বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১১

নিরোরা সর্বকালেই বাঁশি বাজায়

নিরোরা সর্বকালেই বাঁশি বাজায়

মাহমুদুর রহমান
 
রোমান সম্রাট নিরোর গল্প পাঠকদের অনেকেই হয়তো জানেন। এই অত্যাচারী রাজা খ্রিস্টাব্দ ৬৪-তে সৈন্য-সামন্ত লাগিয়ে তারই সাম্রাজ্যের রাজধানী রোম নগরীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আগুন লাগানোর পেছনে দু’টি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমটি হলো নিরোর প্রাসাদ তৈরির জন্য বিশাল জায়গার প্রয়োজন হয়েছিল। পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করেই সেই জায়গার ব্যবস্থা করেছিলেন রোমান সম্রাট। আর দ্বিতীয় কারণ হলো রাজধানীর নাগরিকরা ক্রমেই প্রতিবাদী হয়ে উঠছিলেন, তাদের শায়েস্তা করতেও এই বহ্ন্যুত্সব। বলা হয়ে থাকে, রোম যখন আগুনে পুড়ে ছারখার হচ্ছিল তখন সম্রাট নিরো নাকি মনের ফুর্তিতে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সম্রাট নিরো মানুষ হত্যা করতেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ইতিহাসের বইয়ে পড়েছি, তিনি নাকি নিজের মাকেও হত্যা করেছিলেন। তার অপশাসনে অতিষ্ঠ রোমানদের গণঅভ্যুত্থানের মুখে নিরো শেষপর্যন্ত ৬৮ খ্রিস্টাব্দে আত্মহত্যা করে জনরোষ থেকে রক্ষা পান।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, প্রায় দুই হাজার বছর অতিক্রান্ত হলেও সেই নিরো আজ অবধি দেশে দেশে অত্যাচারী, গণবিরোধী শাসকদের কাঁধে প্রেতাত্মা হয়ে দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছেন। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকশ্রেণীর কাজ-কারবার দর্শনে এবং অম্লান বদনে মিথ্যাচার শ্রবণে নিরোর কথা ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে যায়। মহাজোটের তিন বছরের অপশাসনে বাংলাদেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানো প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এক শেয়ারবাজার থেকেই এক বছরের বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ লুট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ফলে অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তো আগেই ফেল মেরেছেন। শেষপর্যন্ত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর অনেক ঢাকঢোল পেটানো প্রণোদনা প্যাকেজেও শেয়ারবাজারে প্রাণ সঞ্চারিত করা যায়নি। যাবেই বা কোত্থেকে! সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তো তিন বছরে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
এদিকে এতই বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে যে, ৭০ টাকার ডলারের সরকারি দাম ৮০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কার্ব মার্কেটে ৮৫ টাকা দিয়েও ডলার মিলছে না। পরিচিত দু-চারজন ব্যাংকার আমাকে জানিয়েছেন সহসাই ডলারের দাম ১০০ টাকা অতিক্রম করবে।
যেসব নির্বোধ বাংলাদেশী সরকারের নানারকম প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে বাড়ি-ঘর বেচে, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে শেয়ারবাজারে টাকা খাটিয়েছিলেন, তারা এখন দল বেঁধে বিক্ষোভ করছেন, বুক চাপড়াচ্ছেন। গত সপ্তাহের প্রথম দিন টেলিভিশন চ্যানেলে এদের কণ্ঠেই স্লোগান শুনলাম, শেয়ারবাজার ধ্বংস কেন—শেখ হাসিনা জবাব চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জবাব দিতে বয়েই গেছে। তিনি ক’দিন আগে পোশাক শিল্পমালিকদের বার্ষিক মেলা বাটেক্সপো উদ্বোধনকালে অম্লান বদনে দাবি করলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নাকি অভাবনীয় উন্নতি হচ্ছে। অথচ একই দিনে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে, কেবল ইউরোপের বাজারেই বাংলাদেশের ৮ হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাকের রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অবধারিতভাবে শতাধিক কারখানা বন্ধ হবে, হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারাবেন।
দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন রীতিমত বিশ্বব্যাপী জানান দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার প্রথমদিকে উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে একনাগাড়ে বলে গেল, সব কুছ ঠিক হ্যায়। আমরা যারা একটু লেখালেখি করি কিংবা বিশিষ্টজনদের মধ্যে হাতে গোনা দু-চারজন যারা এখনও টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিতে পারেন, তাদের অভিযোগের জবাবে একসময়ের সদা হাস্যময় বর্তমানে ক্রুদ্ধ অর্থমন্ত্রী ক্রমাগত বলে গেলেন, রাবিশ, স্টুপিডরা সব বানিয়ে বলছে। থলের বিড়াল শেষপর্যন্ত জনসমক্ষে বেরিয়ে পড়লে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ঘোষণা এলো, বেয়াদব বিশ্বব্যাংকের টাকায় আমাদের দরকার নেই, মালয়েশিয়া সরকার নাকি পদ্মা সেতুর অর্থায়নে সম্মত হয়েছে। ঘোষণাই সার, মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারী লাপাত্তাই থেকে গেল।
এসব গাল-গল্পে আর ক’দিন চলে? সরকার উপায় না পেয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফকে সন্তুষ্ট করার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয় দুই ভাগ করে ‘বাণীর রাজা’ ওবায়দুল কাদেরকে এক ভাগ এবং এক-এগারোর অন্যতম ‘সংস্কার প্রস্তাবক’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে অন্যভাগ দিলেন। আর বহুল আলোচিত-সমালোচিত আবুল হোসেন হয়েছেন ডিজিটাল মন্ত্রী। বাণীর রাজা মন্ত্রিত্ব পেয়েই দাবি করলেন, সব সমস্যা মিটে গেছে। বিদেশ থেকে ডলারের বস্তা এলো বলে! একটা নয়, এবার দু’টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। নতুন সড়ক মন্ত্রীর দাবির প্রতিধ্বনি ইথারে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সর্বশেষ বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউ টার্ন নিয়ে নতুন সংবাদ দিলেন। তার নতুন থিওরি হচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বের (PPP) মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মিত হবে! তিনিও বোধহয় দু’টি সেতুর কথাই বললেন। কত আর টাকা লাগবে? মাত্র ষাট-সত্তর হাজার কোটি টাকারই তো মামলা। শেয়ারবাজার থেকে যে গোষ্ঠী লক্ষ কোটি টাকারও অধিক লুটে নিয়ে গেছে, তারা যদি প্রধানমন্ত্রীকে সেই টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। লুটপাটের টাকা তো আপনজনদের কাছেই রয়েছে। সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে লুটের একটি অংশ ফেরত দেয়া তো তাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব জয় যুক্তরাষ্ট্রে গতকাল ঘোষণা দিয়েছেন যে বিশ্বব্যাংকের অর্থের আর কোনো প্রয়োজন বাংলাদেশের নেই। বেসরকারি খাতের টাকায় কেবল দুটো পদ্মা সেতুই নয়, তার নানার নামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও নাকি নির্মিত হবে। সজীব জয় সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে উপরিউক্ত ঘোষণা দিয়ে থাকলে প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চিন্ত বোধ করাটাই স্বাভাবিক।
