ্ঞ বান্দার পরিণত হবো৷ কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে বাঁচিয়ে দেন তখন এই লোকেরাই সত্যচ্যূত হয়ে পৃথিবীতে বিদ্রোহ সৃষ্টির কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে৷ "
সূরা বনী ইসরাঈলে একথাটিরই পুনরাবৃত্তি এভাবে করা হয়েছে : " যখন সমুদ্রে তোমাদের ওপর বিপদ আসে তখন সেই একজন ছাড়া আর যাদেরকে তোমারা ডাকতে তারা সবাই হারিয়ে যায়৷ কিন্তু যখন তিনি তোমাদের বাঁচিয়ে স্থলভাগে পৌঁছিয়ে দেন তখন তোমরা তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও৷ " (৬৭ আয়াত )
এ আয়াতগুলো সামনে রেখে চিন্তা করুন , লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলো , আপনার সেই রব কে এবং কেমন , যার ইবাদাত বন্দেগী করার জন্য আপনি আমাদের প্রতি আহাবান জানাচ্ছেন ? তিনি এর জবাবে বরলেন : ( আরবী ----------) তিনি আল্লাহ ! এ জবাব থেকে আপনা আপনি এ অর্থ বের হয় , যাকে তোমরা নিজেরাই নিজেদের ও সারা বিশ্ব- জাহানের স্রষ্টা , প্রভু , আহারদাতা , পরিচালাক ও ব্যবস্থাপক বলে মানো এবং কঠিন সংকটময় মুহূর্তে অন্য সব মাবুদদের পরিত্যাগ করে একমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য করার আবেদন জানাও , তিনিই আমার রব এবং তাঁরই ইবাদাত করার দিকে আমি তোমাদের আহবান জানাচ্ছি৷ এ জবাবের মধ্যে আল্লাহর সমস্ত পূর্ণাংগ গুণাবলী আপনা আপনি এসে পড়ে৷ কারণ যিনি এ বিশ্ব- জাহানের সৃষ্টিকর্তা , যিনি এর বিভিন্ন বিষয়ের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা করেন , যিনি এর মধ্যে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণীর আহার যোগান এবং বিপদের সময় নিজের বান্দাদের সাহায্য করেন তিনি জীবিত নন , শুনতে ও দেখতে পান না , স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নন , সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞানী নন , করুণাময় ও স্নেহশীল নন এবং সবার ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী নন , একথা আদাতে কল্পনাই করা যায় না৷

৩ . ব্যাকরণের সূত্র অনুসারে উলামায়ে কেরাম ( আরবী -------) বাক্যটির বিভিন্ন বিশ্লেষণ দিয়েছেন৷ কিন্তু আমাদের মতে যে বিশ্লেষণটি এখানকার সাথে পুরোপুরি খাপ খায় সেটি হচ্ছে : (আরবী -----) উদ্দেশ্য (Subject) আল্লাহ তার বিধেয় (predicate) এবং ( আরবী --------) তার দ্বিতীয় বিধেয়৷ এ বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে এ বাক্যটিতে অর্থ হচ্ছে , তিনি (যাঁর সম্পর্কে তোমরা প্রশ্ন করছো ) আল্লাহ একক ৷ অন্য অর্থে এও হতে পারে এবং ভাষারীতির দিকে দিয়ে এটা ভুলও নয় যে , তিনি আল্লাহ এক ৷ সর্বপ্রথম একথাটি বুঝে নিতে হবে যে , এ বাক্যটিতে মহান আল্লাহর জন্য " আহাদ " শব্দটি যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা আরবী ভাষায় এ শব্দটির একটি অস্বাভাবিক ব্যবহার৷ সাধারণত অন্য একটি শব্দের সাথে সম্বন্ধের ভিত্তিতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয় , যেমন : ( আরবী ----------) " সপ্তাহের প্রথম দিন৷ " অনুরূপভাবে ( আরবী -------) "তোমাদের কোন একজনকে পাঠাও ৷" অথবা সাধারণ নেতিবাচক অর্থে এর ব্যবহার হয়৷ যেমন : (আরবী ----------) " আমার কাছে কেউ আসেনি৷ " কিংবা ব্যাপকতার ধারণাসহ প্রশ্ন সূচক বাক্যে বলা হয়৷ যেমন : ( আরবী -----------) " তোমার কাছে কি কেউ আছে ? " অথবা এ ব্যাপকতার ধারণাসহ শর্ত প্রকাশক বাক্যে এর ব্যবহার হয় যেমন : (আরবী -------) " যদি তোমার কাছে কেউ এসে থাকে ৷" অথবা গণনায় বলা হয়৷ যেমন : ( আরবী --------) " এক , দুই , এগার৷" এ সীমিত ব্যবহারগুলো ছাড়া কুরআন নাযিলের পূর্বে আরবী ভাষায় ( আরবী--) আহাদ শব্দটির গুণবাচক অর্থে ব্যবহার অর্থাৎ কোন ব্যক্তি বা জিনিসের গুণ প্রকাশ অর্থে " আহাদ" শব্দের ব্যবহারের কোন নজির নেই৷ আর কুরআন নাযিলের পর এ শব্দটি শুধুমাত্র আল্লাহর সত্তার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে৷ এ অস্বাভাবিক বর্ণনা পদ্ধতি স্বতষ্ফূর্তভাবে একথা প্রকাশ করে যে , একক ও অদ্বিতীয় হওয়া আল্লাহর বিশেষ গুণ৷ বিশ্ব - জাহানের কোন কিছুই এ গুণে গুণান্বিত নয়৷ তিনি এক ও একক , তাঁর কোন দ্বিতীয় নেই৷
তারপর মুশরিক ও কুরাইশরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাঁর রব সম্পর্কে যেসব প্রশ্ন করেছিল সেগুলো সামনে রেখে দেখুন , ( আরবী --------) বলার পর ( আরবী -) বলে কিভাবে তার জবাব দেয়া হয়েছে :
প্রথমত , এর মানে হচেছ , তিনি একাই রব৷ তাঁর 'রবুবিয়াতে ' কারো কোন অংশ নেই৷ আর যেহেতু ইলাহ ( মাবুদ) একমাত্র তিনিই হতে পারেন যিনি রব ( মালিক ও প্রতিপালক ) হন , তাই ' উলুহীয়াতে'ও ( মাবুদ হবার গুণাবলী ) কেউ তাঁর সাথে শরীক নেই৷
দ্বিতীয়ত , এর মানে এও হয় যে , তিনি একাই এ বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা৷ এ সৃষ্টিকর্মে কেউ তাঁর সাথে শরীক নয়৷ তিনি একাই সমগ্র বিশ্ব- রাজ্যের মালিক ও একচ্ছত্র অধিপতি৷ তিনি একাই বিশ্ব - ব্যবস্থার পরিচালক ও ব্যবস্থাপক ৷ নিজের সমগ্র সৃষ্টিজগতের রিযিক তিনি একাই দান করেন ৷ সংকটকালে তিনি একাই তাদের সাহায্য করেন ও ফরিয়াদ শোনেন ৷ আল্লাহর সর্বভৌম কর্তৃত্বের এসব কাজকে তোমরা নিজেরাও আল্লাহর কাজ বলে মনে করো , এসব কাজে আর কারো সামন্যতম কোন অংশ নেই৷
তৃতীয়ত , তারা একথাও জিজ্ঞেস করেছিল , তিনি কিসের তৈরি ? তাঁর বংশধারা কি ? তিনি কোন প্রজাতির অন্তরভুক্ত ? দুনিয়ার উত্তারাধিকার তিনি কার কাছ থেকে পেয়েছেন ? এবং তার পর কে এর উত্তরাধিকারী হবে ? আল্লাহ তাদের এ সমস্ত প্রশ্নের জবাব একটিমাত্র " আহাদ " শব্দের মাধ্যমে দিয়েছেন ৷ এর অর্থ হচ্ছে : (১) তিনি এক আল্লাহ চিরকাল আছেন এবং চিরকাল থাকবেন৷ তাঁর আগে কেউ আল্লাহ ছিল না এবং তাঁর পরেও কেউ আল্লাহ হবে না৷ (২) আল্লাহর এমন কোন প্রজাতি নেই , যার সদস্য তিনি হতে পারেন৷ বরং তিনি একাই আল্লাহ এবং তাঁর সমগোত্রীয় ও সমজাতীয় কেউ নেই৷(৩) তাঁর সত্তা নিছক ( আরবী -------) এক নয় বরং ( আরবী ---) একক , যেখানে কোন দিক দিয়ে একাধিক্যের সামান্যতম স্পর্শও নেই৷ তিনি বিভিন্ন উপাদানে গঠিত কোন সত্তা নন৷ তাঁর সত্তাকে দ্বিখণ্ডিত করা যেতে পারে না৷ তার কোন আকার ও রূপ নেই৷ তা কোন স্থানের গণ্ডীতে আবদ্ধ নয় এবং তার মধ্যে জিনিস আবদ্ধ হতে পারে না৷ তাঁর কোন বর্ণ নেই৷ কোন অংগ - প্রত্যংগ নেই৷ কোন দিক নেই ৷ তাঁর মধ্যে কোন প্রকার পরিবর্তন - বিবর্তন ঘটে না৷ সকল প্রকার ধরন ও প্রকরণ মুক্ত ও বিবর্জিত তিনি একমাত্র সত্তা , যা সবদিক দিয়েই আহাদ বা একক ৷ ( এপর্যায়ে একথাটি ভালোভাবে ব্যবহার করা হয় যেমনভাবে আমাদের ভাষায় আমরা " এক " শব্দটিকে ব্যবহার করে থাকি৷ বিপুল সংখ্যা সম্বলিত কোন সমষ্টিকেও তার সামগ্রিক সত্তাকে সামনে রেখে " ওয়াহেদ" বা " এক" বলা হয়৷ যেমন এক ব্যক্তি ,এক জাতি , এক দেশ , এক পৃথিবী , এমন কি এক বিশ্ব - জাহানও ৷ আবার কোন সমষ্টির প্রত্যেক অংশকেও আলাদা আলাদাভাবেও " এক" - ই বলা হয়৷ কিন্তু " আহাদ " বা একক শব্দটি আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য ব্যবহার করা হয় না৷ এ জন্য কুরআন মজীদে যেখানেই আল্লাহর জন্য ওয়াহেদ ( এক) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেই বলা হয়েছে : " ইলাহুন ওয়াহেদ " এক মাবুদ বা " আল্লাহুল ওয়াহেদুল কাহহার " এক আল্লাহই সবাইকে বিজিত ও পদানত করে রাখেন ৷ কোথাও নিছক " ওয়াহেদ " বলা হয়নি৷ কারণ যেসব জিনিসের মধ্যে বিপুল ও বিশাল সমষ্টি রয়েছে তাদের জন্যও এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে৷ বিপরীত পক্ষে আহাদ শব্দিট একমাত্র আল্লাহর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে৷ কারণ আল্লাহই একমাত্র সত্তা ও অস্তিত্ব যার মধ্যে কোন প্রকার একাধিক্য নেই৷ তাঁর একক সত্তা সবদিক দিয়েই পূর্ণাংগ ৷

৪ . মূলে " সামাদ " শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ এ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ( আরবী -------) ধাতু থেকে ৷ আরবী ভাষায় এ ধাতুটি থেকে যতগুলো শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সেগুলের ওপর নজর বুলালে এ শব্দটির অর্থের ব্যাপকতা জানা যায়৷ যেমন : (আরবী---------------) মনস্থ করা , ইচ্ছা করা ৷ বিপুলায়তন বিশিষ্ট উন্নত স্থান এবং বিপুল ঘনত্ব বিশিষ্ট উন্নত মর্যাদা ৷ উচ্চ সমতল ছাদ৷ যুদ্ধে যে ব্যক্তি ক্ষুধার্থ ও পিপাসার্থ হয় না৷ প্রয়োজনের সময যে সরদারের শরাণাপন্ন হতে হয়৷
আরবী : প্রত্যেক জিনিসের উঁচু অংশ ৷ যে ব্যক্তির ওপরে আর কেউ নেই ৷ যে নেতার আনুগত্য করা হয় এবং তার সাহায্য ছাড়া কোন বিষয়ের ফায়সালা করা হয় না৷ অভাবীরা যে নেতার শরণাপন্ন হয়৷ চিরন্তন উন্নত মর্যাদা ৷এমন নিবিড় ও নিচ্ছিদ্র যার মধ্যে কোন ছিদ্র ,শূন্যতা ও ফাঁকা অংশ নেই, যেখান থেকে কোন জিনিস বের হতে পারে না এবং কোন জিনিস যার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে না৷ যুদ্ধে যে ব্যক্তি ক্ষুধা - তৃষ্ণার শিকার হয় না৷
আরবী : জমাট জিনিস ,যার পেট নেই৷
আরবী : যে লক্ষের দিকে যেতে মনস্থ করা হয় ; যে কঠিন জিনিসের মধ্যে কোন দুর্বলতা নেই৷
আরবী : এমন গৃহ , প্রয়োজন ও অভাব পূরণের জন্য যার আশ্রয় নিতে হয়৷
আরবী : উঁচু ইমারত ৷
আরবী : ঐ লোকটির দিকে যাওয়ার সংকল্প করলো৷
আরবী : ব্যাপারটি তার হাতে সোপর্দ করলো; তার সামনে ব্যাপারটি পেশ করলো ;বিষয়টি তার ওপর আস্থা স্থাপন করলো৷ (সিহাহ ,কামূস ও লিসানুল আরব )
এসব শাব্দিক ও আভিধানিক অর্থের ভিত্তিতে " আল্লাহর সামাদ "আয়াতটিতে উল্লেখিত হয়েছে নিচে আমরা তা উল্লেখ করছি :
হযরত আলী (রা ) ইকরামা ও কা'ব আহবার বলেছেন : সামাদ হচ্ছেন এমন এক সত্তা যাঁর ওপরে আর কেউ নেই ৷
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা ) ও আবু ওয়ায়েল শাকীক ইবনে সালামাহ বলেছেন : তিনি এমন সরদার , নেতা ও সমাজপতি ,যাঁর নেতৃত্ব পূর্ণতা লাভ করেছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে৷
এ প্রসংগে ইবনে আব্বাসের দ্বিতীয় উক্তি হচ্ছে : লোকেরা কোন বিপদে - আপদে যার দিকে সাহায্য লাভের জন্য এগিয়ে যায় ,তিনি সামাদ৷ তাঁর আর একটি উক্তি হচ্ছে : যে সরদার তা নেতৃত্ব , মর্যাদা , শ্রেষ্ঠত্ব ,ধৈর্য ,সংযম ,জ্ঞান,বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণাতায় পূর্ণতার অধিকারী তিনি সামাদ৷
হযরত আবু হুরাইরা (রা ) বলেছেন : যিনি কারো ওপর নির্ভরশীল নন ,সবাই তাঁর ওপর নির্ভরশীল ,তিনিই সামাদ ৷
ইকরামার আর একটি বক্তব্য হচ্ছে : যার মধ্য থেকে কোন জিনিস কোনদিন বের হয়নি এবং বের হয়ও না আর যে পানাহার করে না , সে -ই সামাদ৷ এরই সমার্থবোধক উক্তি সা'বী ও মুহাম্মাদ ইবনে কা'ব আল কুরাযী থেকেও উদ্ধৃত হয়েছে৷
সুদ্দী বলেছেন : আকাংখিত বস্তু লাভ করার জন্য লোকেরা যার কাছে যায় এবং বিপদে সাহায্য লাভের আশায় যার দিকে হাত বাড়ায়, তাকেই সামাদ বলে৷
সাঈদ আবনে জুবাইর বলেছেন : যে নিজের সকল গুণ ও কাজে পূর্ণতার অধিকারী হয়৷
রাবী ইবনে আনাস বলেছেন : যার ওপর কখনো বিপদ - আপদ আসে না ৷মুকাতেল ইবনে হাইয়ান বলেছেন :যিনি সকল প্রকার দোষ ত্রুটি মুক্ত ৷
ইবনে কাইসান বলেছেন : অন্য কেউ যার গুণাবলীর ধারক হয় না৷
হাসান বসরী ও কাতাদাহ বলেছেন : যে বিদ্যমান থাকে এবং যার বিনাশ নেই ৷ প্রায় এই একই ধরনের উক্তি করেছেন মুজাহিদ , মা'মার ও মুররাতুল হামদানী৷
মুররাতুল হামদানীয় আর একটি উক্ত হচ্ছে : যে নিজের অনুযায়ী ফায়সালা করে এবং যা ইচ্ছা তাই করে ; যার হুকুম ও ফায়সালা পূনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা কারো থাকে না৷
ইবরাহীম নাখয়ী বলেছেন : যার দিকে লোকেরা নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য এগিয়ে যায়৷
আবু বকর আমবায়ী বলেছেন : সামাদ এমন এক সরদারকে বলা হয়, যার ওপরে আর কোন সরদার নেই এবং লোকেরা নিজেদের বিভিন্ন বিষয়ে ও নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য যার শরণাপন্ন হয় ,অভিধানবিদদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোন মতবিরোধ নেই ৷আয যুজাজের বক্তব্য প্রায় এর কাছাকাছি৷ তিনি বলেছেন : যার ওপর এসে নেতৃত্ব খতম হয়ে গেছে এবং নিজের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য প্রত্যেকে যার শরণাপন্ন হয়, তাকেই বলা হয় সামাদ৷
এখন চিন্তা করুন , প্রথম বাক্যে "আল্লাহু আহাদ " কেন বলা হয়েছে এভং এ বাক্যে "আল্লাহুস সামাদ "বলা হয়েছে কেন ? "আহাদ "সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলেছি,তা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট আর কারো জন্য এ শব্দটি আদৌ ব্যবহৃত হয় না৷তাই এখানে "আহাদুন " শব্দটি অনির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে৷ অন্যদিকে "সামাদ "শব্দটি অন্যান্য সৃষ্টির জন্যও ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ তাই "আল্লাহু সামাদুন "না বলে "আল্লাহুস সামাদ "বলা হয়েছে৷এর মানে হচ্ছে আসল ও প্রকৃত সামাদ হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ ৷সৃষ্টি যদি কোন দিক দিয়ে সামাদ হয়ে থাকে তাহলে অন্য দিক দিয়ে তা সামাদ নয়৷কারণ তা অবিনশ্বর নয় - একদিন তার বিনাশ হবে৷ তাকে বিশ্লেষণ ও বিভক্ত করা যায়৷তা বিভিন্ন উপাদান সহযোগে গঠিত৷ যে কোন সময় তার উপাদারগুলো আলাদা হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ কোন কোন সৃষ্টি তার মুখাপেক্ষী হলেও সে নিজেও আবার কারো মুখাপেক্ষী ৷তার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আপেক্ষিক, নিরংকৃশ নয়৷কারো তুলনায় সে শ্রেষ্ঠতম হলেও তার তুলনায় আবার অন্য কেউ আছে শ্রেষ্ঠতম ৷ কিছু সৃষ্টির কিছু প্রয়োজন সে পূর্ণ করতে পারে ,কিন্তু সবার সমস্ত প্রয়োজন পূর্ণ করার ক্ষমতা কোন সৃষ্টির নেই৷বিপরীত পক্ষে আল্লাহর সামাদ হবার গুণ অর্থাৎ তাঁর মুখাপেক্ষীহীনতার গুণ সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ৷ সারা দুনিয়া তাঁর মুখাপেক্ষী তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন৷ দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিস নিজের অস্তিত্ব স্থায়ীত্ব এবং প্রয়োজন ও অভাব পূরণের জন্য সচেতন ও অবচেতনভাবে তাঁরই শরণাপন্ন হয়৷ তিনিই তাদের সবার প্রয়োজন পূর্ণ করেন ৷ তিনি অমর , অজয়,অক্ষম , তিনি রিযিক দেন - নেন না৷ তিনি একক - যৌগিক ও মিশ্র নন৷ কাজেই বিভক্তি ও বিশ্লেষণযোগ্য নন৷ সমগ্র বিশ্ব - জাহানের ওপর তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত৷ তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ৷ তাই তিনি "সামাদ" নন, এবং "আসসামাদ ৷" অর্থাৎ তিনিই একমাত্র সত্তা যিনি মূলত সামাদ তথা অমুখাপেক্ষিতার গুণাবলীর সাথে পুরোপুরি সংযুক্ত ৷
আবার যেহেতু তিনি " আসসামাদ "তাই তাঁর একাকী ও স্বজনবিহীন হওয়া অপরির্হায৷ কারণ এ ধরনের সত্তা একজনই হতে পারেন ,যিনি কারো কাছে নিজের অভাব পূরণের জন্য হাত পাতেন না ,বরং সবাই নিজেদের অভাব পূরণের জন্য তাঁর মুখাপেক্ষী হয়৷দুই বা তার চেয়ে বেশী সত্তা সবার প্রতি অমুখাপেক্ষী ও অনির্ভরশীল এবং সবার প্রয়োজন পূরণকারী হতে পারে না৷ তাছাড়া তাঁর "আসসামাদ " হবার কারণে তাঁর একক মাবুদ হবার ব্যাপারটিও অপরিহার্য হয়ে পড়ে৷কারণ মানুষ যার মুখাপেক্ষী হয় তারই ইবাদাত করে৷ আবার তিনি ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই , " আসসামাদ " হবার কারণে এটাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে৷ কারণ , যে প্রয়োজন পূরণ করার ক্ষমতা ও সামর্থই রাখে না , কোন সচেতন ব্যক্তি তার ইবাদাত করতে পারে না৷