তবে সেরকম কিছু না হয়ে থাকলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বর্তমান শাসককুল দেশের ষোলো কোটি নাগরিককে এতখানি গর্দভ ঠাওরাবেন না যে, এসব গাঁজাখুরি বক্তব্যে তারা বারবার প্রতারিত হবেন। সরকারের প্রথম দুই বছরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় উক্তি ছিল, আমার মন্ত্রিসভার সব সদস্য এতই দুধে ধোয়া যে, তাদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত দুর্নীতির কোনো অভিযোগ পর্যন্ত উত্থাপিত হয়নি। তৃতীয় বছরে যখন দুর্নীতির অভিযোগের ঠেলায় কান পাতা যাচ্ছে না, তখন একই প্রধানমন্ত্রী রাগতকণ্ঠে বলছেন, দুর্নীতির অভিযোগ তুললেই হবে না, বিশ্বব্যাংককে সেটা প্রমাণ করতে হবে। বিএনপির ব্যাপারে নীতি অবশ্য আলাদা। তাদের ক্ষেত্রে যে কোনো আওয়ামী পত্রিকায় অভিযোগ ছাপা হওয়াটাই প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ। মহাজোটের আমলে ‘কাপট্য’ শব্দটিকেই মনে হচ্ছে বাংলা অভিধান থেকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশ চতুর্মুখী বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনীতি তো রসাতলে গেছেই, মানুষের জীবনেরও কোনো নিরাপত্তা নেই। আগে ক্রসফায়ারে তো তবু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এক ধরনের দায়িত্ব গ্রহণ করত। গুম-খুনের ক্ষেত্রে সেই বালাইও উঠে গেছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও গুলিবিদ্ধ অথবা অন্য কোনো উপায়ে নিহতদের লাশ ভেসে উঠছে। সরকারের বিভিন্ন তরফ থেকে এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো ব্যাখ্যা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক কথার মানুষ। তিনি তোতা পাখির মতো বলেই চলেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো। এখানে থামলেও সাহারা খাতুন ভালো করতেন। কিন্তু পরবর্তী বাক্যে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। রণচণ্ডী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, দেশে গুম-খুন হচ্ছে নাকি? সংবাদপত্রে পড়ার আগে আমি তো এসব জানতামই না! পুলিশ প্রধান হাসান খন্দকারও সচরাচর রাজনীতিকের ভাষাতেই কথা বলে থাকেন। তার দাবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। আইজিপি’র দাবি না হয় আমরা মেনেই নিলাম। তারপরও তো কথা থাকে। কারা এসব গুম-খুন ঘটাচ্ছে, সেটা তো অন্তত তিনি বলবেন। না কি তার সেই দায়িত্বও নেই?
নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র আওয়ামী লীগের লোকমান হোসেন তারই দলীয় মন্ত্রীর ভাইয়ের প্রাইভেট বাহিনীর হাতে নিহত হলে লোকমান হোসেনের পরিবার হত্যাকারীদের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে মামলা দায়ের করে। এজাহারে নাম না থাকা সত্ত্বেও বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা আসামি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজুর ছোট ভাইকে আদালত প্রাঙ্গণে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখেও গ্রেফতার না করে বরং পলায়নে সহায়তা করে। আইজিপিকে এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বিশেষ কৌশলগত কারণেই মন্ত্রীর ভাইকে গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশের সেই অসাধারণ কৌশল সম্ভবত এখনও কার্যকর আছে। কারণ, মন্ত্রীর ভাইয়ের বর্তমান অবস্থান দেশবাসীর অজানা। কৌশলগত কারণে আইজি’র পুলিশ হয়তো তাকে এতদিনে সীমান্ত পার করে ভারতের ‘সেফ হোমে’ পাঠিয়েও দিয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ অবশ্য মনে করে, বিরোধী দলের আন্দোলনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেতে দেখে আতঙ্কিত সরকার আন্দোলন প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাদের গুম-খুন শুরু করেছে। ক’দিন আগে কুষ্টিয়ার ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপি সভাপতিকে এই রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে উঠিয়ে নিয়ে হত্যা