৫ . মুশরিকরা প্রতি যুগে খোদায়ীর এ ধারণা পোষণ করে এসেছে যে , মানুষের মতো খোদাদের ও একটি জাতি বা শ্রেণী আছে৷ তার সদস্য সংখ্যাও অনেক৷ তাদের মধ্যে বিয়ে - শাদী এবং বংশ বিস্তারের কাজও চলে৷ তারা আল্লাহর রাব্বুল আলামীনকেও এ জাহেলী ধরণা মুক্ত রাখেনি৷ তাঁর জন্য সন্তান- সন্ততিও ঠিক করে নিয়েছে৷ তাই কুরআন মজীদে আরববাসীদের আকীদা বর্ণনা প্রসংগে বলা হয়েছে , তারা ফেরেশতাদেরকে মহান আল্লাহর কন্যা গণ্য করতো৷ তাদের জাহেলী চিন্তা নবীগণের উম্মাতদেরকেও সংরক্ষিত রাখেনি৷ তাদের মধ্যে নিজেদের সৎ ও শ্রেষ্ট ব্যক্তিকে আল্লাহর পুত্র গণ্য করার আকীদা জন্ম নেয়৷ এ বিভিন্ন ধরনের আল্পনিক চিন্তা - বিশ্বাসের মধ্যে দুই ধরনের চিন্তা সবসময় মিশ্রিত হতে থেকেছে৷ কিছু লোক মনে করেছে , যাদেরকে তারা আল্লাহর সন্তান গণ্য করছে তারা সেই মহান পবিত্র সত্তার ঔরসজাত সন্তান৷ আবার কেউ কেউ দাবী করেছে , যাকে তারা আল্লাহর সন্তান বলছে , আল্লাহ তাকে নিজের পালকপুত্র বানিয়েছেন৷ যদিও তাদের কেউ কাউকে ( মাআ'যাল্লাহ ) আল্লাহর পিতা গণ্য করার সাহস করেনি৷ কিন্তু যখন কোন সত্তা সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে , তিনি সন্তান উৎপাদন ও বংশ বিস্তারের দায়িত্বমুক্ত নন এবং তাঁর সম্পর্কে ধারণা করা হয় , তিনি মানুষ জাতীয় এক ধরনের অস্তিত্ব , তাঁর ঔরসে সন্তান জন্মলাভ করে এবং অপুত্রক হলে তার কাউকে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজন দেখা দেয় , তখন মানুষের মন তাঁকেও কারো সন্তান মনে করার ধারণা মুক্ত থাকতে পারে না৷ এ কারণে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল , আল্লাহর বংশধারা কি ? দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল , কার কাছ থেকে তিনি দুনিয়ার উত্তারাধিকার লাভ করেছেন এবং তাঁর পরে এর উত্তরাধিকারী হবে কে ?
এসব জাহেলী মূর্খতা প্রসূত ধারণা কল্পনা বিশ্লেষণ কররে দেখা যায় , এগুলোকে যদি নীতিগতভাবে মেনে নিতে হয় , তাহলে আরো কিছু জিনিসকেও মেনে নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে৷ যেমন :
এক : আল্লাহ এক নয় , বরং আল্লাহর কোন একটি জাতি ও গোষ্ঠী আছে ৷ তাদের সদস্যরা আল্লাহর গুণাবলী , কার্যকলাপ ও কর্তৃত্ব - ক্ষমতায় তাঁর সাথে শরীক৷ আল্লাহর কেবলমাত্র ঔরসজাত সন্তান ধারণা করে নিলে এ বিষয়টি অপরিহার্য হয় না , বরং কাউকে পালকপুত্র হিসেবে ধারণা করে নিলেও এটি অপরিহার্য হয়৷ কেননা কারো পালকপুত্র অবশ্যি তারই সমজাতীয় ও সমগোত্রীয়ই হতে পারে৷ আর ( মা' আযাল্লাহ ) যখন সে আল্লাহর সমজাতীয় ও সমগোত্রীয় হয় , তখনই সে আল্লাহর গুণাবরী সম্পন্নও হবে , একথা অস্বীকার করা যেতে পারে না৷
দুই : পুরুষ ও নারীর মিলন ছাড়া কোন সন্তারে ধরণা ও কল্পনাপ করা যেতে পারে না৷ বাপ ও মায়ের শরীর থেকে কোন জিনিস বের হয়ে সন্তানের রূপ লাভ করে ---- সন্তান বলতে একথাই বুঝায়৷ কাজেই এ ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তান ধারণা করার ফলে ( নাউযুবিল্লাহ ) তাঁর একটি বস্তুগত ও শারীরিক অস্তিত্ব , তাঁর সমজাতীয় কোন স্ত্রীর অস্তিত্ব এবং তার শরীর থেকে কোন বস্তু বের হওয়াও অপরিহার্য হয়ে পড়ে৷
তিন : সন্তান উৎপাদন ও বংশধারা চালাবার কথা যেখানে আসে সেখানে এর মূল কারণ হয় এই যে , ব্যক্তিরা হয় মরণশীল এবং তাদের জাতির ও গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাদের সন্তান উৎপাদন অপরিহার্য হয়ে পড়ে৷ কারণ , এ সন্তানদের সাহায্যেই তাদের বংশধারা অব্যাহত থাকবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাবে৷ কাজেই আল্লাহর সন্তান আছে বলে মনে করলে ( নাউযুবিল্লাহ ) তিনি নিজে যে মরণশীল এবং তাঁর বংশ ও তাঁর নিজের সত্তা কোনটিই চিরন্তন নয় একথা মেনে নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে৷ তাছাড়া সমস্ত মরণশীল ব্যক্তির মতো ( নাউযুবিল্লাহ ) আল্লাহরও কোন শুরু ও শেষ আছে , একথাও মেনে নেয়া অপরিহার্য হয়ে যায়৷ কারণ , সন্তান উৎপাদন ও বংশ বিস্তারের ওপর যেসব জাতি ও গোত্র নির্ভরশীল হয়ে পড়ে , তাদের ব্যক্তিবর্গ অনাদি - অনন্তকালীন জীবনের অধিকারী হয় না৷
চার : কারো পালকপুত্র বলবার উদ্দেশ্য এ হয় যে , একজন সন্তানহীন ব্যক্তি তার নিজের জীবনে কারো সাহায্যের এবং নিজের মৃত্যুর পরা কোন উত্তারাধিকারের প্রয়োজন বোধ করে৷ কাজেই আল্লাহ কাউকে নিজের পুত্র বানিয়েছেন একথা মনে করা হলে সেই পবিত্র সত্তার সাথে এমন সব দুর্বলতা সংশ্লিষ্ট করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে , যেগুলো মরণশীল মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়৷
যদিও মহান আল্লাহকে " আহাদ" ও "আসসামাদ " বললে এসব উদ্ভট ধারণা - কল্পণার মূলে কুঠারঘাত করা হয় , তবুও এরপর " না তাঁর কোন সন্তান আছে , না তিনি কারো সন্তান " --- একথা বলায় এ ব্যাপারে আর কোন প্রকার সংশয় - সন্দেহের অবকাশই থাকে না৷ তারপর যেহেতু আল্লাহর মহান সত্তা সম্পর্কে এ ধরনের ধারণা- কল্পনা শিরকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর অন্তরভুক্ত , তাই মহান আল্লাহ শুধুমাত্র সূরা ইখলাসের এগুলোর দ্ব্যর্থহীন ও চূড়ান্ত প্রতিবাদ করেই ক্ষান্ত হননি , বরং বিভিন্ন জায়গায় এ বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন ৷ এভাবে লোকেরা সত্যকে পুরোপুরি বুঝতে সক্ষম হবে৷ দৃষ্টান্ত স্বরূপ নীচের আয়াতগুলো পর্যালোচনা করা যেতে পারে :
আরবী-------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"আল্লাহ -ই হচ্ছেন একমাত্র ইলাহ৷ কেউ তাঁর পুত্র হবে ,এ অবস্থা থেকে তিনি মুক্ত পাক - পবিত্র ৷ যা কিছু আকাশসমূহের মধ্যে এবং যা কিছু যমীনের মধ্যে আছে, সবই তার মালিকানাধীন ৷" ( আন নিসা ,১৭১ )
আরবী -----------------------------------------------------------------------------
"জেনে রাখো , এরা যে বলছে আল্লাহর সন্তান আছে , এটা এদের নিজেদের মনগড়া কথা ৷ আসলে এটি একটি ডাহা মিথ্যা কথা৷" (আস সাফফাত ,১৫১ - ১৫২ )
আরবী --------------------------------------------------------------------------------------
"তারা আল্লাহ ও ফেরেশতাদের মধ্যে বংশীয় সম্পর্ক তৈরি করে নিয়েছে অথচ ফেরেশতারা ভালো করেই জানে এরা ( অপরাধী হিসেবে ) উপস্থাপিত হবে৷" (আস সাফফাত,১৫৮ )
আরবী --------------------------------------------------------------------------------------
"লোকেরা তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে তাঁর অংশ বানিয়ে ফেলেছে৷ আসলে মানুষ স্পষ্ট অকৃতজ্ঞ৷" (আয্‌ যুখরুফ ,১৫ )
আরবী -------------------------------------------------------------------------------------
"আর লোকেরা জিনদেরকে আল্লাহর শরীক বানিয়েছে৷ অথচ তিনি তাদের স্রষ্টা ৷আর তারা না জেনে বুঝে তাঁর জন্য পুত্র- কন্যা বানিয়ে নিয়েছে৷ অথচ তারা যে সমস্ত কথা বলে তা থেকে তিনি মুক্ত ও পবিত্র এবং তার উর্ধে তিনি অবস্থান করছেন৷ তিনি তো আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা৷ তাঁর পুত্র কেমন করে হতে পারে যখন তাঁর কোন সঙ্গিনী নেই ? তিনি প্রত্যেকটি জিনিস সৃষ্টি করেছেন ৷" ( আল আনআম , ১০০ - ১০১)
আরবী -----------------------------------------------------------------------
" আর তারা বললো , দয়াময় আল্লাহ কাউকে পুত্র বানিয়েছেন ৷ তিনি পাক - পবিত্র ৷ বরং ( যাদেরকে এরা তাঁর সন্তান বলছে) তারা এমন সব বান্দা যাদেরকে মর্যাদা দান করা হয়েছে৷ " ( আল আম্বিয়া , ২৬ )
আরবী -----------------------------------------------------------------------
" লোকেরা বলে দিয়েছে , আল্লাহ কাউকে পুত্র বানিয়েছেন আল্লাহ পাক - পবিত্র ! তিনি তো অমুখাপেক্ষী ৷ আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তাঁর মালিকানাধীন ৷ এ বক্তব্যের সপক্ষে তোমাদের প্রমাণ কি ? তোমরা কি আল্লাহর সম্পর্কে এমন সব কথা বলছো , যা তোমরা জানো না ? ( ইউনুস , ৬৮ )
আরবী ------------------------------------------------------------------------
" আর হে নবী ! বলে দাও , সেই আল্লাহর জন্য সব প্রশংসা যিনি না কাউকে পুত্র বানিয়েছেন , না বাদশাহীতে কেউ তাঁর শরীক আর না তিনি অক্ষম , যার ফলে কেউ হবে তাঁর পৃষ্টপোষক ৷ (বনী ইসরাঈল, ১১১ )
আরবী -----------------------------------------------------------------------
" আল্লাহ কাউকে পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেননি এবং তাঁর সাথে দ্বিতীয় কোন ইলাহও নেই৷ " ( আল মু'মিনূন, ৯১)
যারা আল্লাহর জন্য ঔরসজাত সন্তান অথবা পালকপুত্র গ্রহণ করার কথা বলে , এ আয়াতগুলোতে সর্বতোভাবে তাদের এহেন আকীদা - বিশ্বাসের প্রতিবাদ করা হয়েছে৷ এ আয়াতগুলো এবং এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অন্য যে সমস্ত আয়াত কুরআনের বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায় , সেগুলো সূরা ইখলাসের অতি চমৎকার ব্যাখ্যা ৷