করে তার লাশ গাজীপুর জাতীয় উদ্যানের শাল-গজারির বনে ফেলে দেয়া হয়েছে। পুলিশ, র্যাবকে তার অপহরণের কথা জানানো হলেও তারা বিষয়টিকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। গুম-খুনের সংখ্যা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, মহাজোটের প্রতি সহানুভূতিশীল পত্রিকা প্রথম আলো এবং কট্টর সরকার সমর্থক সমকাল পর্যন্ত গুম-খুন নিয়ে লিড স্টোরি করতে বাধ্য হয়েছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতার সংবাদ ক্রমেই বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশের বিজয়ের ৪০ বছর প্রসঙ্গে আলোচনাকালে এদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট ‘দি এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (আফাদ)’ বাংলাদেশে গুম-খুনের ঘটনা বৃদ্ধিতে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে। আফাদ-এর সভাপতি মুগিয়ান্তো ও সম্পাদক আইলিন বাকালসো স্বাক্ষরিত ডিসেম্বরের ১৬ তারিখের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘গুমের ঘটনার সাম্প্রতিক বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনক।’ বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা, দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির চর্চা ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার চিত্র আবারও এই পরিস্থিতি সামনে নিয়ে এসেছে।
গুম-খুন নিয়ে স্বভাবসুলভ কায়দায় সর্বশেষ বোমাটি ফাটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দাবি করেছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে বিএনপিই নাকি এসব গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সভায় বক্তৃতাকালে তিনি নাজমুল হত্যাকাণ্ডের জন্য পরোক্ষভাবে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য, প্রবীণ রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলামকে দায়ী করেছেন। এই না হলে মহাজোট নেত্রী! এদিকে আমরা যারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত রয়েছি, তাদের কাছে প্রতিদিন গুমের খবর আসছে। বিভিন্ন সূত্রে এমন গুজবও শুনছি, একটি এলিট বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধানের নেতৃত্বে ‘ডেথ স্কোয়াড’ গঠন করা হয়েছে। তারা রীতিমত তালিকা করে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ‘ডেথ স্কোয়াড’-এর প্রধান নিজ হাতেও সরকারবিরোধীদের ভবলীলা সাঙ্গ করাচ্ছেন, এ ধরনের কথাও কানে আসছে।
র্যাব (RAB) নামকরণ নিয়েও সাধারণ জনগণ রসিকতা করতে শুরু করেছে। বিএনপি সরকারের আমলে গঠিত তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরের মস্তিষ্কপ্রসূত সংস্থাটির পুরো নাম হলো র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (Rapid Action Battalion), সংক্ষেপে র্যাব। সেই র্যাবকে লোকজন ঠাট্টা করে এখন বলছে Rakkhi Awami Bahini (রক্ষী আওয়ামী বাহিনী)। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে তত্কালীন শেখ মুজিব সরকার রক্ষীবাহিনী গঠন করে সারাদেশে গুম-খুনের রেকর্ড গড়েছিল। সে সময়ের জাসদ এবং অন্যান্য বামপন্থী দলের প্রায় তিরিশ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করে রক্ষীবাহিনী দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আজকের ক্ষমতাসীন মহাজোটে অবশ্য সেই জাসদের একাংশও রয়েছে। জাসদের একসময়ের জঙ্গি সংগঠন গণবাহিনীর নেতৃবৃন্দ যারা এখন সরকারের সঙ্গে যুক্ত, তাদের কণ্ঠ থেকে ইতিহাস বিকৃতকারী নানারকম বক্তব্য প্রায়ই শুনতে পেয়ে সেই পুরনো প্রবাদের কথা মনে পড়ে যায়, সত্যি সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!