৬ . মূলে বলা হয়েছে কুফূ ( আরবী --------) এর মানে হচ্ছে , নজীর , সদৃশ , সমান , সমমর্যাদা সম্পন্ন ও সমতুল্য৷ বিয়ের ব্যাপারে আমাদের দেশে কুফূ শব্দের ব্যবহার আছে৷ এ ক্ষেত্রে এর অর্থ হয় , সামাজিক মর্যাদার দিক দিয়ে ছেলের ও মেয়ের সমান পর্যায়ে অবস্থান করা ৷ কাজেই এখানে এ আয়াতের মানে হচ্ছে : সারা বিশ্ব - জাহানের আল্লাহর সমক্ষ অথবা তাঁর সমমর্যাদ সম্পন্ন কিংবা নিজের , কর্ম ও ক্ষমতার ব্যাপারে তাঁর সমান পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে এমন কেউ কোন দিন ছিল না এবং কোন দিন হতে ও পারবে না৷

আল লাহাব

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ
১) ভেঙে গেছে আবু লাহাবের হাত এবং ব্যর্থ হয়েছে সে ৷
مَا أَغْنَىٰ عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ
২) তার ধন-সম্পদ এবং যা কিছু সে উপার্জন করেছে তা তার কোন কাজে লাগেনি৷
سَيَصْلَىٰ نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ
৩) অবশ্যই সেই লেলিহান আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে৷
﴿وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ﴾
৪) এবং ( তার সাথে ) তার স্ত্রীও ,  লাগানো ভাঙানো চোগলখুরী করে বেড়ানো যার কাজ ,
﴿فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ﴾
৫) তার গলায় থাকবে খেজুর ডালের আঁশের পাকানো শক্ত রশি৷
____________________________________________________
১ . আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল উযযা ৷ তাকে আবু লাহাব বলে ডাকার কারণ , তার গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল সাদা লালে মেশানো৷ লাহাব বলা হয় আগুনের শিখাকে৷ কাজেই আবু লাহাবের মানে হচ্ছে আগুন বরণ মুখ৷ এখানে তার আসল নামের পরিবর্তে ডাক নামে উল্লেখ করার কয়েকটি কারণ রয়েছে৷ এর একটি কারণ হচ্ছে এই যে , মূল নামের পরিবর্তে ডাকনামেই সে বেশী পরিচিত ছিল৷ দ্বিতীয় কারণ , তার আবদুল উযযা ( অর্থাৎ উযযার দাস ) নামটি ছিল একটি মুশরিকী নাম৷ কুরআনে তাকে এ নামে উল্লেখ করা পছন্দ করা হয়নি৷ তৃতীয় কারণ , এ সূরায় তার যে পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে তার সাথে তার এ ডাকনামই বেশী সম্পর্কিত ৷
আরবী ---------------------------------- এর অর্থ কোন কোন তাফসীরকার করেছেন , "ভেঙে যাক আবু লাহাবের হাত " এবং ( আরবী -------) শব্দের মানে করেছেন , " সে ধবংস হয়ে যাক " অথবা " সে ধবংস হয়ে গেছে৷ " কিন্তু আসলে এটা তার প্রতি কোন ধিক্কার নয়৷ বরং এটা একটা ভবিষ্যদ্বাণী৷ এখানে ভবিষ্যতে যে ঘটনাটি ঘটবে তাকে অতীতে কালের অর্থ প্রকাশক শব্দের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে৷ এর মানে , তার হওয়াটা যেন এত বেশী নিশ্চিত যেমন তা হয়ে গেছে ৷ আর আসলে শেষ পর্যন্ত তাই হলো যা এ সূরায় কয়েক বছর আগে বর্ণনা করা হয়েছিল৷ হাত ভেঙে যাওয়ার মানে শরীরের একটি অংগ যে হাত সেটি ভেঙে যাওয়া নয়৷ বরং কোন ব্যক্তি যে উদ্দেশ্য সম্পন্ন করার জন্য তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে তাতে পুরোপুরি ও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়ে যাওয়াই এখানে বুঝানো হয়েছে ৷ আর আবু লাহাব রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করা জন্য যথার্থই নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল৷ কিন্তু এ সূরাটি নাযিল হবার মাত্র সাত আট বছর পরেই বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়৷ এ যুদ্ধে কুরাইশদের অধিকাংশ বড় বড় সরদার নিহত হয়৷ তারা সবাই ইসলাম বিরোধিতা ও ইসলামের প্রতি শত্রুতার ক্ষেত্রে আবু লাহাবের সহযোগী ছিল৷ এ পরাজয়ের খবর মক্কায় পৌঁছার পর সে এত বেশী মর্মাহত হয় যে , এরপর সে সাত দিনের বেশী জীবিত থাকতে পারেনি৷ তার মৃত্যুর ছিল বড়ই ভয়াবহ ও শিক্ষাপ্রদ৷ তার শরীরে সাংঘাতিক ধরনের ফুসকুড়ি (Malignant pustule) দেখা দেয়৷ রোগ সংক্রমণের ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়৷ মরার পরও তিন দিন পর্যন্ত তার ধারে কাছে কেউ ঘেঁসেনি৷ ফলে তার লাশে পচন ধরে৷ চারদিকে র্দুগন্ধ ছড়াতে থাকে ৷ শেষে লোকেরা তার ছেলেদেরকে ধিক্কার দিতে থাকে৷ একটি বর্ণনা অনুসারে তখন তারা মজুরীর বিনিময়ে তার লাশ দাফন করার জন্য কয়েকজন হাবশীকে নিয়োগ করে এবং তারা তার লাশ দাফন করে৷ অন্য এক বর্ণনা অনুসারে , তারা গর্ত খুঁড়ে লম্বা লাঠি দিয়ে তার লাশ তার মধ্যে ফেলে দেয় এবং ওপর থেকে তার ওপর মাটি চাপা দেয়৷ যে দীনের অগ্রগতির পথ রোধ করার জন্য সে তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল তার সন্তানদের সেই দীন গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে তার আরো বেশী ও পূর্ণ পরাজয় সম্পন্ন হয়৷ সর্বপ্রথম তার মেয়ে দাররা হিজরাত করে মক্কা থেকে মদীনায় চলে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করেন৷ আর মক্কা বিজয়ের পর তার দুই ছেলে উতবা ও মু'আত্তাব হযরত আব্বাসের (রা) মধ্যস্থাতায় রসূলুল্লাহর (সা) সামনে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাঁর হাতে বাইআত করেন৷

২. আবু লাহাব ছিল হাড়কৃপণ ও অর্থলোলুপ৷ ইবনে আসীরর বর্ণনা মতে , জাহেলী যুগে একবার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে , সে কা 'বা শরীফের কোষাগার থেকে দু'টি সোনার হরিণ চুরি করে নিয়েছে৷ যদিও পরবর্তী পর্যায়ে সেই হরিণ দু'টি অন্য একজনের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় তবুও তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনার ফলে তার সম্পর্কে মক্কার লোকদের মনোভাব উপলব্ধি করা যায়৷ তার ধনাঢ্যতা সম্পর্কে কাজী রশীদ ইবনে যুবাইর তাঁর " আযযাখায়ের ওয়াত'তুহাফ " ( আরবী------------------) গ্রন্থে লিখেছেন : কুরাইশদের মধ্যে যে চারজন লোক এক কিনতার ( এক কিনতার = দুশো আওকিয়া আর এক আওকিয়া = সোয়া তিন তোলা কাজেই এক কিনতার সমান ৮০ তোলার সেরের ওজনে ৮ সের ১০ তোলা ) সোনার মালিক ছিল আবু লাহাব তাদের একজন ৷ তার অর্থ লোলুপতা কি পরিমাণ ছিল বদর যুদ্ধের সময়ের ঘটনা থেকে তা আন্দাজ করা যেতে পারে৷ এ যুদ্ধে তার ধর্মের ভাগ্যের ফায়সালা হতে যাচ্ছিল ৷ কুরাইশদের সব সরদার এ যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য রওয়ানা হয়৷ কিন্তু আবু লাহাব নিজে না গিয়ে নিজের পক্ষ থেকে আস ইবনে হিশামকে পাঠায়৷ তাকে বলে দেয় , তার কাছে সে যে চার হাজার দিরহাম পায় এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে এর বদলে তার সেই ঋণ পরিশোধ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে৷ এভাবে সে নিজের ঋণ আদায় করার একটা কৌশল বের করে নেয়৷ কারণ আস দেওলিয়া হয়ে গিয়েছিল৷ ঋণ পরিশোধের কোন ক্ষমতাই তার ছিল না৷
কোন কোন তাফসীরকার ( আরবী -------------------------------) শব্দটিকে উপার্জন অর্থে নিয়েছেন৷ অর্থাৎ নিজের অর্থ থেকে সে যে মুনাফা অর্জন করেছে তা তার উপার্জন ৷ আবার অন্য কয়েকজন তাফসীরকার এর অর্থ নিয়েছেন সন্তান- সন্ততি৷ কারণ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন , সন্তানরা মানুষের উপার্জন ( আবু দাউদ ও ইবনে আবী হাতেম)৷ এ দু'টি অর্থই আবু লাহাবের পরিণতির সাথে সম্পর্কিত৷ কারণ সে মারাত্মক ফুসকুড়ি রোগে আক্রান্ত হলে তার সম্পদ তার কোন কাজে লাগেনি এবং তার সন্তানরা ও তাকে অসহায়ভাবে মৃত্যু বরন করার জন্য ফেলে রেখে দিয়েছিল৷ তার ছেলেরা তার লাশটি মর্যাদা সহকারে কাঁধে উঠাতেও চাইল না৷ এভাবে এ সূরায় আবু লাহাব সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তা সত্য হতে দেখলো ৷

৩. আবু লাহাবের স্ত্রীর নাম ছিল " আরদা " ৷ " উম্মে জামীল " ছিল তার ডাক নাম৷ সে ছিল আবু সুফিয়ানের বোন৷ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে শত্রুতার ব্যাপারে সে তার স্বামী আবু লাহাবের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না৷ হযরত আবু বকরের (রা) মেয়ে হযরত আসমা (রা) বর্ণনা করেছেন : এ সূরাটি নাযিল হবার পর উম্মে জামীল যখন এটি শুনলো , সে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খোঁজে বের হলো৷ তার হাতের মুঠোয় পাথর ভরা ছিল রসূলুল্লাহকে (সা) গালাগালি করতে করতে নিজের রচিত কিছু কবিতা পড়ে চলছিল৷ এ অবস্থায় সে কা'বা ঘরে পৌঁছে গেলো৷ সেখানে রসূলুল্লাহ (সা) হযরত আবু বকরের (রা) সাথে বসেছিলেন৷ হযরত আবু বকর বললেন , হে আল্লাহর রসূল ! দেখুন সে আসছে৷ আমার আশংকা হচ্ছে , সে আপনাকে দেখে কিছু অভদ্র আচরণ করবে৷ তিনি বললেন , সে আমাকে দেখতে পাবে না৷ বাস্তবে হলোও তাই৷ তাঁর উপস্থিতি সত্ত্বেও সে তাঁকে দেখতে পেলো না৷ সে আবু বকরকে (রা) জিজ্ঞেস করলো , শুনলাম তোমার সাথী আমার নিন্দা করেছে৷ হযরত আবু বকর (রা) জবাব দিলেন : এ ঘরের রবের কসম , তিনি তো তোমার কোন নিন্দা করেননি৷ একথা শুনে সে ফিরে গেলো --- ( ইবনে আবু হাতেম , সীরাতে ইবন হিশাম ৷ বাযযারও প্রায় একই ধরনের একটি রেওয়ায়াত হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন )৷ হযরত আবু বকরের (রা) এ জবাবের অর্থ ছিল , নিন্দা তো আল্লাহ করেছেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেননি৷

৪. মূল শব্দ হচ্ছে ( আবরী ---------------) এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে , " কাঠ বহনকারিনী ৷" মুফাসসিরগণ এর বহু বর্ণনা করেছেন৷ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ইবনে যায়েদ , যাহহাক ও রাবী ইবনে আনাস বলেন : সে রাতের বেলা কাঁটা গাছের ডালপালা এনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরজায় ফেলে রাখতো৷ তাই তাকে কাঠ বহনকারিনী বলা হয়েছে৷ কাতাদাহ , ইকরামা , হাসান বরসী , মুজাহিদ ও সুফিয়ান সওরী বলেন : সে লোকদের মধ্যে ফিতনা ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য চোগলখুরী করে বেড়াতো৷ তাই আরবী প্রবাদ অনুযায়ী তাকে কাঠ বহনকারিনী বলা হয়েছে৷ কারণ যারা এর কথা ওর কাছে বলে এবং লাগানো ভাঙানোর কাজ করে ফিতনা - ফাসাদের আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করে আরবরা তাদেরকে কাঠ বহনকারিনী বলে থাকে৷ এ প্রবাদ অনুযায়ী " হাম্মালাতাল হাতাব " শব্দের সঠিক অনুবাদ হচ্ছে , " যে লাগানো ভাঙানোর কাজ করে ৷" সাঈদ ইবনে জুবাইর বলেন : যে ব্যক্তি নিজের পিঠে গোনাহের বোঝা বহন করে আরবী প্রবাদ অনুসারে তার সম্পর্কে বলা হয় , (আরবী ---------------------------------) ( অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি নিজের পিঠে কাঠ বহন করছে)৷ কাজেই হাম্মালাতাল হাতাব ( আবরী -----) মানে হচ্ছে , " গোনাহের বোঝা বহনকারিনী ৷" মুফাসসিরগণ এর আরো একটি অর্থও বর্ণনা করেছেন৷ সেটি হচ্ছে , আখেরাতে তার এ অবস্থা হবে৷ অর্থাৎ সেখানে যে আগুনে আবু লাহাব পুড়তে থাকবে তাতে সে ( উম্মে জামীল) কাঠ বহন করে এনে ফেলতে থাকবে৷

৫. তার গলার জন্য জীদ ( আরবী -----) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ আরবী ভাষায় যে গলায় অলংকার পরানো হয়েছে তাকে জীদ বলা হয়৷ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব , হাসান বসরী ও কাতাদা বলেন : এ হার বিক্রি করে আমি এর মূল্য বাবদ পাওয়া সমস্ত অর্থ মুহাম্মাদের ( সা) বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কাজ করার জন্য ব্যয় করবো৷ এ কারণে জীদ শব্দটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ব্যঙ্গার্থে৷ অর্থাৎ এ অলংকার পরিহিত সুসজ্জিত গলায় , যেখানে পরিহিত হার নিয়ে সে গর্ব করে বেড়ায় , কিয়ামতের দিন সেখানে রশি বাঁধা হবে৷ এটা ঠিক সমপর্যায়েরই ব্যাঙ্গাত্মক বক্তব্য যেমন কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বলা হযেছে : ( আরবী -----------) " তাদেরকে যন্ত্রনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও৷" তার গলায় বাঁধা রশিটির জন্য ( আরবী --------) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ অর্থাৎ সে রশিটি হবে ' মাসাদ ' ধরনের ৷ অভিধানবিদ ও মুফাসসিরগণ এ শব্দটির বহু অর্থ বর্ণনা করেছেন৷ এ সম্পর্কিত একটি বক্তব্য হচ্ছে , খুব মজবুত করে পাকানো রশিকে মাসাদ বলা হয়৷ দ্বিতীয় বক্তব্য হচ্ছে , খেজুর গাছের ( ডালের ) ছাল থেকে তৈরি রশি মাসাদ নামে পরিচিত৷ এ সম্পর্কে তৃতীয় বক্তব্য হচ্ছে , এর মানে খেজুরের ডালের গোড়ার দিকের মোটা অংশ থেঁতলে যে সরু আঁশ পাওয়া যায় তা দিয়ে পাকানো রশি অথবা উটের চামড়া বা পশম দিয়ে তৈরি রশি৷ আর একটি বক্তব্য হচ্ছে , এর অর্থ লোহার তারের পাকানো রশি৷

আন নাসর

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ
১) যখন আল্লাহর সাহায্য এসে যায় এবং বিজয় লাভ হয়
وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا
২) আর ( হে নবী ! ) তুমি (যদি দেখ যে লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দীন গ্রহণ করছে
﴿فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ ۚ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا
৩) তখন তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও৷ অবশ্যি তিনি বড়ই তাওবা কবুলকারী৷
______________________________________

১ . বিজয় মানে কোন একটি যুদ্ধ বিজয় নয়৷ বরং এর মানে হচ্ছে এমন একটি চূড়ান্ত বিজয় যার পরে ইসলামের সাথে সংঘর্ষ করার মতো আর কোন শক্তির অস্তিত্ব দেশের বুকে থাকবে না এবং একথাও সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে , বর্তমানে আরবে এ দীনটিই প্রাধান্য বিস্তার করবে৷ কোন কোন মুফাসসির এখানে বিজয় মানে করেছেন মক্কা বিজয় ৷ কিন্তু মক্কা বিজয় হয়েছে ৮ হিজরীতে এবং এ সূরাটি নাযিল হয়েছে ১০ হিজরীর শেষের দিকে৷ ভূমিকায় আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) ও হযরত সারাআ বিনতে নাবহানের (রা) যে হদীস বর্ণনা করেছি তা থেকে একথাই জানা যায়৷ এ ছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) যে একে কুরআন মজীদের সর্বশেষ সূরা বলেছেন , তাঁর এ বক্তব্যেও এ তাফসীরের (রা) বিরুদ্ধে চলে যায়৷ কারণ বিজয়ের মানে যদি মক্কা বিজয় হয় তাহলে সমগ্র সূরা তাওবা মক্কা বিজয়ের পর নাযিল হয়৷ তাহলে আন নসর কেমন করে শেষ সূরা হতে পারে ? নিসন্দেহে মক্কা বিজয় এ দিক দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় ছিল যে , তারপর আরবের মুশরিকদের সাহস ও হিম্মত নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল ৷ কিন্তু এরপরও তাদের মধ্যে যথেষ্ট শক্তি - সামর্থ ছিল৷ এরপরই অনুষ্ঠিত হয়েছিল তায়েফ ও হুনায়েনের যুদ্ধ ৷ আরবে ইসলামের পূর্ণাংগ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে আরো প্রায় দু'বছর সময় লেগেছিল৷

২ . অর্থাৎ লোকদের একজন দু'জন করে ইসলাম গ্রহণ করার যুগ শেষ হয় যাবে ৷ তখন এমন এক যুগের সূচনা হবে যখন একটি গোত্রের সবাই এবং এক একটি বড় বড় এলাকার সমস্ত অধিবাসী কোন প্রকার যুদ্ধ - বিগ্রহ ও চাপ প্রয়োগ ছাড়াই স্বতষ্ফূর্তভাবে মুসলমান হয়ে যেতে থাকবে৷ নবম হিজরীর শুরু থেকে এ অবস্থার সূচনা হয়৷ এ কারণে এ বছরটিকে বলা হয় প্রতিনিধিদলের বছর ৷ এ বছর আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে একের পর এক প্রতিনিধি দল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে কাছে আসতে থাকে৷ তারা ইসলাম কবুল করে তাঁর মুবারক হাতে বাই'আত গ্রহণ করতে থাকে৷ এমনকি দশম হিজরীতে যখন তিনি বিদায় হজ্জ করার জন্য মক্কায় যান তখান সমগ্র আরব ভূমি ইসলামের ছাড়াতলে আশ্রয় নিয়েছিল এবং সারাদেশে কোথাও একজন মুশরিক ছিল না৷

৩ . হামদ মানে মহান আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগান করা এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাও ৷ আর তাসবীহ মানে আল্লাহকে পাক - পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন এবং দোষ- ত্রুটিমুক্ত গণ্য করা৷ এ প্রসংগে বলা হয়েছে , যখন তুমি তোমার রবের কুদরতের এ অভিব্যক্তি দেখবে তখন তাঁর হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পাঠ করবে৷ এখানে হামদ বলে একথা বুঝানো হয়েছে যে , এ মহান ও বিরাট সাফল্য সম্পর্কে তোমার মনে যেন কোন সময় নিন্দুমাত্রও ধারণা না জন্মায় যে , এসব তোমার নিজের কৃতিত্বের ফল৷ বরং একে পুরোপুরি ও সরাসরি মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও মেহেরবানী মনে করবে ৷ এ জন্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে৷ মনে ও মুখে একথা স্বীকার করবে যে , এ সাফল্যের জন্য সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য৷ আর তাসবীহ মানে হচ্ছে , আল্লাহর কালেমা বুলন্দ হওয়ার বিষয়টি তোমার প্রচেষ্টা ও সাধনার ওপর নির্ভরশীল ছিল ---- এ ধরনের ধারণা থেকে তাঁকে পাক ও মুক্ত গণ্য করবে৷ বিপরীত পক্ষে তোমার মন এ দৃঢ় বিশ্বাসে পরিপূর্ণ থাকবে যে , তোমার প্রচেষ্টা ও সাধনার সাফল্য আল্লাহর সাহায্য ও সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল৷ তিনি তাঁর যে বান্দার থেকে চান কাজ নিতে পারতেন৷ তবে তিনি তোমার খিদমত নিয়েছেন এবং তোমার সাহায্যে তাঁর দীনের ঝাণ্ডা বুলন্দ করেছেন , এটা তাঁর অনুগ্রহ ৷ এছাড়া তাসবীহ অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ পড়ার মধ্যে বিস্ময়ের ও একটি দিক রয়েছে ৷ কোন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলে মানুষ সুবহানাল্লাহ বলে৷ এর অর্থ হয় , আল্লাহর অসীম কুদরতে এহেন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে৷ নয়তো এমন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটাবার ক্ষমতা দুনিয়ার কোন শক্তির ছিল না৷

৪ . অর্থাৎ তোমার রবের কাছে দোয়া করো৷ তিনি তোমাকে যে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা করতে গিয়ে তোমার যে ভুল - ত্রুটি হয়েছে তা যেন তিনি মাফ করে দেন৷ ইসলাম বান্দাকে এ আদব শিষ্টাচার শিখিয়েছে৷ কোন মানুষের দ্বারা আল্লাহর দীনের যতবড় খিদমতই সম্পন্ন হোক না কেন , তাঁর পথে সে যতই ত্যাগ স্বীকার করুক না এবং তাঁর ইবাদাত ও বন্দেগী করার ব্যাপারে যতই প্রচেষ্টা ও সাধনা চালাক না কেন , তার মনে কখনো এ ধরনের চিন্তার উদয় হওয়া উচিত নয় যে , তার ওপর তার রবের যে হক ছিল তা সে পুরোপুরি আদায় করে দিয়েছে৷ বরং সবসময় তার মনে করা উচিত যে তার হক আদায় করার ব্যাপারে যেসব দোষ - ত্রুটি সে করেছে তা মাফ করে দিয়ে যেন তিনি তার এ নগণ্য খেদমত কবুল করে নেন৷ এ আদব ও শিষ্টাচার শেখানো হয়েছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ৷ অথচ তাঁর চেয়ে বেশী আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনাকারী আর কোন মানুষের কথা কল্পনাই করা যেতে পারে না৷ তাহলে এ ক্ষেত্রে অন্য কোন মানুষের পক্ষে তার নিজের আমলকে বড় মনে করার অবকাশ কোথায় ? আল্লাহর যে অধিকার তার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল তা সে আদায় করে দিয়েছে এ অহংকার মত্ত হওয়ার কোন সুযোগই কি তার থাকে ? কোন সৃষ্টি আল্লাহর হক আদায় করতে সক্ষম হবে , এ ক্ষমতাই তার নেই৷ মহান আল্লাহর এ ফরমান মুসলমানদের এ শিক্ষা দিয়ে আসছে যে , নিজের কোন ইবাদাত , আধ্যাত্মিক সাধনা ও দীনি খেদমতকে বড় জিনিস মনে না করে নিজের সমগ্র প্রাণশক্তি আল্লাহর পথে নিয়োজিত ও ব্যয় করার পরও আল্লাহর হক আদায় হয়নি বলে মনে করা উচিত ৷ এভাবে যখনই তারা কোন বিজয় লাভে সমর্থ হবে তখনই এ বিজয়কে নিজেদের কোন কৃতিত্বের নয় বরং মহান আল্লাহর অনুগ্রহের ফল মনে করবে৷ এ জন্য গর্ব ও অহংকারে মত্ত না হয়ে নিজেদের রবের সামনে দীনতার সাথে মাথা নত করে হামদ , সানা ও তাসবীহ পড়তে এবং তাওবা ও ইসতিগফার করতে থাকবে৷

আল কাফেরুন

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ
১) বলে দাও , হে কাফেররা !
لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ
২) আমি তাদের ইবাদাত করি না যাদের ইবাদাত তোমরা করো৷
وَلَا أَنتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ
৩) আর না তোমরা তার ইবাদাত করো যার ইবাদাত আমি করি না৷
وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَّا عَبَدتُّمْ
৪) আর না আমি তাদের ইবাদাত করবো যাদের ইবাদাত তোমরা করে আসছো৷
وَلَا أَنتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ
৫) আর না তোমরা তার ইবাদাত করবে যার ইবাদাত আমি করি ৷
لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ
৬) তোমাদের দীন তোমাদের জন্য এবং আমার দীন আমার জন্য ৷
___________________________________________________________________
১. এ আয়াতে কয়েকটি কথা বিশেষভাবে ভেবে দেখার মতো :
(ক) যদিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুকুম দেয়া হয়েছে , তুমি কাফেরদের পরিস্কার বলে দাও ৷ তবুও সামনের আলোচনা জানিয়ে দিচ্ছে , পরবর্তী আয়াতগুলোতে যেসব কথা বলা হযেছে প্রত্যেক মু'মিনের সে কথাগুলোই কাফেরদেরকে জানিয়ে দিতে হবে৷ এমনকি যে ব্যক্তি কুফরী থেকে তাওবা করে ঈমান এনেছে তার জন্যও কুফরী ধর্ম , তার পূজা - উপাসনা ও উপাস্যদের থেকে নিজের সম্পর্কহীনতা ও দায়মুক্তির কথা প্রকাশ করতে হবে৷ কাজেই ' কুল' বলে দাও৷ শব্দটির মাধ্যমে প্রধানত ও প্রথমত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে ৷ কিন্তু এ হুকুমটি বিশেষভাবে শুধু তাঁকেই করা হয়নি বরং তাঁর মাধ্যমে প্রত্যেক মু'মিনকে করা হয়েছে৷
(খ) এ আয়াতে প্রতিপক্ষকে যে " কাফের " বলে সম্বোধন করা হয়েছে , এটা তাদের জন্য কোন গালি নয়৷ বরং আরবী ভাষায় কাফের মানে অস্বীকারকারী ও অমান্যকারী (Unbeliever)৷ এর মোকাবিলায় ' মু'মিন ' শব্দটি বলা হয় , মেনে নেয়া ও স্বীকার করে নেয়া অর্থে (Believer) ৷ কাজেই আল্লাহর নির্দেশক্রমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ( হে কাফেররা ! ) বলার অর্থই হচ্ছে এই যে , " হে লোকেরা ! তোমরা যারা আমার রিসালাত ও আমার প্রদত্ত শিক্ষা মেনে নিতে অস্বীকার করছো৷ " অনুরূপভাবে একজন মু'মিন যখন একথা বলবে অর্থাৎ যখন সে বলবে , " হে কাফেররা ! " তখন কাফের বলতে তাদেরকে বুঝানো হবে যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান আনেনি৷
(গ) " হে কাফেররা !" বলা হয়েছে , " হে মুশরিকরা " বলা হয়নি৷ কাজেই এখানে কেবল মুশরিকদের উদ্দেশ্যেই বক্তব্য পেশ করা হয়নি বরং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যারা আল্লাহর রসূল এবং তিনি যে শিক্ষা ও হিদায়াত দিয়েছেন তাকে আল্লাহর শিক্ষা ও হিদায়াত বলে মেনে নেয় না , তারা ইহুদী খৃষ্টান ও অগ্নি উপাসক বা সারা দুনিয়ার কাফের , মুশরিক ও নাস্তিক যেই হোক না কেন , তাদের সবাইকে এখানে সম্বোধন করা হয়েছে৷ এ সম্বোধনকেই শুধুমাত্র কুরাইশ বা আরবের মুশরিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার কোন কারণ নেই৷
(ঘ) অস্বীকারকরীদেরকে 'হে কাফেররা ' বলে সম্বোধন করা ঠিক তেমনি যেমন আমরা কিছু লোককে সম্বোধন করি "ওহে শত্রুরা " বা " ওহে বিরোধীরা" বলে৷ এ ধরনের সম্বোধনের ক্ষেত্রে আসলে বিরোধী ব্যক্তিরা লক্ষ্য হয় না , লক্ষ হয় তাদের বিরোধিতা ও শত্রুতা ৷ আর এ সম্বোধন ততক্ষণের জন্য হয় যতক্ষণ তাদের মধ্যে এ গুণগুলো থাকে৷ যখন তাদের কেউ এ শত্রুতা ও বিরোধিতা পরিহার করে অথবা বন্ধু ও সহযোগী হয়ে যায় তখন সে আর এ সম্বোধনের লক্ষ থাকে না৷ অনুরূপভাবে যাদেরকে " হে কাফেররা " বলে সম্বোধন করা হয়েছে তারাও তাদের কুফরীর কারণে এ সম্বোধনের লক্ষস্থলে পরিণত হয়েছে , তাদের ব্যক্তি সত্তার কারণে নয়৷ তাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি আমৃত্যু কাফের থাকে তার জন্য এ সম্বোধন হবে চিরন্তন৷ কিন্তু যে ব্যক্তি ঈমান আনবে তার প্রতি আর এ সম্বোধন আরোপিত হবে না৷
(ঙ) অনেক মুফাসসিরের মতে এ সূরায় " হে কাফেররা " সম্বোধন কেবলমাত্র কুরাইশদের এমন কিছু লোককে করা হয়েছে যারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে দীনের ব্যাপারে সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল এবং যাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ তাঁর রসূলকে (সা) বলে দিয়েছিলেন , এরা ঈমান আনবে না৷ দু'টি কারণে তারা এ মত অবলম্বন করেছেন৷
প্রথমত , সামনের দিকে বলা হয়েছে ( আরবী --------------) ( যারা বা যাদের ইবাদাত তোমরা করো আমি তার বা তাদের ইবাদাত করি না)৷ তাদের মতে এ উক্তি ইহুদি ও খৃষ্টানদের জন্য সঠিক নয়৷ কেননা , তারা আল্লাহর ইবাদাত করে৷
দ্বিতীয়ত, সামনের দিকে একথাও বলা হয়েছে : আরবী ----------------------------) ( আর না তোমরা তার ইবাদাত করো যার ইবাদাত আমি করছি)৷ এ ব্যাপারে তাদের যুক্তি হচ্ছে , এ সূরা নাযিলের সময় যারা কাফের ছিল এবং পরে ঈমান আনে তাদের ব্যাপারে এ উক্তি সত্য নয়৷ কিন্তু এ উভয় যুক্তির কোন সারবত্তা নেই৷ অবশ্যি এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা আমি পরে করবো৷ তা থেকে জানা যাবে , এগুলোর অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে তা সঠিক নয়৷ তবে এখানে এ যুক্তির গলদ স্পষ্ট করার জন্য শুধুমাত্র এতটুকু বলে দেয়াই যথেষ্ট মনে করি , যদি শুধুমাত্র উল্লেখিত লোকদেরকেই এ সূরায় সম্বোধন করা হয়ে থাকে তাহলে তাদের মরে শেষ হয়ে যাওয়ার পর এ সূরার তেলাওয়াত জারী থাকার কি কারণ থাকতে পারে ? কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের পড়ার জন্য স্থায়ীভাবে কুরআনে এটি লিখিত থাকারই বা কি প্রয়োজন ছিল ?

২. সারা দুনিয়ার কাফের মুশরিকরা যেসব উপাস্যের উপাসনা , আরাধনা ও পূজা করে , ফেরেশতা , জিন , নবী , আউলিয়া , জীবিত ও মৃত মানুষের আত্মা তথা ভূত প্রেত , চাঁদ , সূর্য , তারা , জীব - জন্তু , গাছপালা , মাটির মূর্তি বা কাল্পনিক দেব - দেবী সবই এর অন্তরভুক্ত৷ এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা যেতে পারে , আরবের মুশরিকরা মহান আল্লাহকেও তো মাবুদ ও উপাস্য বলে মানতো এবং দুনিয়ার অন্যান্য মুশরিকরাও প্রাচীন যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত ও আল্লাহর উপাস্য হবার ব্যাপারটি অস্বীকার করেনি৷ আর আহলি কিতাবরা তো আল্লাহকেই আসল মাবুদ বলে মানতো৷ এ ক্ষেত্রে কোন প্রকার ব্যতিক্রমের উল্লেখ না করেই এদের সমস্ত মাবুদের ইবাদাত করা থেকে সম্পর্কহীনতা ও দায়মুক্তির কথা ঘোষণা করা , যেখানে আল্লাহও তার অন্তরভুক্ত , কিভাবে সঠিক হতে পারে? এর জবাবে বলা যায় , আল্লাহকে অন্য মাবুদদের সাথে মিশিয়ে মাবুদ সমষ্টির একজন হিসেবে যদি অন্যদের সাথে তাঁর ইবাদাত করা হয় তাহলে তাওহীদ বিশ্বাসী প্রতিটি ব্যক্তি অবশ্যি নিজেকে এ ইবাদাত থেকে দায়মুক্ত ও সম্পর্কহীন ঘোষণা করবে৷ কারণ তার দৃষ্টিতে আল্লাহ মাবুদ সমষ্টির একজন মাবুদ নন৷ বরং তিনি একাই এবং একক মাবুদ ৷ আর এ সমষ্টি ইবাদাত আসলে আল্লাহর ইবাদাত নয়৷ যদিও আল্লাহর ইবাদাত এর অন্তরভুক্ত৷ কুরআন মজীদে পরিস্কার বলে দেয়া হয়েছে একমাত্র সেটিই আল্লাহর ইবাদাত যার মধ্যে অন্যের ইবাদাতের কোন গন্ধও নেই এবং যার মধ্যে মানুষ নিজের বন্দেগীকে পুরোপুরি আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে ৷
আরবী ------------------------------------------------------------------------------------
লোকদেরকে এ ছাড়া আর কোন হুকুম দেয়া হয়নি যে , তারা পুরোপুরি একমুখী হয়ে নিজেদের দীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে তাঁর ইবাদাত করবে ৷ কুরআনের বহু জায়গায় সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে এবং অত্যন্ত জোরালো ভাষায় এ বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে ৷ যেমন সুরা আন নিসা ১৪৫ ও ১৪৬ , আল আ'রাফ ২৯ , আয যুমার ২,৩,১১, ১৪, ও ১৫ এবং আল মু'মিন ১৪ ও ৬৪- ৬৬ আয়াত সমূহ ৷ এ বক্তব্য একটি হাদীসে কুদসীতে ও উপস্থাপিত হয়েছে ৷ তাতে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন , মহান আল্লাহ বলেন , প্রত্যেক শরীকের অংশীদারিত্ব থেকে আমি সব চেয়ে বেশী মুক্ত ৷ যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করেছে যার মধ্যে আমার সাথে অন্য কাউকেও শরীক করেছে , তা থেকে আমি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত এবং আমার সাথে যাকে সে ঐ কাজে শরীক করেছে , ঐ সম্পূর্ণ কাজটি তারই জন্য ( মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ ও ইবনে মাজাহ )৷ কাজেই আল্লাহকে দুই, তিন বা বহু ইলাহের একজন গণ্য করা এবং তাঁর সাথে অন্যদের বন্দেগী উপাসনা ও পূজা করাই হচ্ছে আসল কুফরী এবং এ ধরনের কুফরীর সাথে পুরোপুরি সম্পর্কহীনতার কথা ঘোষণা করাই এ সূরার উদ্দেশ্য )

৩. এখানে মূলে ------ বলা হয়েছে ৷ আরবী ভাষায় ----(মা) শব্দটি সাধারণত নিষ্প্রাণ বা বুদ্ধি- বিবেচনাহীন বস্তু বিষয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে ৷ অন্য দিকে বুদ্ধি- বিবেচনা সম্পন্ন জীবের জন্য ---- (মান ) শব্দ ব্যবহার করা হয় ৷ এ কারণে প্রশ্ন দেখা দেয়, এখানে ---- না বলে ---- বলা হলো কেন ? মুফাসসিরগণ সাধারণত এর চারটি জবাব দিয়ে থাকেন ৷ এক , এখানে ----- শব্দটি -- অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ৷ দুই , এখানে মা শব্দটি ( আললাযী ) অর্থাৎ যে বা যাকে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷ তিন , উভয় , বাক্যেই মা শব্দটি মূল শব্দ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷ এ ক্ষেত্রে এখানে এর অর্থ হয় : আমি সেই ইবাদাত করি না যা তোমরা করো৷ অর্থাৎ মুশরিকী ইবাদাত৷ আর তোমরা সেই ইবাদাত করো না যা আমি করি অর্থাৎ তাওহীদবাদী ইবাদাত৷ চার , প্রথম বাক্যে যেহেতু ( আরবী ---------) বলা হয়েছে তাই দ্বিতীয় বাক্যে বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্য রাখার খাতিরে ( আরবী -------) বলা হয়েছে৷ উভয় ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একই শব্দ বলা হয়েছে কিন্তু এর মানে এক নয়৷ কুরআন মজীদে এর উদাহরণ রয়েছে৷ যেমন সূরা আল বাকারাহ ১৯৪ আয়াতে বলা হয়েছে :
আরবী -------------------------------------
" যে ব্যক্তি তোমার ওপর বাড়াবাড়ি করে তুমি ও তার ওপর তেমনি বাড়াবাড়ি করো যেমন সে তোমার ওপর করেছে"৷
একথা সুস্পষ্ট যে , কারো বাড়াবাড়ির জবাবে ঠিক তেমনি বাড়াবাড়িমূলক আচরনকে আসলে বাড়াবাড়ি বলে না৷ কিন্তু নিছক বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের উদ্দেশ্যেই জবাবী কার্যকলাপকে বাড়াবাড়ি শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে৷অনরূপভাবে সূরা তাওবার ৬৭ আয়াতে বলা হয়েছে আরবী ------------------------------------ "তারা আল্লাহকে ভুলে গেলো কাজেই আল্লাহ তাদেরকে ভুলে গেলেন ৷"অথচ আল্লাহ ভোলেন না ৷ এখানে আল্লাহর বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে ,আল্লাহ তাদেরকে উপেক্ষা করলেন ৷ কিন্তু তাদের ভুলে যাওয়ার জবাবে আল্লাহ ভুলে যাওয়া শব্দটি নিছক বক্তব্যের মধ্যে মিল রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে৷
এ চারটি অর্থ যদিও এক এক দৃষ্টিতে যথার্থ এবং আরবী ভাষায় এসব গ্রহণ করার অবকাশও রয়েছে তবুও যে মূল বক্তব্যটিকে সুম্পষ্ট করে তোলার জন্য ( আরবী ---------- ) এর জায়গায় (আরবী ------------ ) বলা হয়েছে তা এর মধ্য থেকে কোন একটি অর্থের মাধ্যমেও পাওয়া যায় না৷ আসলে আরবী ভাষায় কোন ব্যক্তির জন্য ( আরবী --- ) শব্দটি ব্যবহার করে তার মাধ্যমে তার ব্যক্তিসত্তা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় এবং (আরবী ---- ) শব্দটি ব্যবহার করে তার মাধ্যমে তার গুণগত সত্তা সম্পর্কে জানার ইচ্ছা ব্যক্ত করা হয়৷ যেমন আমাদের ভাষায় কারো সম্পর্কে আমরা জিজ্ঞেস করি , ইনি কে ? তখন তার ব্যক্তি সত্তার পরিচিতি লাভ করাই হয় আমাদের উদ্দেশ্য ৷ কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করি ,ইনি কি ? তখন আসলে আমরা চাই তার গুণগত পরিচিতি ৷ যেমন তিনি যদি সেনাবাহিনীর লোক হন তাহলে সেখানে তার পদমর্যাদা কি ? তিনি যদি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান , তাহলে সেখানে তিনি রীডার ,লেকচারার না প্রফেসর পদে অধিষ্ঠিত আছেন ? তিনি কোন বিষয়টি পড়ান ? তার ডিগ্রী কি ইত্যাদি বিষয় জানাই হয় আমাদের উদ্দেশ্য ৷ কাজেই যদি এ আয়াতে বলা হতো আরবী ------------ তাহলে এর অর্থ হতো , তোমরা সেই সত্তার ইবাদাত করবে না যার ইবাদাত আমি করছি৷ এর জবাবে মুশরিক ও কাফেররা বলতে পারতো : আল্লাহর সত্তাকে তো আমরা মানি এবং তার ইবাদাতও করি ৷ কিন্তু যখন বলা হলো : আরবী -------------------- 'তখন অর্থ দাঁড়ালো :যেসব গুণের অধিকারী মাবুদের ইবাদাত আমি করি সেইসব গুণের অধিকারী মাবুদের ইবাদাত তোমরা করবে না৷এখানে মূল বক্তব্য এটিই ৷ এরি ভিত্তিরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীন সব ধরনের কাফেরদের দীন থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায় ৷ কারণ সব ধরনের কাফেরদের খোদা থেকে তাঁর খোদা সম্পূর্ণ আলাদা ৷ তাদের কারো খোদার ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করার পর সপ্তম দিনে বিশ্রাম নেবার প্রয়োজন হয়েছে৷ সে বিশ্ব - জগতের প্রভু নয় বরং ইসরাঈলের প্রভু ৷ একটি গোষ্ঠীর লোকদের সাথে তার এমন বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে যা অন্যদের সাথে নেই৷ সে হযরত ইয়াকুবের সাথে কুস্তি লড়ে কিন্তু তাকে আছাড় দিতে পারে না ৷ তার উযাইর নামক একটি ছেলেও আছে৷ আবার কারো খোদা হযরত ঈসা (সা )মসিহ নামক একমাত্র পুত্রের পিতা৷ সে অন্যদের গুণাহের কাফফারা দেবার জন্য নিজের পুত্রকে ক্রুশ বিদ্ধ করায়৷ কারোর খোদার স্ত্রী সন্তান আছে৷ কিন্তু সে বেচারার শুধু কণ্যা আবির্ভূত হয়েছে এবং মানুষের দেহ পিঞ্জরে আবদ্ধ হয়ে পৃথিবীর বুকে এবং মানুষের মতো কাজ করে যাচ্ছে ৷ কারো খোদা নিছক অনিবার্য অস্তিত্ব অথবা সকল কার্যকারণের কারণ কিংবা প্রথম কার্যকারণ (First cause ) ৷ বিশ্ব জগতের ব্যবস্থাপনাকে একবার সচল করে দিয়ে সে আলাদা হয়ে গেছে৷তারপর বিশ্ব জাহান ধরা বাধা আইন মুতাবেক স্বয়ং চলছে৷ অতপর মানুষের সাথে তার ও তার সাথে মানুষের কোন সম্পর্ক নেই ৷ মোটকথা ,খোদাকে মানে এমন সব কাফেরও আসলে ঐ আল্লাহ মানে না যিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের এ ব্যবস্থাপনার শুধু স্রষ্টাই নন বরং তার সার্বক্ষণিক পরিচালক ৷ তাঁর হুকুম এখানে প্রতি মুহূর্তেই চলছে৷ তিনি সকল প্রকার দোষ ,ক্রটি ,দুর্বলতা ও ভ্রান্তি থেকে মুক্ত ৷ তিনি সব রকমের উপমা ও সাকার সত্তা থেকে পবিত্র ,নজীর , সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্য মুক্ত এবং কোন সাথী , সহাকারী ও অংশীদারের মুখাপেক্ষী নন৷ তাঁর সত্তা , গুণাবলী , ক্ষমতা ,ইখতিয়ার ও মাবুদ হবার অধিকারে কেউ তাঁর সাথে শরীক নয়৷ তাঁর সন্তানাদি থাকা , কাউকে বিয়ে করে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার এবং কোন পরিবার বা গোষ্ঠীর সাথে কোন বিশেষ সম্পর্ক থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না৷ প্রতিঠি সত্তার সাথে রিজিকদাতা ,পালনর্কতা ,অনুগ্রহকারী ও ব্যবস্থাপক হিসেবে তাঁর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে৷ তিনি প্রার্থনা শোনেন ও তার জবাব দেন৷ জীবন - মৃত্যু , লাভ - ক্ষতি এবং ভাগ্যের ভাঙা - গড়ার পূর্ণ ক্ষমতা তিনিই একচ্ছত্র মালিক৷ তিনি নিজের সৃষ্টির কেবল পালনকর্তাই নন বরং প্রত্যেককে তার মর্যাদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী হিদায়াতও দান করেন৷ তাঁর সাথে আমাদের সম্পর্ক কেবল এতটুকুই নয় যে , তিনি আমাদের মাবুদ এবং আমরা তাঁর পূজা অর্চনাকারী বরং তিনি নিজের নবী ও কিতাবের সাহায্যে আমাদের আদেশ নিষেধের বিধান দান করেন এবং তাঁর বিধানের আনুগত্য করাই আমাদের কাজ৷ নিজেদের কাজের জন্য তাঁর কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে৷ মৃত্যুর পর তিনি পূর্ণবার আমদের ওঠাবেন এবং আমাদের কাজকর্ম পর্যালোচনা করে পুরস্কার ও শাস্তি দেবেন৷ এসব গুণাবলী সম্পন্ন মাবুদের ইবাদাত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীরা ছাড়া দুনিয়ার আর কেউ করছে না৷ অন্যেরা খোদার ইবাদাত করলেও আসল ও প্রকৃত খোদার ইবাদাত করছে না৷ বরং তারা নিজেদের উদ্ভাবিত কাল্পনিক খোদার ইবাদাত করছে৷

৪. একদল তাফসীরকারে মতে এ বাক্য দু'টিতে প্রথম বাক্য দু'টির বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে৷ প্রথম বাক্য দু'টিতে যা কিছু বলা হয়েছে তাকে অত্যধিক শক্তিশালী ও বেশী জোরদার করার জন্য এটা করা হয়েছে৷ কিন্তু অনেক মুফাসসির একে পুনরাবৃত্তি বলে মনে করেন না৷ তারা বলেন , এর মধ্যে অন্য একটি কথা বলা হয়েছে৷ প্রথম বাক্য দু'টিতে যে কথা বলা হয়েছে তা থেকে একথার বক্তব্যই আলাদা৷ আমার মতে , এ বাক্য দু'টিতে আগের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি নেই , এতটুকু কথা সঠিক বলে মেনে নেয়া যায়৷
কারণ এখানে শুধুমাত্র " আর না তোমরা তার ইবাদাত করবে যার ইবাদাত আমি করি " একথাটুকুর পুনরাবুত্তি করা হয়েছে৷ আর আগের বক্তব্যে একথাটি যে অর্থে বলা হয়েছিল এখানে সে অর্থে এর পুনরাবৃত্তি করা হয়নি৷ কিন্তু পুনরাবৃত্তি অস্বীকার করার পর মুফাসসিরগণের এ দলটি এ দু'টি বাক্যের যে অর্থ বর্ণনা করেছেন তা পরস্পর অনেক ভিন্নধর্মী৷ এখানে তাদের প্রত্যেকের বর্ণিত অর্থ উল্লেখ করে তার ওপর আলোচনা করার সুযোগ নেই৷ আলোচনা দীর্ঘ হবার আশংকায় শুধুমাত্র আমার মতে যে অর্থটি সঠিক সেটিই এখানে বর্ণনা করলাম৷
প্রথম বাক্যে বলা হয়েছে : " আর না আমি তাদের ইবাদাত করবো যাদের ইবাদাত তোমরা করে আসছো৷ " এর বক্তব্য দ্বিতীয় আয়াতের বক্তব্য বিষয় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা৷ সেখানে বলা হয়েছে : " আর আমি তাদের ইবাদাত করি না যাদের ইবাদাত তোমরা করো৷" এ দু'টি বক্তব্যে দু'টি দিক দিয়ে বিরাট পার্থক্য রয়েছে৷ এক , অমুক কাজ করি না বা করবো না বলার মধ্যে যদিও অস্বীকৃতি ও শক্তিশালী অস্বীকৃতি রয়েছে কিন্তু আমি অমুক কাজটি করবো না একথার ওপর অনেক বেশী জোর দেয়া হয়েছে৷ কারণ এর অর্থ হচ্ছে , সেটা এত বেশী খারাপ কাজ যে , সেটা করা তো দূরের কথা সেটা করার ইচ্ছা পোষণ করাও আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ দুই " যাদের ইবাদাত তোমরা করো " একথা বলতে কাফেররা বর্তমানে যেসব মাবুদের ইবাদাত করে শুধুমাত্র তাদেরকে বুঝায়৷ বিপরীত পক্ষে " যাদের ইবাদাত তোমরা করেছো" বললে এমনসব মাবুদদের কথা বুঝায় যাদের ইবাদাত কাফেররা ও তাদের পূর্বপুরুষরা অতীতে করেছে৷ একথা সবাই জানে , মুশরিক ও কাফেরদের মাবুদদের মধ্যে হামেশা রদবদল ও কমবেশী হতে থেকেছে৷ বিভিন্ন যুগে কাফেরদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন মাবুদের পূজা করেছে৷ সবসময় ও সব জায়গায় সব কাফেরের মাবুদ কখনো এক থাকেনি৷ কাজেই এখানে আয়াতের অর্থ হচ্ছে , আমি তোমাদের শুধু আজকের মাবুদদের থেকে নয় , তোমাদের পিতৃপুরুষের মাবুদদের থেকেও দায়মুক্ত৷ এ ধরনের মাবুদদের ইবাদাত করার চিন্তা ও মনের মধ্যে ঠাঁই দেয়া আমার কাজ নয়৷
আর দ্বিতীয় বাক্যটিতে ব্যাপারে বলা যায় , যদিও ৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখিত এ বাক্যটির শব্দাবলী ও ৩ নম্বর আয়াতের শব্দাবলী একই ধরনের তবুও এদের উভয়ের মধ্যে অর্থের বিভিন্নতা রয়েছে৷ তিন নম্বর আয়াতে সংশ্লিষ্ট বাক্যটি নিম্নোক্ত বাক্যটির পরে এসেছে : " আমি তাদের ইবাদাত করি না যাদের ইবাদাত তোমরা করো৷ " তাই এর অর্থ হয় , " আর না তোমরা সেই ধরনের গুণাবলী সম্পন্ন একক মাবুদের ইবাদাত করবে যার ইবাদাত আমি করি৷" আর পাঁচ নম্বর আয়াতে এই সংশ্লিষ্ট বাক্যটি নিম্নোক্ত বাক্যটির পরে এসেছে : " আর না আমি তাদের ইবাদাত করবো যাদের ইবাদাত তোমরা করেছো৷" তাই এর মানে হয় " আর না তোমরা সেই একক মাবুদের ইবাদাত করবে বলে মনে হচ্ছে যার ইবাদাত আমি করি৷ " অন্য কথায় , তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষরা যাদে যাদের পূজা - উপাসনা করেছো তাদের পূজারী হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ আর বহু মাবুদের বন্দেগী পরিহার এর একক মাবুদের ইবাদাত করার ব্যাপারে তোমাদের যে বিতৃষ্ণা সে কারণে তোমরা নিজেদের করার পথ অবলম্বন করবে , এ আশাও করি না৷

৫. অর্থাৎ আমার দীন আলাদা এবং তোমাদের দীন আলাদা ৷ আমি তোমাদের মাবুদদের পূজা - উপাসনা - বন্দেগী করি না এবং তোমরা ও আমার মাবুদের পূজা - উপাসনা করো না৷ আমি তোমাদের মাবুদদের বন্দেগী করতে পারি না এবং তোমরা আমার মাবুদের বন্দেগী করতে প্রস্তুত নও৷ তাই আমার ও তোমার পথ কখনো এক হতে পারে না৷ এটা কাফেরদের প্রতি উদারনীতি নয় বরং তারা কাফের থাকা অবস্থায় চিরকালের জন্য তাদের ব্যাপারে দায়মুক্তি , সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষের ঘোষণাবাণী ৷ আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি যারা ঈমান এনেছে তারা দীনের ব্যাপারে কখনো তাদের সাথে সমঝোতা করবে না ------ এ ব্যাপারে তাদেরকে সর্বশেষ ও চূড়ান্তভাবে নিরাশ করে দেয়াই এর উদ্দেশ্য৷ এ সূরার পরে নাযিল হওয়া কয়েকটি মক্কী সূরাতে পর পর এ দায়মুক্তি , সম্পর্কহীনতা ও অসন্তোষ প্রকাশের ঘোষণা দেয়া হয়েছে৷ সূরা ইউনুসে বলা হয়েছে : " এরা যদি তোমাকে মিথ্যা বলে তাহলে বলে দাও , আমার কাজ আমার জন্য এবং তোমাদের কাজ তোমাদের জন্য ৷ আমি যা কিছু করি তার দায় - দায়িত্ব থেকে তোমরা মুক্ত৷ " ( ৪১ আয়াত ) এ সূরাতেই তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলা হয়েছে৷ : " হে নবী ! বলে দাও , হে লোকেরা , যদি তোমরা আমার দীনের ব্যাপারে ( এখানে ) কোন রকম সন্দেহের মধ্যে থাকো তাহলে ( শুনে রাখো) , আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের বন্দেগী করছো আমি তাদের বন্দেগী করি না বরং আমি শুধুমাত্র সেই আল্লাহর বন্দেগী করি যার কর্তৃত্বাধীনে রয়েছে তোমাদের মৃত্যু৷ " ( ১০৪ আয়াত ) সূরা আশ শু'আরায় বরেছেন : " হে নবী ! যদি এরা এখন তোমার কথা না মানে তাহলে বলে দাও , তোমরা যা কিছু করছো তা থেকে আমি দায়মুক্ত৷" (২১৬ আয়াত ) সূরা সাবায় বলেছেন : এদেরকে বলো , আমাদের ত্রুটির জন্য তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না এবং তোমরা যা কিছু করে যাচ্ছো সে জন্য আমাদের জবাবদিহি করতে হবে না৷ বলো , আমাদের রব একই সময় আমাদের ও তোমাদের একত্র করবেন এবং আমাদের মধ্যে ঠিকমতো ফায়সালা করবেন৷" ( ২৫-২৬ আয়াত ) সূরা যুমার - এ বলেছেন : " এদেরকে বলো , হে আমার জাতির লোকেরা ! তোমরা নিজেদের জায়গায় কাজ করে যাও৷ আমি আমার কাজ করে যেতে থাকবো ৷ শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে কার ওপর আসছে লাঞ্ছনাকর আযাব এবং কে এমন শাস্তি লাভ করছে যা অটল৷ " (৩৯-৪০ আয়াত ) আবার মদীনা তাইয়েবার সমস্ত মুসলমানকে ও এই একই শিক্ষা দেয়া হয় ৷ তাদেরকে বলা হয় : তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তার সাথীদের মধ্যে রয়েছে একটি ভালো আদর্শ ৷ ( সেটি হচ্ছে :) তারা নিজেদের জাতিকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে , আমরা তোমাদের থেকে ও তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যে সব মাবুদদের পূজা করো তাদের থেকে পুরোপুরি সম্পর্কহীন ৷ আমরা তোমাদের কুফরী করি ও অস্বীকৃতি জানাই এবং যতক্ষণ তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান না আনো ততক্ষণ আমাদের ও তোমাদের মধ্যে চিরকালীন শক্রতা সৃষ্টি হয়ে গেছে ৷ " (আল মুমতাহিনা ৪ আয়াত ) কুরআন মজীদের একের পর এক এসব সুস্পষ্ট বক্তব্যের পর তোমরা তোমাদের ধর্ম মেনে চলো এবং আমাকে আমার ধর্ম মেনে চলতে দাও -"লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন "- এর এ ধরনের কোন অর্থের অবকাশই থাকে না ৷ বরং সূরা যুমার - এ যে কথা বলা হয়েছে , একে ঠিক সেই পর্যায়ে রাখা যায় যেখানে বলা হয়েছে : "হে নবী ! এদেরকে বলে দাও , আমি তো আমার দীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে তাঁরই ইবাদাত করবো , তোমরা তাঁকে বাদ দিয়ে যার যার বন্দেগী করতে চাও করতে থাক না কেন ৷" ( ১৪ আয়াত )
এ আয়াতের ভিত্তিতে ইমাম আবু হানীফা ও ইমাম শাফেয়ী এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে , কাফেরদের ধর্ম পরস্পর যতই বিভিন্ন হোক না কেন সামগ্রিকভাবে সমস্ত কাফেররা মূলত একই গোষ্ঠীভুক্ত৷ কাজেই তাদের মধ্যে যদি বংশ বা বিবাহের ভিত্তিতে অথবা অন্য কোন কারণে এমন কোন সম্পর্ক থাকে যা একের সম্পত্তিতে অন্যের উত্তরাধিকারী স্বত্ব দাবী করে তাহলে একজন খৃষ্টান একজন ইহুদীর , একজন ইহুদী একজন খৃষ্টানের এক ধর্মের কাফের অন্য ধর্মের কাফেরের উত্তরাধিকারী হতে পারে৷ বিপরীত পক্ষে ইমাম মালিক , ইমাম আওযায়ী ও ইমাম আহমাদের মতে এক ধর্মের লোকেরা অন্য ধর্মের লোকদের উত্তরাধিকারী হতে পারে না৷ তারা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) বর্ণিত হাদীসের ভিত্তিতে এ মত পোষণ করেন৷ এ হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আরবী -------------------------------------------------------------------------- "দুই ভিন্ন ধর্মের লোক পরস্পরের ওয়ারিশ হতে পারে না৷ " ( মুসনাদে আহমাদ , আবু দাউদ , দারে কুতনী)৷ প্রায় একই ধরনের বিষয়বস্তু সম্বলিত একটি হাদীস ইমাম তিরমিযী হযরত জাবের (রা) থেকে , ইবনে হিব্বান হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওপর (রা) থেকে এবং বাযযার আবু হুরাইরা (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন৷ এ বিষয়টি আলোচনা প্রসংগে হানাফী মাযহাবের প্রখ্যাত ইমাম শাসসুল আয়েম্মা সারাখসী লিখেছেন : যে সমস্ত কারণে মুসলমানরা পরস্পরের ওয়ারিশ হয় সে সমস্ত কারণে কাফেররাও পরস্পরের ওয়ারিশ হতে পারে৷ আবার তাদের মধ্যে এমন কোন কোন অবস্থায়ও উত্তরাধিকার স্বত্ব জারী হতে পারে যে অবস্থায় মুসলমানদের মধ্যে হয় না৷ ........................ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে দীন হচ্ছে দু'টি একটি সত্য দীন এবং অন্যটি মিথ্যা দীন৷ তাই তিনি বলেছেন : আরবী -------------- এই সাথে তিনি মানুষদের দু'দলে বিভক্ত করেছেন ৷ একদল জান্নাতী এবং তারা হচ্ছে মুমিন৷ একদল জাহান্নামী এবং সামগ্রিকভাবে তারা হচ্ছে কাফের সমাজ৷ এ দু'দলকে তিনি পরস্পরের বিরোধী গণ্য করেছেন তাই তিনি বলেছেন : আরবী -------------------- ( এই দু'টি পরস্পর বিরোধী দল৷ এদের মধ্যে রয়েছে নিজেদের রবের ব্যাপারে বিরোধ ৷ ----- আল হজ্জ ১৯ আয়াত ) অর্থাৎ সমস্ত কাফেররা মিলে একটি দল৷ তাদের বিরোধ ঈমানদার বা মু'মিনদের সাথে ৷---------------------------------- তাদের নিজেদের আকীদা- বিশ্বাসের দিক দিয়ে আলাদা আলাদা মিল্লাতে তথা মানব গোষ্ঠীর অন্তরভুক্ত বলে আমরা মনে করি না৷ বরং মুসলমানদের মোকাবিলায় তারা সবাই একটি মিল্লাতের অন্তরভুক্ত৷ কারণ মুসলমানরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাত ও কুরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকার করে৷ অন্যদিকে তারা এসব অস্বীকার করে ৷ এ জন্য তাদেরকে কাফের বলা হয়৷ মুসলমানদের মোকাবিলায় তারা একই গোষ্ঠীভুক্ত হয় ( আরবী -------------------------) হাদীসটি আমি ইতিপূর্বে যে কথার উল্লেখ করেছি সেদিকেই ইংগিত করে৷ কারণ , " মিল্লাতাইন " ( দুই মিল্লাত তথা দুই গোষ্ঠী ) শব্দের ব্যাখ্যা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিম্নোক্ত হাদীসের মাধ্যমে করে দিয়েছেন : (আরবী --------------------) অর্থাৎ " মুসলমান কাফেরের ওয়ারিশ হতে পারে না এবং কাফের হতে পারে না মুসলমানের ওয়ারিশ ৷ " [ আল মাবসূত ৩ খণ্ড , ৩০-৩২ পৃষ্ঠা ৷ ইমাম সারাখসী এখানে যে হাদীসটির বরাত দিয়েছেন সেটি বুখারী , মুসলিম , নাসায়ী , আহমাদ , তিরমিযী , ইবনে মাজাহ ও আবু দাউদ হযরত উসামা ইবনে যায়েদ (রা) থেকে রেওয়ায়াত করেছেন ৷]

আল কাওসার

بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ
১) ( হে নবী ! ) আমি তোমাকে কাউসার দান করেছি৷
فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
২) কাজেই তুমি নিজের রবেরই জন্য নামায পড়ো ও কুরবানী করো৷
إِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْأَبْتَرُ
৩) তোমার দুশমনই  শিকড় কাটা৷৪ 
_____________________________________

১ . কাউসার শব্দটি এখানে যেভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তাতে আমাদের ভাষায় তো দূরের কথা দুনিয়ার কোন ভাষায়ও এক শব্দে এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করা সম্ভব নয়৷ এ শব্দটি মূলে কাসরাত ( আরবী ) থেকে বিপুল ও অত্যধিক পরিমাণ বুঝবার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে৷ এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে , সীমাহীন আধিক্য৷ কিন্তু যে অবস্থায় ও পরিবেশে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ৷ তাতে শুধুমাত্র আধিক্য নয় বরং কল্যাণ ও নিয়মতের আধিক্য এবং এমন ধরনের আধিক্যের ধারণা পাওয়া যায় যা বাহুল্য ও প্রাচুর্যের সীমান্তে পৌঁছে গেছে? আর এর অর্থ কোন একটি কল্যাণ বা নিয়ামত নয় বরং অসংখ্য কল্যাণ ও নিয়ামতের আধিক্য৷ ভূমিকায় আমি এ সূরার যে প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছি তার ওপর আর একবার দৃষ্টি বুলানো প্রয়োজন৷ তখন এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল৷ শত্রুরা মনে করছিল , মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবদিক দিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছেন৷ জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বন্ধু - বান্ধব ও সহায় - সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন৷ ব্যবসা ধ্বংস হয়ে গেছে৷ বংশে বাতি জ্বালাবার জন্য যে ছেলে সন্তান ছিল , সেও মারা গেছে৷ আবার তিনি এমন দাওয়াত নিয়ে ময়দানে নেমেছেন যার ফলে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া মক্কা তো দূরের কথা সারা আরব দেশের কোন একটি লোকও তাঁর কথায় কান দিতে প্রস্তুত নয়৷ কাজেই তাঁর ভাগ্যের লিখন হচ্ছে জীবিত অবস্থায় ব্যর্থতা এবং মারা যাবার পরে দুনিয়ায় তাঁর নাম উচ্চারণ করার মতো একজন লোকও থাকবে না৷ এ অবস্থায় আল্লাহর পক্ষ থেকে যখন বলা হলো , তোমাকে কাওসার দান করেছি তখন স্বাভাবিকভাবে এর মানে দাঁড়ালো : তোমার শত্রুপক্ষীর নির্বোধরা মনে করছে তুমি ধ্বংস হয়ে গেছো এবং নবুওয়াত লাভের পূর্বে তুমি যে নিয়ামত অর্জন করেছিলে তা তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে৷ কিন্তু প্রকৃত পক্ষে আমি তোমাকে সীমাহীন কল্যাণ ও অসংখ্য নিয়ামত দান করেছি৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে নজিরবিহীন উন্নত নৈতিক গুণাবলী দান করা হয়েছিল সেগুলো ও এর অন্তরভুক্ত৷ তাঁকে যে নবুওয়াত , কুরআন এবং জ্ঞান ও তা প্রয়োগ করার মতো বুদ্ধিবৃত্তির নিয়মত দান করা হয়েছিল তাও এর মধ্যে শামিল৷ তাওহীদ ও এমন ধরনের একটি জীবন ব্যবস্থার নিয়ামত এর অন্তরভুক্ত যার সহজ , সরল , সহজবোধ্য বুদ্ধি ও প্রকৃতির অনুসারী এবং পূর্ণাঙ্গ ও সার্বজনীন মূলনীতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার এবং হামেশা ছড়িয়ে পড়তে থাকার ক্ষমতা রাখে৷ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আলোচনা ব্যাপকতর করার নিয়ামতও এর অন্তরভুক্ত যার বদৌলতে তাঁর নাম চৌদ্দশো বছর থেকে দুনিয়ার সর্বত্র বুলন্দ হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত বুলন্দ হতে হতে থাকবে৷ তাঁর আহবানে অবশেষে এমন একটি বিশ্বব্যাপী উম্মাতের উম্ভব হয়েছে , যারা দুনিয়ায় চিরকালের জন্য আল্লাহর সত্য দীনের ধারক হয়েছে , যাদের চাইতে বেশী সৎ নিষ্কলুশ ও উন্নত চরিত্রের মানুষ দুনিয়ার কোন উম্মাতের মধ্যে কখনো জন্ম লাভ করেনি এবং বিকৃতির অবস্থায় পৌঁছে ও যারা নিজেদের মধ্যে দুনিয়ার সব জাতির চাইতেও বেশী কল্যাণ ও নেকীর গুণাবলী বহন করে চলছে৷ এ নিয়ামতটিও এর অন্তরভুক্ত ৷
রসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিজের চোখে নিজের জীবদ্দশায় নিজের দাওয়াতকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে উঠতে দেখেছেন এবং তাঁর হাতে এমন জামায়াত তৈরি হয়েছে যারা সারা দুনিয়ার ওপর ছেড়ে যাবার ক্ষতা রাখতো , এ নিয়ামতটিও এর অন্তরভুক্ত৷ ছেলে সন্তান থেকে বঞ্চিত হবার পর শত্রুরা মনে করতো তাঁর নাম - নিশানা দুনিয়া থেকে মিটে যাবে৷ কিন্তু আল্লাহ শুধু মুসলমানদের আকারে তাঁকে এমন ধরনের আধ্যাত্মিক সন্তান দিয়েই ক্ষান্ত হননি যারা কিয়ামত পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় তাঁর নাম বুলন্দ করতে থাকবে বরং তাঁকে শুধুমাত্র একটি কন্যা হযরত ফাতেমার মাধ্যমে এত বিপুল পরিমাণ রক্তমাংসের সন্তান দান করেছেন যারা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং মহান নবীর সাথে সম্পর্কই যাদের সবচেয়ে বড় অহংকার৷ এটিও এ নিয়মাতের অন্তরভুক্ত৷
নিয়ামতগুলো আল্লাহ তাঁর নবীকে এ মরজগতেই দান করেছেন৷ কত বিপুল পরিমাণে দান করেছেন তা লোকেরা দেখেছে৷ এগুলো ছাড়াও কাউসার বলতে আরো দু'টো মহান ও বিশাল নিয়ামত বুঝানো হয়েছে , যা আল্লাহ তাঁকে আখেরাতে দান করবেন৷ সেগুলো সম্পর্কে জানার কোন মাধ্যম আমাদের কাছে ছিল না৷ তাই রসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সেগুলো সম্পর্কে জানিয়েছেন৷ তিনি বলেছেন : কাউসার বলতে দু'টি জিনিস বুঝানো হয়েছে৷ একটি হচ্ছে " হাউজে কাউসার " এটি কিয়ামতের ময়দানে তাঁকে দান করা হবে৷ আর দ্বিতীয়টি " কাউসার ঝরণাধারা৷ " এটি জান্নাতে তাঁকে দান করা হবে৷ এ দু'টির ব্যাপারে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এত বেশী হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং এত বিপুল সংখ্যক রাবী এ হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন যার ফলে এগুলোর নির্ভুল হবার ব্যাপারে সামান্যতম সন্দেহের ও অবকাশ নেই৷
হাউজে কাউসার সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নরূপ তথ্য পরিবেশন করেছেন :
এক : এ হাউজটি কিয়ামতের দিন তাঁকে দেয়া হবে৷ এমন এক কঠিন সময়ে এটি তাঁকে দেয়া হবে যখন সবাই " আল আতশ " ' আল আতশ ' অর্থাৎ পিপাসা , পিপাসা বলে চিৎকার করতে থাকবে সে সময় তাঁর উম্মত তাঁর কাছে এ হাউজের চারদিকে সমবেত হবে এবং এর পানি পান করবে৷ তিনি সবার আগে সেখানে পৌঁছবেন এবং তার মাঝ বরাবর জায়গায় বসে থাকবেন৷ তাঁর উক্তি :
আরবী ----------------------------------------------------------------------
"সেটি একটি হাউজ ৷ আমার উম্মাত কিয়ামতের দিন তার কাছে থাকবে ৷ " ( মুসলিম , কিতাবুস সারাত এবং আবু দাউদ , কিতাবুস সুন্নাহ )
(আবরী ------------------------------------------) " আমি তোমাদের সবার আগে সেখানে পৌঁছে যাবো৷ " ( বুখারী , কিতাবুর রিকাক ও কিতাবুল ফিতান , মুসলিম , কিতাবুল ফাযায়েল ও কিতাবুল তাহারাত , ইবনে মাজাহ , কিতাবুল মানাসিক ও কিতাবুয যুহদ এবং মুসনাদে আহমাদ , আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা), আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ও আবু হুরাইরা (রা) বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ)৷
আরবী ----------------------------------------------------------------------------
" আমি তোমাদের আগে পৌঁছে যাবো , তোমাদের জন্য সাক্ষ দেবো এবং আল্লাহর কসম , আমি এ মুহূর্তে আমার হাউজ দেখতে পাচ্ছি৷ ( বুখারী , কিতাবুল জানায়েয , কিতাবুল মাগাযী ও কিতাবুর রিকাক)৷
আনসারদেরকে সম্বোধন করে একবার তিনি বলেন :
আরবী ----------------------------------------------------------------------------
" আমার পরে তোমরা স্বার্থবাদিতা ও স্বজনপ্রীতির পাল্লায় পড়বে৷ তখন তার ওপর সবর কর‌বে , আমার সাথে হাউজে কাউসারে এসে মিলিত হওয়া পর্যন্ত ৷ " ( বুখারী , কিতাবু মানাকিবিল আনসার ও কিতাবুল মাগাযী , মুসলিম , কিতাবুল আমারাহ এবং তিরমিযী কিতাবুল ফিতান৷)
আরবী -----------------------------------------------------------------------
" কিয়ামতের দিন হাউজের মাঝ বরাবর থাকবো৷ " ( মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল ) হযরত আবু বারযাহ আসলামীকে (রা) জিজ্ঞেস করা হলো , আপনি কি হাউজ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কিছু শুনেছেন৷ তিনি বলেন , " একবার নয় , দু'বার নয় , তিনবার নয় , চারবার নয় , পাঁচবার নয় , বারবার শুনেছি ৷ যে ব্যক্তি একে মিথ্যা বলবে আল্লাহ তাকে যেন তার পানি পান না করান ৷ " (আবু দাউদ , কিতাবুস সুন্নাহ )৷ উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ হাউজ সম্পর্কিত রেওয়ায়াত মিথ্যা মনে করতো৷ এমন কি সে হযরত আবু বারযাহ আসলামী (রা), বারাআ ইবনে আযেব (রা) ও আয়েদ ইবনে আমর (রা) বর্ণিত রেওয়ায়াতগুলো অস্বীকার করলো৷ শেষে আবু সাবরাহ একটি লিপি বের করে আনলেন৷ এ লিপিটি তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আসের (রা) মুখে শুনে লিখে রেখেছিলেন ৷ তাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ বাণী লেখা ছিল : আরবী ------------------------------------- " জেনে রাখো , আমার ও তোমাদের সাক্ষাতের স্থান হচ্ছে আমার হাউজ৷ " ( মুসনাদে আহমাদ , আবদুল্লাহ ইবনে আমার ইবনুল আসের রেওয়ায়াতসমূহ )৷
দুই : এ হাউজের আয়তন সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন প্রকার বর্ণনা এসেছে৷ তবে অধিকাংশ রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে : এটি আইলা ( ইসরাঈলের বর্তমান বন্দর আইলাত ) থেকে ইয়ামনের সান 'আ পর্যন্ত অথবা আইল থেকে এডন পর্যন্ত কিংবা আম্মান থেকে এডেন পর্যন্ত দীর্ঘ হবে৷ আর এটি চওড়া হবে আইলা থেকে হুজকাহ ( জেদ্দা ও রাবেগের মাঝখানে একটি স্থান ) পর্যন্ত জায়গায় সমপরিমাণ ৷ বুখারী , কিতাবুর রিকাক , আবু দাউদ তায়ালাসী ৯৯৫ হাদীস , মুসনাদে আহমাদ , আবু বকর সিদ্দীক ও আবুদল্লাহ ইবনে ওপর বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ , মুসলিম - কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , তিরমিযি ---- আবওয়াবু সিফাতিল কিয়ামহ এবং ইবনে মাজাহ - কিতাবুয যুহুদ ৷) এ থেকে অনুমান করা যায় , বর্তমান লোহিত সাগরটিকেই কিয়ামতের দিন হাউজে কাউসারে পরিবর্তিত করে দেয়া হবে৷ তবে আসল ব্যাপার একমাত্র আল্লাহই ভালো জানে৷
তিন : এ হাউজটি সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন , জান্নাতের কাউসার ঝরণাধারা (সামনে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে৷ ) থেকে পানি এনে এতে ঢালা হবে৷ একটি হাদীসে বলা হয়েছে : আরবী ---------------------------------------------------------এবং অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে : আরবী ------------------------------------------------অর্থাৎ জান্নাতে থেকে দু'টি খাল কেটে এনে তাতে ফেলা হবে এবং এর সাহায্যে থেকে তাতে পানি সরবরাহ হবে৷ (মুসলিম কিতাবুল ফাজায়েল ) অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে : আরবী -------------- অর্থাৎ জান্নাতের কাওসার ঝরণাধারা থেকে একটি নহর এ হাউজের দিকে খুলে দেয়া হবে এবং তার সাহায্যে এতে পানি সরবরাহ জারী থাকবে ( মুসনাদে আহমাদ , আবুদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বর্ণিত রেওয়ায়াতসমূহ )
চার : হাউজে কাউসারের অবস্থা সম্পর্কে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরেছেন যে , তার পানি হবে দুধের চাইতে ( কোন কোন রেওয়ায়াত অনুযায়ী রূপার চাইতে আবার কোন কোন রেয়ায়াত অনুযায়ী বরফের চাইতে ) বেশী সাদা ,বরফের চাইতে বেশী ঠাণ্ডা এবং মধুর চাইতে বেশী মিষ্টি৷ তার তলদেশের মাটি হবে মিশকের চাইতে বেশী সুগন্ধিযুক্ত৷ আকাশে যত তারা আছে ততটি সোরাহী তার পাশে রাখা থাকবে৷ তার পানি একবার পান করার পর দ্বিতীয়বার কারো পিপাসা লাগবে না৷ আর তার পানি যে একবার পান করেনি তার পিপাসা কোনদিন মিটবে না৷ সামান্য শাব্দিক হেরফেরসহ একথাগুলোই অসংখ্য হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে৷ (বুখারী কিতাবুর রিকাক , মুসলিম - কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , মুসনাদে আহমাদ - ইবনে মাসউদ ইবনে উমর ও আবদুল্লাহ উবনে আমর ইবনুল ' আস বর্ণিত রেওয়ায়াত সমূহ , তিরমিযী আবওয়াবু সিফাতিল কিয়ামহ , ইবনে মাজাহ কিতাবুয যুহোদ এবং আবু দাউদ আত তায়ালাসী , ৯৯৫ ও ২১৩৫ হাদীস৷
পাঁচ : রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরবার তাঁর সময়ের লোকদের সতর্ক করে দিয়ে বরেছেন , আমার পরে তোমাদের মধ্য থেকে যারাই আমার তরিকা পদ্ধতি পরিবর্তন করবে তাদেরকে এ হাউজের কাছ থেকে হটিয়ে দেয়া হবে এবং এর পানির কাছে তাদের আসতে দেয়া হবে না৷ আমি বলবো , এরা আমার লোক ৷ জবাবে আমাকে বলা হবে , আপনি জানেন না আপনার পরে এরা কি করেছে৷ ৷ তখন আমি ও তাদেরকে তাড়িয়ে দেবো৷ আমি বলবো , দূর হয়ে যাও৷ এ বক্তব্যটি অসংখ্য হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে৷ ( বুখারী - কিতাবুল ফিতান ও কিতাবুর রিকাক , মুসলিম কিতাবুত তাহারাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , মুসনাদে আহমাদ - ইবনে মাসউদ ও আবু হুরাইরা বর্ণিত হাদীসমূহ , ইবনে মাজাহ -- কিতাবুল মানাসিক৷) ইবনে মাজাহ এ ব্যাপারে যে হাদীস উদ্ধৃত করেছেন তার শব্দগুলো বড়ই হৃদয়স্পর্শী ৷ তাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
আরবী -------------------------------------------------------------------------------------
" সাবধান হয়ে যাও ! আমি তোমাদের আগে হাউজে উপস্থিত থাকবো ৷ তোমাদের মাধ্যমে অন্য উম্মাতদের মোকাবিলায় আমি নিজের উম্মাতের বিপুল সংখ্যাক জন্য গর্ব করতে থাকবো৷ সে সময় আমার মুখে কালিমা লেপন করো না৷ সাবধান হয়ে যাও ! কিছু লোককে আমি ছাড়িয়ে নেবো আর কিছু লোককে আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হবে৷
আমি বলব হে আমার রব ! এরা তো আমার সাহাবী৷ তিনি বলবেন , তুমি জানো না তোমার পরে এরা কী অভিনব কাজ কারবার করেছে ৷ " ইবনে মাজার বক্তব্য হচ্ছে , এ শব্দগুলো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর আরাফাত ময়দানের ভাষণে বলেছিলেন ৷
ছয় : এভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পর থেকে নিয়ে কিয়ামত পর্যন্ত সময় কালের সমগ্র মুসলিম মিল্লাতকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন : তোমাদের মধ্য থেকে যারাই আমার পথ থেকে সরে গিয়ে অন্য পথে চলবে এবং তার মধ্যে রদবদল করবে তাদেরকে এ হাউজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে৷ আমি বলবো : হে আমার রব ! এরা তো আমার উম্মাতের লোক৷ জবাবে বলা হবে : আপনি জানেন না , আপনার পরে এরা কি কি পরিবর্তন করেছিল এবং আপনার পথের উল্টোদিকে চলে গিয়েছিল৷ তখন আমি ও তাদেরকে দূর করে দেবো৷ এবং তাদেরকে হাউজের ধারে কাছে ঘেঁসতে দেবো না৷ হাদীস গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়বস্তু সম্বলিত অসংখ্য হাদীস উল্লেখিত হয়েছে৷ ( বুখারী -- কিতাবুল মুসাকাত , কিতাবুর রিকাক ও কিতাবুল ফিতান , মুসলিম - কিতাবুত তাহারাত , কিতাবুস সালাত ও কিতাবুল ফাজায়েল , ইবনে মাজাহ - কিতাবুয যুহুদ , মুসনাদে আহামদ-আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীসসমূহ)৷
পঞ্চাশ জনের ও বেশী সাহাবী এ হাউজ সংক্রান্ত হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন৷ প্রথম যুগের আলেমগণ সাধারণভাবে এটিকে হাউজে কাউসার বলেছেন ৷ ইমাম বুখারী কিতাবুর রিকাকের শেষ অনুচ্ছেদের শিরোনাম রাখেন নিম্নোক্তভাবে : ( আবরী ---------------------------) ( হাউজ অনুচ্ছেদ , আর আল্লাহ বলেছেন : আমি তোমাকে কাউসার দিয়েছি )৷ অন্য দিকে হযরত আনাসের রেওয়ায়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউসার সম্পর্কে বলেছেন :
আরবী ---------------------------- " সেটি একটি হাউজ ৷ আমার উম্মাত সেখানে উপস্থিত হবে৷ "
জান্নাতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কাউসার নামে যে নহরটি দেয়া হবে সেটির উল্লেখ ও অসংখ্য হাদীসে পাওয়া যায়৷ হযরত আনাস (রা) থেকে এ সংক্রান্ত বহু হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে৷ সেগুলোতে তিনি বলেন ( আবার কোন কোনটিতে তিনি স্পষ্টভাবে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উক্তি হিসেবেই বর্ণনা করেন ) : মি'রাজে রসূলুল্লাহকে ( সা) জান্নাতে সফর করানো হয়৷ এ সময় তিনি একটি নহর দেখেন৷ এ নহরের তীরদেশে ভিতর থেকে হীরা বা মুক্তার কারুকার্য করা গোলাকৃতির মেহরাবসমূহ ছিল্ ,‌তার তলদেশের মাটি ছিল খাঁটি মিশকের সুগন্ধিযুক্ত৷ রসূলুল্লাহ (সা) জিরীলকে বা যে ফেরেশতা তাঁকে ভ্রমণ করিয়েছিলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করেন , এটা কি ? ফেরেশতা জাবাব দেন , এটা কাউসার নহর৷ আল্লাহ আপনাকে এ নহরটি দিয়েছেন৷ ( মুসনাদে আহামদ , বুখারী , তিরমিযী , আবু দাউদ তায়ালাসী ও ইবেন জারীর )৷ হযরত আনাস এক রেওয়ায়াতে বলেন , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল , অথবা এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেন : কাউসার কি ? তিনি জবাব দিলেন : একটি নহর যা আল্লাহ আমাকে জান্নাতে দান করেছেন৷ এর মাটি মিশকের ৷ এর পানি দুধের চাইতেও সাদা এবং মধুর চাইতে মিষ্টি৷ ( মুসনাদে আহমাদ , তিরমিযী , ইবনে জারীর )৷ মুসনাদে আহমাদের অন্য একটি রেওয়ায়াতে বলা হয়েছে , রসূলুল্লাহ (সা) নহরে কাউসারের বৈশিষ্ট বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন : তার তলদেশে কাঁকরের পরিবর্তে মণিমুক্তা পড়ে আছে৷ ইবনে ওমর (রা) বলেন , রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : কাউসার জান্নাতের একটি নহর৷ এর তীরদেশ সোনার পরিবর্তে মূল্যবান পাথর বিছানো আছে৷ ) এর মাটি মিশকের চাইতে বেশী সুগন্ধিযুক্ত৷ পানি দুধের চাইতে বেশী সাদা৷ বরফের চেয়ে বেশী ঠাণ্ডা ও মধুর চেয়ে বেশী মিষ্টি৷ ( মুসনাদে আহামদ ,তিরমিযী , ইবনে মাজাহ , ইবনে আবী হাতেম , দারেমী , আবু দাউদ , ইবনুল মুনযির , ইবনে মারদুইয়া ও ইবনে আবী শাইবা )৷ উসামা ইবনে যায়েদ (রা) রেওয়ায়াত করেছেন , রসূলুল্লাহ (সা) একবার হযরত হামাযার (রা) বাড়িতে যান৷ তিনি বাড়িতে ছিলেন না ৷ তাঁর স্ত্রী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মেহেমানদারী করেন৷ আলাপ আলোচনা করতে করতে এক সময় তিনি বলেন , আমার স্বামী আমাকে বলেছেন , আপনাকে জান্নাতে একটি নহর দেয়া হবে৷ তার নাম কাউসার৷ তিনি বলেন : " হ্যাঁ , তার যমীন ইয়াকুত , মারজান , যবরযদ ও মতির সমন্বেয় গঠিত৷ ( ইবনে জারীর ও ইবন মারদুইয়া ৷ এ হাদীসটির সূত্র দুর্বল হলেও এ বিষয়বস্তু সম্বলিত বিপুল সংখ্যক হাদীস পাওয়া যাওয়ার কারণ এর শক্তি বেড়ে গেছে )৷ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উক্তি এবং সাহাবা ও তাবেঈগণের অসংখ্য বক্তব্য হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে৷ এ সবগুলোতে কাউসার বলতে জান্নাতের এ নহরই বুঝানো হযেছে৷ ওপরে এ নহরের যে সব বৈশিষ্ট বর্ণিত হয়েছে এ হাদীসগুলোতেই তাই বলা হয়েছে৷ উদাহরণ স্বরূপ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) , হযরত আবুদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) , হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) , হযরত আয়েশা (রা) , মুজাহিদ ও আবুল আলীয়ার উক্তিসমূহ মুসনাদে আহমাদ , বুখারী , তিরমিযী , নাসাঈ , ইবনে মারদুইয়া , ইবনে জারীর ও ইবনে আবী শাইবা ইত্যাদি মুহাদ্দিসগনের কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে৷

২ . বিভিন্ন মনীষী এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন৷ কেউ কেউ নামায বলতে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামায ধরেছেন৷ কেউ ঈদুল আযহার নামায মনে করেছেন৷ আবার কেউ বলেছেন , এখানে নিছক নামাযের কথা বলা হয়েছে৷ অনুরূপভাবে " ওয়ানহার " অর্থাৎ " নহর কর " শব্দেরও কোন কোন বিপুল মর্যাদার অধিকারী মনীষী অর্থ করেছেন , নামাযে বাম হাতের ওপর ডান হাত রেখে তা বুকে বাঁদা ৷ কেউ কেউ বলেছেন , এর অর্থ হচ্ছে , নামায শুরু করার সময় দুই হাত ওপরে উঠিয়ে তাকবীর বলা কেউ কেউ বলেছেন , এর মাধ্যমে নামায শুরু করার সময় রুকূতে যাবার সময় এবং রুকূ' থেকে উঠে রাফে ইয়াদায়েন করা বুঝানো হয়েছে৷ আবার কেউ কেউ বলেছেন , এর অর্থ হচ্ছে , ঈদুল আযহার নামায পড়া এবং কুরবানী করা৷ কিন্তু যে পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এ হুকুম দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে চিন্তা করলে এর সুস্পষ্ট অর্থ এই মনে হয় : " হে নবী ! তোমার রব যখন তোমাকে এত বিপুল কল্যাণ দান করেছেন তখন তুমি তাঁরই জন্য নামায পড় এবং তাঁরই জন্য কুরবানী দাও ৷ " এ হুকুমটি এমন এক পরিবেশে দেয়া হয়েছিল যখন কেবল কুরাইশ বংশীয় মুশরিকরাই নয় সমগ্র আরব দেশের মুশরিকবৃন্দ নিজেদের মনগড়া মাবুদদের পূজা করতো এবং তাদের আস্তানায় পশু বলী দিতো ৷ কাজেই এখানে এ হুকুমের উদ্দেশ্য হচ্ছে , মুশরিকদের বিপরীতে তোমরা নিজেদের কর্মনীতির ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকো৷ অর্থাৎ তোমাদের নামায হবে আল্লাহরই জন্য , কুরবানীও হবে তাঁরই জন্য৷ যেমন অন্যত্র বলা হযেছে :
আরবী ----------------------------------------------------------------------------------
" হে নবী ! বলে দাও , আমার নামায , আমার কুরবানী , আমার জীবন ও আমার মৃত্যু বিশ্ব- জাহানের রব আল্লাহরই জন্য ৷‌ তাঁর কোন শরীক নেই৷ আমাকে এরই হুকুম দেয়া হয়েছে এবং আমি সর্বপ্রথম আনুগত্যের শির নত করি৷ " ( আল আন'আম , ১৬২-১৬৩) ৷
ইবনে আব্বাস আতা , মুজাতিদ, ইকরামা , হাসান বরসী , কাতাদাহ , মুহাম্মাদ ইবনে কাব আল কুয়াযী , যাহহাক , রাবী'ইবনে আনাস , আতাউল খোরাসানী এবং আরো অন্যান্য অনেক নেতৃস্থানীয় মুফাসসির এর এ অর্থই বর্ণনা করেছেন (ইবনে কাসীর )৷ তবে একথা যথাস্থানে পুরোপুরি সত্য যে , রসূলুল্লাহ (সা) যখন মদীনা তাইয়েবায় আল্লাহর হুকুমে ঈদুল আযহার নামায পড়েন ও কুরবানীর প্রচলন করেন তখন যেহেতু ( আরবী ----------------) আয়াতে এবং ( আরবী ---------------) আয়াতে নামাযকে প্রথমে ও কুরবানীকে পরে রাখা হয়েছে তাই তিনি নিজেও এভাবেই করেন এবং মুসলমানদের এভাবে করার হুকুম দেন৷অর্থাৎ এদিন প্রথমে নামায পড়বে এবং তারপর কুরবানী দেবে৷ এটি এ আয়াতের ব্যাখ্যা বা এর শানেনুযুল নয়৷ বরং সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিধানটি ইসতেমবাত তথা উদ্ভাবন করেছিলেন ৷ আর রসূলের (সা) ইসতেমবাতও এক ধরনের ওহী ৷

৩ . এখানে (আরবী -------------------) (শা- নিআকা ) শব্দ ব্যবাহর করা হয়েছে ৷ এর মূল হচ্ছে (আরবী--------) ( শানউন)৷ এর মানে এমন ধরনের বিদ্বেষ ও শত্রুতা যে কারণে একজন অন্য জনের বিরুদ্ধে অসদ্ব্যবহার করতে থাকে৷ কুরআন মজীদের অন্য জায়গায় বলা হয়েছে : আবরী ------------------------------------------------------------------------------------
" আর হে মুসলমানরা ! কোন দলের প্রতি শত্রুতা তোমাদের যেন কোন বাড়াবাড়ি করতে উদ্বুদ্ধ না করে যার ফলে তোমরা ইনসাফ করতে সক্ষম না হও৷ "
কাজেই এখানে " শানিয়াকা " বলে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যে , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শত্রুতায় অন্ধ হওয়া তাঁর প্রতিও দোষারোপ করে , তাঁকে গালিগালাজ করে , তাঁকে অবমাননা করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে নানান ধরনের অপবাদ দিয়ে নিজের মনের ঝাল মেটায়৷

৪ . ( আরবী ---------------) "সেই আবতার " বলা হয়েছে৷ অর্থাৎ সে তোমাকে আবতার বলে৷ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে নিজেই আবতার৷ আমি ইতিপূর্বে এ সূরার ভূমিকায় " আবতার " শব্দের কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছি৷ এই শব্দের মূলে রয়েছে বাতারা ( আরবী ---------) এর মানে কাটা৷ কিন্তু এর পরিভাষিক অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক৷ হাদীসে নামাযের যে রাকাতের সাথে অন্য কোন রাকাত পড়া হয় না তাকে বুতাইরা ( আরবী ----------) বলা হয়৷ অর্থাৎ একক রাকাত৷ অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে৷ (আরবী ----------------------------------)
" হে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ আল্লাহর প্রসংশাবাণী উচ্চারণ না করে শুরু করাটা আবতার৷'
অর্থাৎ তার শিকড় কাটা গেছে ৷ সে কোন প্রতিষ্ঠা ও শক্তিমত্তা লাভ করতে পারে না৷ অথবা তার পরিণাম ভালো নয়৷ ব্যর্থকাম ব্যক্তিকে ও আবতার বলা হয়৷ যে ব্যক্তির কোন উপকার ও কল্যাণের আশা নেই এবং যার সাফল্যের সব আশা নির্মূল হয়ে গেছে তাকেও আবতার বলে৷ যার কোন ছেলে সন্তান নেই অথবা হয়ে মারা গেছে তার ব্যাপারেও আবতার শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ কারণ তার অবর্তমানে তার নাম নেবার মতো কেউ থাকে না এবং মারা যাবার পর তার নাম নিশানা মুছে যার৷ প্রায় সমস্ত অর্থেই কুরাইশ কাফেররা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আবতার বলতো৷ তার জবাবে আলাহ বলেন ,হে নবী ! তুমি আবতার নও বরং তোমার এ শত্রুই আবতার৷ এটা নিছক কোন জবাবী আক্রমণ ছিল না৷ বরং এটা ছিল আসলে কুরআনের বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যতবাণীর মধ্য থেকে একটি বড়ই গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী৷ এটা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়৷ যখন এ ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় তখন লোকেরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আবতার মনে করতো৷ তখন কেউ ধরণা করতে পারতো না যে , কুরাইশদের এ বড় বড় সরদাররা আবার কেমন করে আবতার হয়ে যাবে ? তারা কেবল মক্কায়ই নয় সমগ্র দেশে খ্যাতিমান ছিল ৷ তারা সফলকাম ছিল৷ তারা কেবল ধন - সম্পদ ও সন্তান - সন্ততির অধিকারী ছিল না বরং সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় ছিল তাদের সহযোগী ও সাহায্যকারী দল৷ ব্যবসার ইজারাদার ও হজ্জের ব্যবস্থাপক হবার কারণে আরবের সকল গোত্রের সাথে ছিল তাদের সম্পর্ক৷ কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে গেলো৷ হিজরী ৫ সনে আহযাব যুদ্ধের সময় কুরাইশরা বহু আরব ও ইহুদি গোত্র নিয়ে মদীনা আক্রমণ করলো এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবরুদ্ধ অবস্থায় শহরের চারদিক পরিখা খনন করে প্রতিরক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত হতে হলো৷ কিন্তু এর মাত্র তিন বছর পরে ৮ হিজরীতে রসূলুল্লাহ (সা) যখন মক্কা আক্রমণ করলেন তখন কুরাইশদের কোন সাহায্য - সহযোগিতা দানকারী ছিল না৷ নিতান্ত অসহায়ের মতো তাদেরকে অস্ত্র সংবরণ করতে হলো৷ এরপর এক বছরের মধ্যে সমগ্র আরব দেশ ছিল রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের করতলগত৷ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিদল এসে তাঁর হাতে বাই' আত হচ্ছিল৷ ওদিকে তাঁর শত্রুরা সম্পূর্ণরূপে বন্ধু বান্ধব ও সাহায্য সহায়হীন হয়ে পড়েছিল৷ তারপর তাদের নাম নিশানা দুনিয়ার বুক থেকে এমনভাবে মুছে গেলো যে , তাদের সন্তানদের কেউ আজ বেঁচে থাকলে ও তাদের কেউই আজ জানে না সে আবু জেহেল আর আবু লাহাব , আস ইবনে ওয়ায়েল বা উকবা ইবনে আবী মু'আইত ইত্যাদি ইসলামের শত্রুদের সন্তান ৷ আর কেউ জানলেও সে নিজেকে এদের সন্তান বলে পরিচয় দিতে প্রস্তুত নয়৷ বিপরীত পক্ষে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবারবর্গের ওপর আজ সারা দুনিয়ায় দরূদ পড়া হচ্ছে৷ কোটি কোটি মুসলমান তাঁর সাথে সম্পর্কিত হবার কারণে গর্ব করে৷ লাখো লাখো লোক তাঁর সাথেই নয় বরং তাঁর পরিবার - পরিজন এমন কি তাঁর সাথীদের পরিবার পরিজনের সাথেও সম্পর্কিত হওয়াকে গৌরবজনক মনে করে৷ এখানে কেউ সাইয়েদ , কেউ উলুব্বী , কেউ আব্বাসী , কেউ হাশেমী , কেউ সিদ্দিকী , কেউ ফারুকী , কেউ উসমানী , কেউ যুবাইরী এবং কেউ আনসারী৷ কিন্তু নামমাত্র ও কোন আবু জেহেলী বা আবু লাহাবী পাওয়া যায় না৷ ইতিহাস প্রমাণ করেছে , রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবতার নন বরং তাঁর শত্রুরাই আবতার৷