এ বছরের মার্চে জেল থেকে মুক্তির পরদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ ক্রমেই সত্তর দশকের দক্ষিণ আমেরিকার নির্যাতক রাষ্ট্র চিলিতে পরিণত হচ্ছে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলাম। এত তাড়াতাড়ি সেই আশঙ্কা বাস্তবে রূপ পেতে দেখে ব্যথিত হচ্ছি। সালভেদর আলেন্দেকে হত্যাকারী চিলির সেই সময়কার স্বৈরশাসক পিনোশে আজ সারা বিশ্বে এক ঘৃণিত নাম। তার একসময়ের প্রভু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাকে এখন পরিত্যাগ করেছে। হাজার হাজার নাগরিককে গুম-খুনের অভিযোগে বয়সের ভারে ন্যুব্জ পিনোশের বিচার চলছে চিলিতে। এই বৃদ্ধ একনায়ককে হয়তো ফাঁসিতে ঝুলতে হবে না। তবে ইতিহাসে একজন খলনায়ক রূপেই লোকটি চিত্রিত হয়ে থাকবে। ফ্যাসিজমের আগমন আশঙ্কায় ‘নবরূপে বাকশাল’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম ২০০৮ সালের নভেম্বরে। ওই নামে আমার একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে এ বছর বইমেলায়।
সম্প্রতি উচ্চ আদালতের রুল অমান্য করে জেলা পরিষদে আওয়ামী নেতাদের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্তি দেয়ার প্রেক্ষিতে বাকশাল আমলের গভর্নরদের কথা নতুন করে মনে পড়ছে। সেসময় অবশ্য গভর্নরদের রাজত্বকাল একেবারেই স্বল্পকালীন হয়েছিল। ডিজিটাল গভর্নরদের পরিণতি আল্লাহই জানেন। তবে একটি সংখ্যার দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের স্থায়িত্ব ছিল সর্বমোট সাড়ে তিন বছরের কিছু বেশি। আগামী মাসের ৬ তারিখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারও তিন বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ২০১২ সাল একটি ঘটনাবহুল, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বছর হতে যাচ্ছে বলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে দেশ-বিদেশের সমালোচনার মুখে সরকারের মধ্যে বিচলিত হওয়ার তেমন কোনো লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। সরকারপ্রধানের বিশ্বস্ত উপদেষ্টাদ্বয় নিয়মিত দিল্লি সফর করে প্রভুদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় শলা-পরামর্শ করে ফিরছেন। বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক মহল থেকে যতই বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, ততই ভারতের ওপর তাদের নির্ভরতা বাড়ছে। দেশের জনগণের মধ্যে এই ধারণা ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে যে, বাংলাদেশ পরিচালনার কৌশল ঢাকায় নয়, দিল্লিতে প্রণীত হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের ভ্রমণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিন বছরের একটি বড় অংশ বিদেশে কাটিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এমন কয়েকটি কথিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশাল লটবহর নিয়ে যোগদান করেছেন, যেখানে অধিকাংশ রাষ্ট্র বড়জোর সচিব পর্যায়ের কোনো এক কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছে। তার প্রতি বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ বছর তিনি আত্মীয়-পরিজন নিয়ে নিউইয়র্কের অন্যতম ব্যয়বহুল ওয়ালডর্ফ-এসটরিয়া হোটেলে উঠেছিলেন। এই সফরে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কত অর্থ ব্যয় হয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও তার কোনো তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমরা পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী বোন, পুত্র-কন্যাদের খরচ কোন খাত থেকে অথবা কোন ব্যক্তি বহন করেছেন, তাও জানা যায়নি। এখানে উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও নিউইয়র্কে ওই একই হোটেলে ছিলেন। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তো বিদেশ ভ্রমণের সেঞ্চুরি অনেক আগেই উদযাপন করে ফেলেছেন। দিনের হিসাব কষলে তার দেশে থাকা এবং বিদেশ ভ্রমণ আধা-আধি হওয়াও বিচিত্র নয়।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় যখন আশঙ্কাজনকভাবে নিম্নমুখী, সেই সময় কর্তাব্যক্তিদের এই বিলাসিতায় জনগণের বিরক্তির উদ্রেক হওয়াটাই স্বাভাবিক। দেশের অর্থনীতির নিম্নমুখী প্রবণতায় আতঙ্কিত হয়ে কট্টর সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত এফবিসিসিআই সভাপতি এ. কে. আজাদ পর্যন্ত সরকারকে বাজেট কাটছাঁট করে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার কোটি টাকা থাকলেও মাত্র পাঁচ মাসেই সেই ঋণ ২১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির চাপে জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। কিন্তু যুগে যুগে নিরোর অনুসারীরা এভাবেই জনগণের দুঃখ-কষ্টকে অবজ্ঞা করে তাদের লুটপাট, অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়ে গেছে। পরিণামে একের পর এক স্বৈরশাসকের ভয়াবহ পতন ঘটেছে। কিন্তু শাসকশ্রেণী ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশেও ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ না করার ইতিহাসেরই সম্ভবত পুনরাবৃত্তি প্রত্যক্ষ করছি।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
সূত্র; আমারদেশ, 21/12/2011

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন