শুক্রবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১১

আওয়ামী লীগের সর্বব্যাপী সহিংসতা

আওয়ামী লীগের সর্বব্যাপী সহিংসতা

॥ সিরাজুর রহমান ॥

একাত্তরের বিজয় দিবস ছিল শত নির্যাতন এবং আত্মত্যাগে ক্লান্ত জনতার স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাস ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ। শেখ মুজিবুর রহমান সে দিন ঢাকায় ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধের গোটা সময়টাও তিনি রণাঙ্গনে ছিলেন না, ২৫ মার্চ রাত সাড়ে দশটার দিকে তিনি আপসে ধরা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরও কেউ পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন না, মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশ নেয়া তো দূরের কথা। তারা ২৫ মার্চ রাতে এবং পরবর্তী দিন-দুয়েকের মধ্যে কলকাতা চলে যান।
স্টেটসম্যান পত্রিকার বার্তা সম্পাদক সন্তোষ বসাক ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারির গোড়ায় আমাকে কলকাতার বিভিন্ন হোটেল ও গেস্ট হাউসে নিয়ে গিয়েছিলেন। দেশত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতারা সেসব হোটেলে থাকতেন এবং যাবতীয় ব্যয়ের ভাউচার (কারো কারো ফুর্তি করার বিলসহ) সই করতেন। সেসব বিল পরিশোধ করত ভারত সরকার। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ নেয়ার আগে তাদের কোনো স্বীকৃত মর্যাদাও ছিল না, তারা ছিলেন একটি বিদেশী রাষ্ট্রের পলাতক রাজনীতিক। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা ভোগ করেছেন তারা। ভারতের আজ্ঞা অমান্য করা বহু আওয়ামী লীগ নেতার পক্ষেই সম্ভব নয়। দেশে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে আর যারা পাকিস্তানিদের হাতে প্রাণ দিয়েছে এবং তাদের নির্যাতন সয়েছে কলকাতায় পলাতক নেতারা তাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ানেরা এবং বিডিআরের সদস্যরা আগে থেকেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস'ত ছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই তারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকেরা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সমর্থকেরা জনসাধারণকে উদ্দীপিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। ছাত্র-অছাত্র তরুণেরা ঘর ছেড়ে চলে গেল মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। সাধারণ শ্রমজীবী ও সংসারী মানুষ যথাসাধ্য হানাদার বাহিনীর সাথে অসহযোগিতা ও প্রতিরোধ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তারা আশ্রয় দিয়েছেন, নিজেদের থালার ভাত তাদের সাথে ভাগ করে খেয়েছেন। বিনিময়ে বহু নির্যাতন-নিপীড়ন তারা সহ্য করেছেন। অনেকে প্রাণ দিয়েছেন, বহু নারী হয়েছেন নিগৃহীত। একাত্তরের বিজয় দিবসে উল্লাস করেছেন তারা।
কিন' কয়েক দিনের মধ্যেই সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেল। তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ের গর্তগুলোর মোটামুটি মেরামতের কাজ শেষ হতেই কলকাতার বিলাসব্যসন ছেড়ে আওয়ামী লীগ নেতারা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানে উড়ে এলেন। এসেই নতুন স্বাধীন দেশের মালিকানা দাবি করলেন তারা, আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার গঠন করলেন। শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন হয়ে ঢাকা গেলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, তারপর তিনি হলেন একচ্ছত্র অধিপতি। জাসদ ও ন্যাপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীরা একটা জাতীয় সরকার গঠনের ক্ষীণ দাবি তোলেন। জবাবে শেখ মুজিব ‘লাল ঘোড়া দাড়াইয়া দিব’ ঘোষণা দিলেন। রক্ষীবাহিনী ৪০ হাজার জাসদ ও অন্যান্য দলের কর্মীকে হত্যা করল। নিহত নেতাদের একজন ছিলেন সিরাজ শিকদার। গ্রেফতারের পর পিঠে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। অন্তত আরো পাঁচ বছর যাতে মুজিবের রাজনৈতিক বিরোধিতা না থাকে সেটা নিশ্চিত করার জন্য ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে একটি বিতর্কিত ও বিভাজক মেয়াদ-মধ্য নির্বাচন করা হলো। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলার সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয়।

বাংলাদেশের বড় ট্র্যাজেডি
বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসের এটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় ট্র্র্যাজেডি। আরো বহু ট্র্যাজেডি ঘটেছে, কিন' সেসবেরই উৎস হচ্ছে এখানে। আওয়ামী লীগ সেই যে ‘যা কিছু পাই লুটেপুটে খাই’ পথ ধরেছে তার তীব্রতা ক্রমেই বেড়ে গেছে। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে ভারত থেকে ফিরেই ঘোষণা দিলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সেনা অভ্যুত্থান ও মুজিব হত্যার পরবর্তী বিক্ষুব্ধ পরিসি'তিতে যারাই রাষ্ট্র তরণীর হাল ধরেছিলেন, দেশটার অস্তিত্ব কোনো মতে টিঁকিয়ে রেখেছিলেন, তারা সবাই খুনি। কিন' সে সময় তাদের দক্ষতা ও বিচক্ষণতা ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্বই যে ধুয়েমুছে যেতে পারত, সে কথা বিবেচনা করার মতো বিচক্ষণতা আওয়ামী লীগ নেত্রী দেখাতে পারেননি।
শেখ হাসিনা রাজনৈতিক বিরোধীদের ‘চোর চোর’ বলে অভিযোগ তোলেন। কিন' বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপান ও অন্য দাতা দেশগুলো এ সরকারকেই চোর বলছে, চুরির তদন্ত ও অবসান না হলে তারা বাংলাদেশকে আর ঋণ দিতে অস্বীকার করছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে তিনি নতুন বছরে বাংলাদেশ সফরের পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা নেই, ‘সব কুচ ঠিক হায়’।
তিনি ছেলেপুলে, আর সভাসদ নিয়ে প্রায়ই বিদেশে কারণে-অকারণে ভ্রমণে যাচ্ছেন, দু’হাতে বিদেশী মুদ্রা উড়াচ্ছেন। এ দিকে তার অর্থমন্ত্রী দফায় দফায় নানাভাবে বলে যাচ্ছেন অর্থনীতির বারোটা বেজে গেছে, নাভিশ্বাস উঠেছে।
বাংলাদেশ এখন এমনভাবে চলছে যেন একজনই এর অধিশ্বর। তার নির্দেশে একটা ফ্যাসিস্ট সংগঠন বাহুবলে, অস্ত্রবলে সব গণতান্ত্রিক শক্তির টুঁটি টিপে মারার চেষ্টা করছে। ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’, ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ‘, ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর’ ইত্যাদি ধরনের বহু সার্থক উপমাকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আরো অর্থবহ করে তুলেছেন। দেশে ইদানীং ছিনতাই, গুম-খুন ইত্যাদি ভয়ঙ্কর রকম বেড়ে গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে গুম ও খুন হচ্ছেন বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী, তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন, সব কিছুর জন্যই দায়ী খালেদা জিয়া, কেননা তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করতে চান। খালেদা জিয়া তার সমর্থকদের খুন করাচ্ছেন- এ কথা শুধু উন্মাদেই বিশ্বাস করবে।
এ কথা শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ নেতারা স্বীকার করতে চান না- যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রথম এবং প্রধান বিরোধী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধের প্রথম কাতারে পড়ে অপরাধী শত্রুপক্ষের সৈন্যরা। একাত্তরের হামলায় যে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য অংশ নিয়েছিল তাদের মধ্যে ১৯৫ জনকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধাপরাধী বলে শনাক্ত করা হয়েছিল; কিন' শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মুক্তি দিয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিল পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা দূর করে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। স্বদেশে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন সামাজিক শান্তি ও সদ্ভাব স'াপনের লক্ষ্যে। তার সে উদ্যোগ তখন আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন' বর্তমান আওয়ামী লীগ মুজিবের আওয়ামী লীগ নয়; বরং হিটলারের নাৎসিদের সাথেই এ দলের তুলনা চলে। একাত্তরের রাজাকার-আলবদরদের অনেকে আওয়ামী লীগে ঢুকে গেছেন। কেউ কেউ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সাথে আত্মীয়তা গড়ে তুলেছেন। তাদের গায়ে কেউ টোকা দেয় না।
বর্তমানে বাংলাদেশে কী ঘটছে? হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের একদলীয় বাকশালী স্বৈরতন্ত্রের মতো একটি স্বৈরশাসন স'াপন করতে চান। মুজিব তিন মিনিটে সংবিধান সংশোধন করে বাকশাল করেছিলেন, আজীবন রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে নিজেকে সাত বছরের জন্য নির্বাহী রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেছিলেন। সংসদে আপত্তি করার মতো সৎ সাহস কারো ছিল না। কিন' বাংলাদেশের মানুষ তখনো প্রতিবাদ করেছেন, এখনো করছেন। পঁচাত্তরের সাথে তফাৎ এখানে যে অনেক পুড়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রীরা খাঁটি সোনা হয়েছেন, তারা সক্রিয় প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করছেন। এ সরকারের সেটা সহ্য হচ্ছে না। হিটলারের স্টর্ম ট্রুপার আর গেস্টাপোর মতো আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডার, আর সম্পূর্ণ দলীয়কৃত পুলিশ-র‌্যাব উপলক্ষ পেলেই গণতন্ত্রীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সমস্যা হচ্ছে, কে পুলিশ আর কে পুলিশ নয় বোঝার উপায় নেই। তবে তারা বিরোধীদের নির্যাতন করছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কেউ ইউনিফর্ম পরছে, আর কেউ পরছে না- তফাৎ শুধু এখানে।

বিজয় দিবস- তখন এবং এখন
একাত্তরে যে বিজয় দিবস ছিল সংগ্রামী-অসংগ্রামী জনতার, সে বিজয়কে এবং সে বিজয় দিবসকেও ওরা ছিনিয়ে নিতে চায়। এবারের বিজয় দিবসের বিশেষ তাৎপর্য ছিল, এটা ছিল মুক্তির ৪০তম বার্ষিকী। কিন' সে বিশেষ অনুষ্ঠানের পবিত্রতা নষ্ট করে দিয়েছে আওয়ামী লীগের লোকজন। আগের দিন (১৫ ডিসেম্বর) জাতীয় স্মৃতিসৌধের পথে ব্যানার আর ফেস্টুন লাগিয়েছিল আওয়ামী লীগ আর বিএনপির কর্মীরা এবং অন্যরা। রাতের বেলা শাসক দলের লোকজন বিএনপির ব্যানার আর ফেস্টুনগুলো ছিঁড়ে ফেলে।
বিজয় দিবসের প্রভাতে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যাচ্ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ৯ বছর স'ায়ী এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার আপসহীন সংগ্রাম বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে, তিনবার তিনি জনসাধারণের ভোটে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং বর্তমানেও তিনি বিরোধী দলের নেতা। আওয়ামী লীগের কর্মীরা খালেদা জিয়ার পথরোধ করেন। তাদের ধারণা, শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানাবেন তাদের নেত্রী, বিএনপির নেত্রী নন। সারা দেশে বিএনপির বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে, খুনখারাবি আর ভাঙচুর করেছে এরা। অর্থাৎ গণতন্ত্রের জন্য, স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিলো, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অধিকারও আওয়ামী লীগ ছিনিয়ে নিলো। ওই যে বলছিলাম : যা কিছু পাই লুটেপুটে খাই।
আসলে শহীদদের, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা আওয়ামী লীগের একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার মাত্র- অনেকটা তাদের লগি-লাঠি-বৈঠারই মতো। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয়, লাখে লাখে তারা মুক্তিযুদ্ধের সনদ দিচ্ছেন এমন লোকদের ১৯৭১ সালে যাদের অনেকের জন্মই হয়নি। তারা আশা করছেন, এ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা তাদের রাজনৈতিক ক্যাডারভুক্ত হবেন, নিদেন তাদের ভোট দেবেন।
গত রোববার বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। দেশের বিভিন্ন স'ান থেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেটা সরকারের এবং শাসক দলের সহ্য হয়নি। দেশজুড়ে একটা ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিল তারা। ঢাকার পথে যেসব বাসে মুক্তিযোদ্ধারা এসেছিলেন আওয়ামী পুলিশ তাদের গতিরোধ করেছে, আওয়ামী লীগের লোকেরা দলীয়কৃত পুলিশের প্রটেকশনে থেকে সেসব বাস ভাঙচুর করেছেন, আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন যানবাহনে। তারপর পুলিশ তাদের প্রভুদের নির্দেশে গণ্ডা গণ্ডা মামলা রুজু করেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

ফ্যাসিবাদী তাণ্ডব
আরো ভয়ঙ্কর তাণ্ডব সৃষ্টি হয়েছিল দেশের রাজধানীতে। যারা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে যাচ্ছিলেন তাদের ওপর লাঠিপেটা করা হয়েছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে, দলের নেতাকর্মীদের নিজেদের দফতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ভীতি প্রদর্শনের জন্য সে দফতরের সামনে বোমা ফাটানো হয়েছে। গোড়া থেকেই এ সরকার বিএনপিকে সব ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। সভা কিংবা সমাবেশ করার স'ান তাদের দেয়া হচ্ছে না, তারা মিছিল করলে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা ও পুলিশ সেসব মিছিলে চড়াও হচ্ছে, যখন-তখন বিএনপির দফতর ঘেরাও করা হচ্ছে, কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেয়া হচ্ছে সে দফতর। কিন' কেন? দেশে কি এখন রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস'া আছে? বিএনপি কি কোনো নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল? তাই প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে- কোন যুক্তিতে আর কোন অধিকারে সরকার এসব জঘন্য ফ্যাসিবাদী কাণ্ডকারখানা করছে?
একাত্তরে পাকিস্তানিরা অস্ত্রবলে বাংলাদেশকে পদাবনত রাখতে চেয়েছিল। তাদের সৈন্যরা মানুষ হত্যা করেছে, নারী নির্যাতন করেছে। তাদের ঘাতকেরা মানুষ ছিনতাই করেছে, গুম করেছে, খুন করেছে। তার সাথে আজকের বাংলাদেশের কোনো তফাৎ আছে কি? একটি ফ্যাসিবাদী দল চিরস'ায়ীভাবে ক্ষমতা দখল করে রাখতে চায়। দলীয়কৃত পুলিশ ও র‌্যাব গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হামলা করছে, নিরীহ মানুষও হত্যা করছে তারা। কারা গত বছর ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার আলম চৌধুরীকে অপহরণ করেছিল? অদ্যাবধি তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে অপহরণ আর গুপ্তহত্যা বেড়েই চলেছে। গত দু-তিন মাসে গুম-খুনের যেন তাণ্ডব চলছে। বিজয় দিবসের ৪০তম বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের সর্বব্যাপী সহিংসতা চরমে উঠেছে।
(লন্ডন ২১-১২-১১)
serajurrahman@btinternet.com

 সুত্র: নয়াদিগন্ত, 23/12/2011

বুধবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১১

নিরোরা সর্বকালেই বাঁশি বাজায়

নিরোরা সর্বকালেই বাঁশি বাজায়

মাহমুদুর রহমান
 
রোমান সম্রাট নিরোর গল্প পাঠকদের অনেকেই হয়তো জানেন। এই অত্যাচারী রাজা খ্রিস্টাব্দ ৬৪-তে সৈন্য-সামন্ত লাগিয়ে তারই সাম্রাজ্যের রাজধানী রোম নগরীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আগুন লাগানোর পেছনে দু’টি উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমটি হলো নিরোর প্রাসাদ তৈরির জন্য বিশাল জায়গার প্রয়োজন হয়েছিল। পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করেই সেই জায়গার ব্যবস্থা করেছিলেন রোমান সম্রাট। আর দ্বিতীয় কারণ হলো রাজধানীর নাগরিকরা ক্রমেই প্রতিবাদী হয়ে উঠছিলেন, তাদের শায়েস্তা করতেও এই বহ্ন্যুত্সব। বলা হয়ে থাকে, রোম যখন আগুনে পুড়ে ছারখার হচ্ছিল তখন সম্রাট নিরো নাকি মনের ফুর্তিতে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। সম্রাট নিরো মানুষ হত্যা করতেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ইতিহাসের বইয়ে পড়েছি, তিনি নাকি নিজের মাকেও হত্যা করেছিলেন। তার অপশাসনে অতিষ্ঠ রোমানদের গণঅভ্যুত্থানের মুখে নিরো শেষপর্যন্ত ৬৮ খ্রিস্টাব্দে আত্মহত্যা করে জনরোষ থেকে রক্ষা পান।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, প্রায় দুই হাজার বছর অতিক্রান্ত হলেও সেই নিরো আজ অবধি দেশে দেশে অত্যাচারী, গণবিরোধী শাসকদের কাঁধে প্রেতাত্মা হয়ে দিব্যি বেঁচে-বর্তে আছেন। বাংলাদেশের বর্তমান শাসকশ্রেণীর কাজ-কারবার দর্শনে এবং অম্লান বদনে মিথ্যাচার শ্রবণে নিরোর কথা ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে যায়। মহাজোটের তিন বছরের অপশাসনে বাংলাদেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানো প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এক শেয়ারবাজার থেকেই এক বছরের বাজেটের সমপরিমাণ অর্থ লুট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ফলে অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তো আগেই ফেল মেরেছেন। শেষপর্যন্ত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর অনেক ঢাকঢোল পেটানো প্রণোদনা প্যাকেজেও শেয়ারবাজারে প্রাণ সঞ্চারিত করা যায়নি। যাবেই বা কোত্থেকে! সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তো তিন বছরে নিঃস্ব হয়ে গেছেন।
এদিকে এতই বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে যে, ৭০ টাকার ডলারের সরকারি দাম ৮০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কার্ব মার্কেটে ৮৫ টাকা দিয়েও ডলার মিলছে না। পরিচিত দু-চারজন ব্যাংকার আমাকে জানিয়েছেন সহসাই ডলারের দাম ১০০ টাকা অতিক্রম করবে।
যেসব নির্বোধ বাংলাদেশী সরকারের নানারকম প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে বাড়ি-ঘর বেচে, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ধার-দেনা করে শেয়ারবাজারে টাকা খাটিয়েছিলেন, তারা এখন দল বেঁধে বিক্ষোভ করছেন, বুক চাপড়াচ্ছেন। গত সপ্তাহের প্রথম দিন টেলিভিশন চ্যানেলে এদের কণ্ঠেই স্লোগান শুনলাম, শেয়ারবাজার ধ্বংস কেন—শেখ হাসিনা জবাব চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জবাব দিতে বয়েই গেছে। তিনি ক’দিন আগে পোশাক শিল্পমালিকদের বার্ষিক মেলা বাটেক্সপো উদ্বোধনকালে অম্লান বদনে দাবি করলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নাকি অভাবনীয় উন্নতি হচ্ছে। অথচ একই দিনে সংবাদপত্রে খবর বের হয়েছে যে, কেবল ইউরোপের বাজারেই বাংলাদেশের ৮ হাজার কোটি টাকার তৈরি পোশাকের রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় অবধারিতভাবে শতাধিক কারখানা বন্ধ হবে, হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারাবেন।
দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন রীতিমত বিশ্বব্যাপী জানান দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার প্রথমদিকে উটের মতো বালিতে মুখ গুঁজে একনাগাড়ে বলে গেল, সব কুছ ঠিক হ্যায়। আমরা যারা একটু লেখালেখি করি কিংবা বিশিষ্টজনদের মধ্যে হাতে গোনা দু-চারজন যারা এখনও টেলিভিশন টকশোতে অংশ নিতে পারেন, তাদের অভিযোগের জবাবে একসময়ের সদা হাস্যময় বর্তমানে ক্রুদ্ধ অর্থমন্ত্রী ক্রমাগত বলে গেলেন, রাবিশ, স্টুপিডরা সব বানিয়ে বলছে। থলের বিড়াল শেষপর্যন্ত জনসমক্ষে বেরিয়ে পড়লে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ঘোষণা এলো, বেয়াদব বিশ্বব্যাংকের টাকায় আমাদের দরকার নেই, মালয়েশিয়া সরকার নাকি পদ্মা সেতুর অর্থায়নে সম্মত হয়েছে। ঘোষণাই সার, মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারী লাপাত্তাই থেকে গেল।
এসব গাল-গল্পে আর ক’দিন চলে? সরকার উপায় না পেয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফকে সন্তুষ্ট করার জন্য যোগাযোগ মন্ত্রণালয় দুই ভাগ করে ‘বাণীর রাজা’ ওবায়দুল কাদেরকে এক ভাগ এবং এক-এগারোর অন্যতম ‘সংস্কার প্রস্তাবক’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে অন্যভাগ দিলেন। আর বহুল আলোচিত-সমালোচিত আবুল হোসেন হয়েছেন ডিজিটাল মন্ত্রী। বাণীর রাজা মন্ত্রিত্ব পেয়েই দাবি করলেন, সব সমস্যা মিটে গেছে। বিদেশ থেকে ডলারের বস্তা এলো বলে! একটা নয়, এবার দু’টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হবে। নতুন সড়ক মন্ত্রীর দাবির প্রতিধ্বনি ইথারে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সর্বশেষ বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউ টার্ন নিয়ে নতুন সংবাদ দিলেন। তার নতুন থিওরি হচ্ছে, সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্বের (PPP) মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মিত হবে! তিনিও বোধহয় দু’টি সেতুর কথাই বললেন। কত আর টাকা লাগবে? মাত্র ষাট-সত্তর হাজার কোটি টাকারই তো মামলা। শেয়ারবাজার থেকে যে গোষ্ঠী লক্ষ কোটি টাকারও অধিক লুটে নিয়ে গেছে, তারা যদি প্রধানমন্ত্রীকে সেই টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে দেবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন, তাহলে আমার কিছু বলার নেই। লুটপাটের টাকা তো আপনজনদের কাছেই রয়েছে। সরকারের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে লুটের একটি অংশ ফেরত দেয়া তো তাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব জয় যুক্তরাষ্ট্রে গতকাল ঘোষণা দিয়েছেন যে বিশ্বব্যাংকের অর্থের আর কোনো প্রয়োজন বাংলাদেশের নেই। বেসরকারি খাতের টাকায় কেবল দুটো পদ্মা সেতুই নয়, তার নানার নামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও নাকি নির্মিত হবে। সজীব জয় সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে উপরিউক্ত ঘোষণা দিয়ে থাকলে প্রধানমন্ত্রীর নিশ্চিন্ত বোধ করাটাই স্বাভাবিক।
তবে সেরকম কিছু না হয়ে থাকলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বর্তমান শাসককুল দেশের ষোলো কোটি নাগরিককে এতখানি গর্দভ ঠাওরাবেন না যে, এসব গাঁজাখুরি বক্তব্যে তারা বারবার প্রতারিত হবেন। সরকারের প্রথম দুই বছরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় উক্তি ছিল, আমার মন্ত্রিসভার সব সদস্য এতই দুধে ধোয়া যে, তাদের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত দুর্নীতির কোনো অভিযোগ পর্যন্ত উত্থাপিত হয়নি। তৃতীয় বছরে যখন দুর্নীতির অভিযোগের ঠেলায় কান পাতা যাচ্ছে না, তখন একই প্রধানমন্ত্রী রাগতকণ্ঠে বলছেন, দুর্নীতির অভিযোগ তুললেই হবে না, বিশ্বব্যাংককে সেটা প্রমাণ করতে হবে। বিএনপির ব্যাপারে নীতি অবশ্য আলাদা। তাদের ক্ষেত্রে যে কোনো আওয়ামী পত্রিকায় অভিযোগ ছাপা হওয়াটাই প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনায় দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ। মহাজোটের আমলে ‘কাপট্য’ শব্দটিকেই মনে হচ্ছে বাংলা অভিধান থেকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশ চতুর্মুখী বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনীতি তো রসাতলে গেছেই, মানুষের জীবনেরও কোনো নিরাপত্তা নেই। আগে ক্রসফায়ারে তো তবু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের এক ধরনের দায়িত্ব গ্রহণ করত। গুম-খুনের ক্ষেত্রে সেই বালাইও উঠে গেছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও গুলিবিদ্ধ অথবা অন্য কোনো উপায়ে নিহতদের লাশ ভেসে উঠছে। সরকারের বিভিন্ন তরফ থেকে এসব হত্যাকাণ্ডের কোনো ব্যাখ্যা নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক কথার মানুষ। তিনি তোতা পাখির মতো বলেই চলেছেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো। এখানে থামলেও সাহারা খাতুন ভালো করতেন। কিন্তু পরবর্তী বাক্যে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। রণচণ্ডী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, দেশে গুম-খুন হচ্ছে নাকি? সংবাদপত্রে পড়ার আগে আমি তো এসব জানতামই না! পুলিশ প্রধান হাসান খন্দকারও সচরাচর রাজনীতিকের ভাষাতেই কথা বলে থাকেন। তার দাবি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। আইজিপি’র দাবি না হয় আমরা মেনেই নিলাম। তারপরও তো কথা থাকে। কারা এসব গুম-খুন ঘটাচ্ছে, সেটা তো অন্তত তিনি বলবেন। না কি তার সেই দায়িত্বও নেই?
নরসিংদীর জনপ্রিয় পৌর মেয়র আওয়ামী লীগের লোকমান হোসেন তারই দলীয় মন্ত্রীর ভাইয়ের প্রাইভেট বাহিনীর হাতে নিহত হলে লোকমান হোসেনের পরিবার হত্যাকারীদের নাম সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে মামলা দায়ের করে। এজাহারে নাম না থাকা সত্ত্বেও বিএনপি নেতা খায়রুল কবীর খোকনকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হলেও পুলিশ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা আসামি টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজুর ছোট ভাইকে আদালত প্রাঙ্গণে চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে দেখেও গ্রেফতার না করে বরং পলায়নে সহায়তা করে। আইজিপিকে এ ব্যাপারে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বিশেষ কৌশলগত কারণেই মন্ত্রীর ভাইকে গ্রেফতার করা হয়নি। পুলিশের সেই অসাধারণ কৌশল সম্ভবত এখনও কার্যকর আছে। কারণ, মন্ত্রীর ভাইয়ের বর্তমান অবস্থান দেশবাসীর অজানা। কৌশলগত কারণে আইজি’র পুলিশ হয়তো তাকে এতদিনে সীমান্ত পার করে ভারতের ‘সেফ হোমে’ পাঠিয়েও দিয়েছে। দেশের অধিকাংশ মানুষ অবশ্য মনে করে, বিরোধী দলের আন্দোলনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেতে দেখে আতঙ্কিত সরকার আন্দোলন প্রতিহত করার কৌশল হিসেবে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাদের গুম-খুন শুরু করেছে। ক’দিন আগে কুষ্টিয়ার ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপি সভাপতিকে এই রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে উঠিয়ে নিয়ে হত্যা করে তার লাশ গাজীপুর জাতীয় উদ্যানের শাল-গজারির বনে ফেলে দেয়া হয়েছে। পুলিশ, র্যাবকে তার অপহরণের কথা জানানো হলেও তারা বিষয়টিকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। গুম-খুনের সংখ্যা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, মহাজোটের প্রতি সহানুভূতিশীল পত্রিকা প্রথম আলো এবং কট্টর সরকার সমর্থক সমকাল পর্যন্ত গুম-খুন নিয়ে লিড স্টোরি করতে বাধ্য হয়েছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতার সংবাদ ক্রমেই বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশের বিজয়ের ৪০ বছর প্রসঙ্গে আলোচনাকালে এদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর জোট ‘দি এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (আফাদ)’ বাংলাদেশে গুম-খুনের ঘটনা বৃদ্ধিতে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে তাদের উদ্বেগ জানিয়েছে। আফাদ-এর সভাপতি মুগিয়ান্তো ও সম্পাদক আইলিন বাকালসো স্বাক্ষরিত ডিসেম্বরের ১৬ তারিখের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘গুমের ঘটনার সাম্প্রতিক বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনক।’ বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা, দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির চর্চা ও ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার চিত্র আবারও এই পরিস্থিতি সামনে নিয়ে এসেছে।
গুম-খুন নিয়ে স্বভাবসুলভ কায়দায় সর্বশেষ বোমাটি ফাটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি দাবি করেছেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে বিএনপিই নাকি এসব গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সভায় বক্তৃতাকালে তিনি নাজমুল হত্যাকাণ্ডের জন্য পরোক্ষভাবে বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য, প্রবীণ রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলামকে দায়ী করেছেন। এই না হলে মহাজোট নেত্রী! এদিকে আমরা যারা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িত রয়েছি, তাদের কাছে প্রতিদিন গুমের খবর আসছে। বিভিন্ন সূত্রে এমন গুজবও শুনছি, একটি এলিট বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধানের নেতৃত্বে ‘ডেথ স্কোয়াড’ গঠন করা হয়েছে। তারা রীতিমত তালিকা করে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ‘ডেথ স্কোয়াড’-এর প্রধান নিজ হাতেও সরকারবিরোধীদের ভবলীলা সাঙ্গ করাচ্ছেন, এ ধরনের কথাও কানে আসছে।
র্যাব (RAB) নামকরণ নিয়েও সাধারণ জনগণ রসিকতা করতে শুরু করেছে। বিএনপি সরকারের আমলে গঠিত তত্কালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরের মস্তিষ্কপ্রসূত সংস্থাটির পুরো নাম হলো র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (Rapid Action Battalion), সংক্ষেপে র্যাব। সেই র্যাবকে লোকজন ঠাট্টা করে এখন বলছে Rakkhi Awami Bahini (রক্ষী আওয়ামী বাহিনী)। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে তত্কালীন শেখ মুজিব সরকার রক্ষীবাহিনী গঠন করে সারাদেশে গুম-খুনের রেকর্ড গড়েছিল। সে সময়ের জাসদ এবং অন্যান্য বামপন্থী দলের প্রায় তিরিশ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করে রক্ষীবাহিনী দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আজকের ক্ষমতাসীন মহাজোটে অবশ্য সেই জাসদের একাংশও রয়েছে। জাসদের একসময়ের জঙ্গি সংগঠন গণবাহিনীর নেতৃবৃন্দ যারা এখন সরকারের সঙ্গে যুক্ত, তাদের কণ্ঠ থেকে ইতিহাস বিকৃতকারী নানারকম বক্তব্য প্রায়ই শুনতে পেয়ে সেই পুরনো প্রবাদের কথা মনে পড়ে যায়, সত্যি সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!
এ বছরের মার্চে জেল থেকে মুক্তির পরদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ ক্রমেই সত্তর দশকের দক্ষিণ আমেরিকার নির্যাতক রাষ্ট্র চিলিতে পরিণত হচ্ছে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলাম। এত তাড়াতাড়ি সেই আশঙ্কা বাস্তবে রূপ পেতে দেখে ব্যথিত হচ্ছি। সালভেদর আলেন্দেকে হত্যাকারী চিলির সেই সময়কার স্বৈরশাসক পিনোশে আজ সারা বিশ্বে এক ঘৃণিত নাম। তার একসময়ের প্রভু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাকে এখন পরিত্যাগ করেছে। হাজার হাজার নাগরিককে গুম-খুনের অভিযোগে বয়সের ভারে ন্যুব্জ পিনোশের বিচার চলছে চিলিতে। এই বৃদ্ধ একনায়ককে হয়তো ফাঁসিতে ঝুলতে হবে না। তবে ইতিহাসে একজন খলনায়ক রূপেই লোকটি চিত্রিত হয়ে থাকবে। ফ্যাসিজমের আগমন আশঙ্কায় ‘নবরূপে বাকশাল’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম ২০০৮ সালের নভেম্বরে। ওই নামে আমার একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে এ বছর বইমেলায়।
সম্প্রতি উচ্চ আদালতের রুল অমান্য করে জেলা পরিষদে আওয়ামী নেতাদের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্তি দেয়ার প্রেক্ষিতে বাকশাল আমলের গভর্নরদের কথা নতুন করে মনে পড়ছে। সেসময় অবশ্য গভর্নরদের রাজত্বকাল একেবারেই স্বল্পকালীন হয়েছিল। ডিজিটাল গভর্নরদের পরিণতি আল্লাহই জানেন। তবে একটি সংখ্যার দিকে দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের স্থায়িত্ব ছিল সর্বমোট সাড়ে তিন বছরের কিছু বেশি। আগামী মাসের ৬ তারিখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারও তিন বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ২০১২ সাল একটি ঘটনাবহুল, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ বছর হতে যাচ্ছে বলেই সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
রাষ্ট্র পরিচালনা নিয়ে দেশ-বিদেশের সমালোচনার মুখে সরকারের মধ্যে বিচলিত হওয়ার তেমন কোনো লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। সরকারপ্রধানের বিশ্বস্ত উপদেষ্টাদ্বয় নিয়মিত দিল্লি সফর করে প্রভুদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় শলা-পরামর্শ করে ফিরছেন। বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক মহল থেকে যতই বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, ততই ভারতের ওপর তাদের নির্ভরতা বাড়ছে। দেশের জনগণের মধ্যে এই ধারণা ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে যে, বাংলাদেশ পরিচালনার কৌশল ঢাকায় নয়, দিল্লিতে প্রণীত হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের ভ্রমণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিন বছরের একটি বড় অংশ বিদেশে কাটিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এমন কয়েকটি কথিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশাল লটবহর নিয়ে যোগদান করেছেন, যেখানে অধিকাংশ রাষ্ট্র বড়জোর সচিব পর্যায়ের কোনো এক কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছে। তার প্রতি বছর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ বছর তিনি আত্মীয়-পরিজন নিয়ে নিউইয়র্কের অন্যতম ব্যয়বহুল ওয়ালডর্ফ-এসটরিয়া হোটেলে উঠেছিলেন। এই সফরে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কত অর্থ ব্যয় হয়েছে, অনেক চেষ্টা করেও তার কোনো তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমরা পাইনি। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী বোন, পুত্র-কন্যাদের খরচ কোন খাত থেকে অথবা কোন ব্যক্তি বহন করেছেন, তাও জানা যায়নি। এখানে উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও নিউইয়র্কে ওই একই হোটেলে ছিলেন। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তো বিদেশ ভ্রমণের সেঞ্চুরি অনেক আগেই উদযাপন করে ফেলেছেন। দিনের হিসাব কষলে তার দেশে থাকা এবং বিদেশ ভ্রমণ আধা-আধি হওয়াও বিচিত্র নয়।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় যখন আশঙ্কাজনকভাবে নিম্নমুখী, সেই সময় কর্তাব্যক্তিদের এই বিলাসিতায় জনগণের বিরক্তির উদ্রেক হওয়াটাই স্বাভাবিক। দেশের অর্থনীতির নিম্নমুখী প্রবণতায় আতঙ্কিত হয়ে কট্টর সরকার সমর্থক হিসেবে পরিচিত এফবিসিসিআই সভাপতি এ. কে. আজাদ পর্যন্ত সরকারকে বাজেট কাটছাঁট করে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। বর্তমান অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ১৮ হাজার কোটি টাকা থাকলেও মাত্র পাঁচ মাসেই সেই ঋণ ২১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির চাপে জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। কিন্তু যুগে যুগে নিরোর অনুসারীরা এভাবেই জনগণের দুঃখ-কষ্টকে অবজ্ঞা করে তাদের লুটপাট, অত্যাচার, নির্যাতন চালিয়ে গেছে। পরিণামে একের পর এক স্বৈরশাসকের ভয়াবহ পতন ঘটেছে। কিন্তু শাসকশ্রেণী ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশেও ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ না করার ইতিহাসেরই সম্ভবত পুনরাবৃত্তি প্রত্যক্ষ করছি।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
সূত্র; আমারদেশ, 21/12/2011

মাহমুদুর রহমান

সিরাজুর রহমান

আওয়ামী রাজাকারদের গুম-খুনের আড়ালে

আওয়ামী রাজাকারদের গুম-খুনের আড়ালে

সি রা জু র র হ মা ন
পঁচিশ মার্চ (১৯৭১) রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অমানুষিক বর্বরতার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে পাকিস্তানিরা অনেক ফরমান জারি করে। তার মধ্যে বিবিসির অনুষ্ঠান শোনা, বিবিসিকে সংবাদ পাঠানো এবং বিবিসির সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষিত হয়। বাংলাদেশে তখন বিবিসির সংবাদদাতা ছিলেন নিজাম উদ্দিন আহমেদ। অসমসাহসিক সাংবাদিক ছিলেন তিনি। নানাভাবে সংবাদ সংগ্রহ করে বিভিন্ন উপায়ে এবং প্রায়ই সাঙ্কেতিক ভাষায় সেসব সংবাদ তিনি আমাদের পাঠাতেন।
নিজাম উদ্দিনের স্ত্রী ১৪ নভেম্বর সকালে বিবিসিতে আমাকে টেলিফোন করেন। কান্নাভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, আগের রাতে তাঁরা যখন খেতে বসেছিলেন কয়েকজন মুখোশপরা লোক তাঁদের বাড়িতে ঢোকে এবং নিজাম উদ্দিনকে পিঠমোড়া হাত আর চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া সংবাদদাতা রনি রবসন তখন ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থান করছিলেন। তিনি মিসেস নিজাম উদ্দিনকে আশ্বাস দেন, তাঁর বন্ধু গভর্নর রাও ফরমান আলীকে বলে তিনি নিজাম উদ্দিনকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাড়িয়ে আনবেন। নিজাম উদ্দিনকে আর কখনও পাওয়া যায়নি। সে রাতে রবসন রাও ফরমান আলীর সঙ্গে ডিনার খান এবং পরদিন দিল্লিতে ফিরে যান।
সেদিন আরও অনেক ছিনতাই ও হত্যার খবর পেয়েছিলাম এবং বিবিসি থেকে প্রচার করেছিলাম। সিরাজুদ্দিন হোসেন, আবু তালেব খোন্দকার, শহিদুলল্গাহ কায়সার...। এঁরা সবাই আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। পরে আরও অনেকের নিখোঁজ হওয়া এবং মৃত্যুর খবর শুনেছি। স্বাধীনতার পর মিরপুরে এবং অন্য বহু স্থানে স্তূপাকৃতি নরকঙ্কালের ছবি দেখেছি মিডিয়ায়। ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে (১৯৭২) ভারতীয় ট্যাক্সি ভাড়া করে কলকাতা থেকে যশোরে আসি। আমার সঙ্গে ছিলেন ডেনমার্কের ‘ইনফরমেশন’ পত্রিকার সম্পাদক এবং বিশিষ্ট বেতার ভাষ্যকার পল নিলসেন। যশোর-খুলনা সড়কের মোড়ে নিচু একটা জায়গায় কঙ্কালের স্তূপ দেখে আমরা আঁেক উঠেছিলাম, হাড়গুলো ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। সব ক্ষেত্রেই পাকিস্তানিদের ভাড়াটে খুনিরা বুদ্ধিজীবীদের ছিনতাই করে গলাকেটে কিংবা গলাটিপে খুন করেছে এবং লাশগুলো কোনো জলা জায়গায় ফেলে দিয়েছিল।
পরে আমরা জেনেছিলাম, পাকিস্তানিরা ১৫ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করবে বলে স্থির করেছিল, কিন্তু মার্কিন নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দিতে আত্মসমর্পণ একদিন পিছিয়ে দেয়া হয়। আমি অনেক ভেবেছি এ বিষয়টা। পাকিস্তানিরা যখন জানতই যে তারা ১৫ তারিখে আত্মসমর্পণ করবে, তখন ১৩-১৪ তারিখে এতজন বুদ্ধিজীবীকে খুন করানোর কী প্রয়োজন ছিল তাদের? এখন আমি স্থির সিদ্ধান্তে এসেছি যে দুটো কারণ ছিল তাদের। ২৫ মার্চ রাতে চিন্তানায়কদের হত্যা করে তারা বাংলাদেশীদের মুক্তিচেতনা ঠেকাতে পারেনি। দ্বিতীয় দফায় বুদ্ধিজীবীদের নিধন করে তারা বাংলাদেশকে যোগ্য নেতৃত্ববিহীন করে দিতে চেয়েছিল, যাতে অযোগ্য নেতৃত্ব নিয়ে স্বাধীনতা পেয়ে পরে তারা পস্তায়, স্বাধীনতা যেন তাদের গলায় ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয়ত, পরাজয়ের অপমানের জন্য তারা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল; বুদ্ধিজীবীদের নিধন করে তারা শেষ মরণ কামড় দিয়ে গেছে।
বিজয় দিবসের ৪০তম বার্ষিকী এলো আর গেল। স্বভাবতই ইন্টারনেটে বিগত কয়েকদিনের বাংলাদেশী পত্র-পত্রিকা লক্ষ্য করছিলাম। এই ক’দিনে কেবলই আমার মনে হচ্ছিল, বাস্তবেও আমরা একাত্তর সালের মধ্য-ডিসেম্বরে ফিরে গেছি। ১৪ ডিসেম্বরের পত্রিকা থেকে একটা শিরোনাম : ‘হাত-পা বেঁধে মাথায় গুলি : ধলেশ্বরীতে আরও তিন লাশ : তিনদিনের ব্যবধানে উদ্ধার ৬।’ ১৫ ডিসেম্বরের এক শিরোনাম : ‘১২ ঘণ্টায় বিএনপির নেতাসহ আরও চার লাশ : যশোরে ১৭ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকল বিএনপি : আরও পাঁচজন নিখোঁজ।’ বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরের এক শিরোনাম : ‘মুন্সিগঞ্জে পুলিশের ধারণা : বুড়িগঙ্গা দিয়ে আট লাশ এসেছে।’ ১৭ ডিসেম্বরের শিরোনাম : ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রকে নদীতে ফেলে হত্যা।’
একই সঙ্গে পত্রিকায় পড়লাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে ভালো। মনে পড়ল কিছুদিন আগে এক বাংলাদেশী বলেছিলেন, বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু অপদার্থই নন, তিনি মুখ খুললেই অসত্যগুলো দুর্গন্ধের মতো ছড়াতে থাকে। সাহারা খাতুন ‘বিশ্ব বেহায়া’ খেতাবের জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছেন কিনা কে জানে? আর প্রধানমন্ত্রী? তিনি বলছেন, গুম-খুনগুলো করছে বিএনপি। নিজের দোষ পরের ঘাড়ে চাপাতে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জুড়ি পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ওপরের কয়েকটা শিরোনামের উদ্ধৃতি থেকে আপনাদেরও কি মনে হচ্ছে না যে, বাংলাদেশে এখন একাত্তরের মধ্য-ডিসেম্বরের ট্র্যাজেডিগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটছে? তফাত্ এখানে যে বর্তমান ট্র্যাজেডি ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসেই শুরু হয়েছে এবং বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে সবক নিয়েছে পাশের দেশ থেকে—যেমন সব ব্যাপারেই তারা নিয়ে থাকে। ষাটের দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গে দু’টি বামপন্থী আন্দোলন সক্রিয় ছিল। মার্কসবাদী কমিউনিস্টরা (সিপিএম) সে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের আন্দোলন চালাচ্ছে, একই সঙ্গে নক্সালবাড়ি থেকে উদ্ভূত একটি সর্বহারা আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠছিল। মুখ্যমন্ত্রী অজয় কুমার মুখার্জির ও ’৭১-৭২ প্রেসিডেন্টের শাসনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর গুলিতে বহু বামপন্থী নিহত হয়েছে। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ১৯৭২ সালে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নতুন কৌশল অবলম্বন করলেন। নিরাপত্তা বাহিনী গুলি করে সরকার-বিরোধীদের হত্যা করলে দেশে-বিদেশে সমালোচনা হয়। সিদ্ধার্থ রায়ের সময় থেকে কংগ্রেসের ভাড়াটে খুনিরা গলায় গামছা পেঁচিয়ে হাজার হাজার বামপন্থীকে (নক্সাল ও সিপিএম) হত্যা করেছে। রোজ সকালে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ‘গামছা কিলিংয়ের’ বহু লাশ পাওয়া যেত।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিরোধী শক্তিগুলোকে নিধন করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল প্রথম দিন থেকে। ১৯৯৬ সালে গঠিত শেখ হাসিনার সশস্ত্র ক্যাডারগুলো তো ছিলই। তার ওপর ছাত্রলীগ, যুবলীগ, হেন লীগ ও তেন লীগের গুণ্ডারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর তৃণমূল স্তরের শত শত নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে, অনেকের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে তারা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে খালেদা জিয়ার সরকার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গঠন করেছিল। সে সময় প্রকৃতই আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছিল। শেখ হাসিনার সরকার প্রথম দিন থেকেই প্রশাসন, পুলিশ ও র্যাবের দলীয়করণ করে। আইনশৃঙ্খলার প্রয়োজনে নয়, র্যাব ও পুলিশকে তখন থেকে বিএনপি ও জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ক্রসফায়ার আর গুম-খুন এপিঠ আর ওপিঠ
দিনের পর দিন র্যাব তথাকথিত ক্রসফায়ারে সরকারের বিরোধী কর্মীদের হত্যা করেছে। বিশ্ব মিডিয়া, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং শেষতক বিভিন্ন দেশের সরকার এসব বিচার বহির্ভূত হত্যার সমালোচনা শুরু করলে শেখ হাসিনার সরকার বিদেশে প্রচার চালায় যে, তারা ‘সন্ত্রাসীদের’ নিপাত করছে। সন্ত্রাসী দমনের নামে আসলে তারা বিরোধী পক্ষের কর্মীদেরই নিধন করতে চেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাস, ব্রিটেনে ফাইভ-সেভেন সন্ত্রাস আর ভারতের দিল্লি ও মুম্বাই সন্ত্রাসের পর বিশ্বব্যাপী ‘ইসলামী সন্ত্রাস’ সম্পর্কে একটা আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের আমলে বিচার-বহির্ভূত হত্যা সম্পর্কে গোড়ায় একটা প্রশ্রয়ী মনোভাব দেখা গেছে বিদেশে। কিন্তু বিদেশিরা এখন বুঝে গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিতে ক্ষমতা গ্রাসের জন্য হত্যাকে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ বলে চালানোর অপচেষ্টা করছে। বাংলাদেশে গুম, হত্যা আর নদীতে ভাসমান লাশ যখন পত্র-পত্রিকার প্রধান খবর, তখন হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ইংল্যান্ডের লেস্টার শহরে সভা করে ঘোষণা করলেন, তাঁর সরকার বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমন করছে। কিন্তু রূপসী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অসত্য উক্তিতে এখন আর কারও মন গলবে না।
অর্থাত্ বিশ্ব সমাজ সন্ত্রাস দমনের নামেও ‘ক্রসফায়ারে’ রাজনৈতিক বিরুদ্ধ পক্ষের হত্যাকে সহ্য করতে আর রাজি নয়। আওয়ামী লীগ সরকার তাই টেকনিক পরিবর্তন করেছে, পশ্চিমবঙ্গের গামছা কিলিংয়ের এবং একাত্তরের রাজাকার-আল-বদরদের অনুকরণে এখন গলাটিপে হত্যা এবং লাশ নদীতে ফেলে দেয়ার টেকনিক অনুসরণ করছে এবং এটা সম্পূর্ণ নতুনও নয়। গত বছর ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার আলম চৌধুরী গুম হওয়ার সময় থেকে এ পদ্ধতি শুরু হয়েছে এবং বিগত কয়েক মাসে সেটা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে গেছে।
কিন্তু কেন? আগেই বলেছি, রাজনৈতিক বিরোধী শক্তিকে বিনাশ করে আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসন চিরস্থায়ী করা ছিল হাসিনার নীলনকশা। সে নীলনকশার সর্বশেষ নমুনা দেখা গেছে রাজধানীকে দুই টুকরো করে ফেলা এবং নির্বাচন বন্ধ করে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার রহিত করার মধ্যে, ৬১টি জেলায় নির্লজ্জভাবে বিতর্কিত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের জেলা পরিষদগুলোর প্রশাসক নিয়োগের মধ্যে। এমনকি বিজয় দিবসের ৪০তম বার্ষিকীতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিএনপির ব্যানার-ফেস্টুন ভেঙে দিয়েছে, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান বিরোধী দলের নেত্রীকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে বাধা দিয়েছে। দেশের বহু স্থানে আওয়ামী লীগের গুণ্ডারা বিএনপির সভা-সমাবেশের ওপর হামলা করেছে, বহু অনুষ্ঠান নষ্ট করে দিয়েছে। রাষ্ট্রের গ্রন্থীতে গ্রন্থীতে, পরতে পরতে তারা একদলীয় পদ্ধতি স্থাপন করছে, যাতে তাদের গদিচ্যুত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যতই দিন যাচ্ছে ফ্যাসিস্ট স্বৈরতন্ত্র ততই গেড়ে বসছে, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কাজ ততই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
একাত্তরের মধ্য ডিসেম্বরে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছিল ২০১১ সালের ডিসেম্বরের বাংলাদেশেও ঠিক সেটাই ঘটছে। একাত্তরের রাজাকার ও আল-বদরদের সঙ্গে বর্তমানের আওয়ামী লীগের ভাড়াটে খুনিদের কোনো তফাত্ নেই। তফাত্ এখানে যারা ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করে রাখতে এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের নিধন করতে চায় তাদের সম্পর্কে বিশ্ব সমাজ অনেক বেশি সজাগ হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যা-নির্যাতন চালিয়েছেন এমন বেশ কয়েকজন সাবেক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এখন দ্য হেগের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের কয়েদখানায় বিচারাধীন আছেন। লাইবেরিয়ার চার্লস টেইলার, আইভরি কোস্টের লর্যাঁ বাগবো এবং বসনিয়া হার্সেগোবিনার প্রেসিডেন্ট রাডোভান কারাডিচ ও জেনারেল র্যাটকো ম্লাডিচ তাদের কয়েকজন মাত্র। এ আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোভোদান মিলেসোভিচ। বেঁচে থাকলে লিবিয়ার ডিক্টেটর কর্নেল গাদাফিও খুব সম্ভবত এখন আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে বিচারাধীন থাকতেন।
রাজনৈতিক হত্যা ওদের মজ্জাগত
চূড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশের এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রকৃত অপরাধী কে সে সম্পর্কে দেশবাসীর কোনো সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগ কোনো গণতান্ত্রিক দল নয়—সঠিকার্থেই হিটলারের নািসদের মতো একটি জঙ্গি ও স্বৈরতন্ত্রী সংগঠন। শেখ হাসিনার অভিপ্রায় ছাড়া এ দলে কোনো কিছু হওয়া সম্ভব নয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যায় আওয়ামী লীগ নেত্রীর অনীহা আছে অথবা ছিল বলে কেউ মনে করেন না। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে তিনি ‘একটির বদলে ১০টি লাশ ফেলার’ নির্দেশ দিয়েছিলেন দলীয় নেতাকর্মীদের।
সে সময় খিলগাঁওয়ের চার হত্যার আসামি ড. এইচবি ইকবাল ও তার সহ-খুনিদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়েছে হাসিনার বর্তমান সরকার, লক্ষ্মীপুরের অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম হত্যার এবং নাটোরের গামা হত্যার প্রাণদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের দণ্ডও মওকুফ করে দিয়েছে এ সরকার। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের (স্বয়ং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৫টি দুর্নীতির মামলাসহ) মোট সাত হাজারেরও বেশি মামলা এ সরকার তুলে নিয়েছে, বহু ফৌজদারি মামলাও ছিল তার ভেতর। রাজনৈতিক হত্যা সম্পর্কে এ সরকারের মনোভাবের আর কোনো প্রমাণের প্রয়োজন আছে কি? সংশ্লিষ্টদের সবার শাস্তি পাওয়া মানবতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে অত্যাবশ্যক। ৪০ বছর আগের রাজাকার ও আল-বদরদের বিচারের আগে বর্তমান সময়ের রাজাকার ও আল-বদরদের বিচার অনেক বেশি জরুরি। সাক্ষী-প্রমাণ এখনও নষ্ট হয়নি বলে এদের বিচার অনেক সহজ হবে।
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলগুলোসহ সব গণতান্ত্রিক শক্তির অবশ্যকর্তব্য হবে শেখ হাসিনার সরকারের হত্যা ও নির্যাতনের বিবরণগুলো প্রতি মাসে ঢাকায় জাতিসংঘ দফতরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে এবং সেসব বিবরণের কপি দূতাবাসগুলো এবং সাধ্যমত গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি মিডিয়াগুলোকে পাঠানো। এরই মধ্যে আর বিলম্ব না করে এই অত্যাচারী ও খুনি সরকাকে গদিচ্যুত করার আন্দোলন দুর্বার ও বেগবান করা সব নাগরিকেরই অবশ্যকর্তব্য হবে।
(লন্ডন, ১৮ ডিসেম্বর ২০১১)
serajurrahman@btinternet.com

খবরের কাগজের গল্প বনাম রাস্তার গল্প


খবরের কাগজের গল্প বনাম রাস্তার গল্প

॥ রইসউদ্দিন আরিফ ॥
১. হরতালের নানান হিসাব-নিকাশ : খবরের কাগজের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। একটি দৈনিকে এক বিদগ্ধ কলামিস্ট হরতালের একচেটিয়া বিরুদ্ধাচরণ করে লিখেছেন, ‘এক মাসে ছয় দিন হরতাল করলে যে ক্ষতি হয়, সেই টাকায় দেশের অন্তত দুই কোটি মানুষকে এক মাস খাইয়ে-পরিয়ে সুখে-শান্তিতে রাখা যায় (হরতাল ও লজ্জাশরমের সমীকরণ : আবদুল কাইউম : দৈনিক প্রথম আলো : ১৩ জুলাই ২০১১)। এটা খবরের কাগজের গল্প। এই গল্প হুজুগে বাঙ্গাল মুলুকের মধ্যবিত্ত নাগরিকেরা খুব খায়।
এর বিপরীতে রাস্তার গল্প কিন' অন্য রকম। রাস্তার গল্প হলো- সরকারের যেসব বেজন্মা কার্যকলাপের বিরুদ্ধে (যেমন দুর্নীতি, পুকুরচুরি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, লুটপাট, লাখো কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ তেল-গ্যাস পানির দরে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া, শেয়ারবাজারের হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে বিদেশে পাচার করা, রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করে দেশের ভূখণ্ড ও সমুদ্রবন্দরে বিদেশী শক্তিকে ট্রানজিটের নাম করে করিডোর প্রদান করা, রাষ্ট্রের সংবিধানকে ক্ষমতাসীনদের ‘দলীয় গঠনতন্ত্রে’ পরিণত করা ইত্যাদির বিরুদ্ধে) হরতাল হয়, আর সেই হরতালের উৎস সরকারের এসব দেশবিরোধী-গণবিরোধী কার্যকলাপের কারণে যে ক্ষতি হয়, সেই টাকা দিয়ে দেশের ১০ কোটি দরিদ্র মানুষকে এক মাস নয়, সারা বছর খাইয়ে-পরিয়ে সুখে-শান্তিতে রাখা যায়।
খবরের কাগজের গল্প আর রাস্তার গল্পের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। খবরের কাগজের গল্পের মধ্যে হয়তো যৎকিঞ্চিৎ সত্য আছে। কিন' রাস্তার গল্পের মধ্যে আছে তার চেয়ে অনেক বড় সত্য। বাস্তব কথা হলো, হরতালের কারণে দেশের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, তার চেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশি ক্ষতি হয়, সরকারের যেসব কার্যকলাপের বিরুদ্ধে হরতাল হয়, সে সব কার্যকলাপের কারণে। তার পরও দেশের উঁচুদরের কলামিস্টরা, স্বনামধন্য সুশীলেরা এবং বেনিয়া পট্টির রাঘববোয়ালেরা সরকারের দেশবিরোধী গণবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কথা না বলে অথবা নেহাত দায়সারা গোছের কথা বলে একজোট হয়ে হরতালের বিরুদ্ধাচরণকেই দারুণ কর্তব্যজ্ঞান বলে মনে করেন। এর কারণ স্পষ্ট। হরতাল থেকে হয়তো তাদের পাওয়ার কিছু নেই, বরং হারাবার আছে অনেক। এ দিকে রাস্তার গল্পে আরো বলা হয়, হরতাল তো ঠিকমতো পালন হয় না। ঠিকমতো হরতাল পালন হলে অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা, বাণিজ্য-বেসাতির লেনদেন পুরোপুরি বন্ধ থাকত। তাতে সাধারণ মানুষের কিছুটা ভোগান্তি হলেও শাসক লুটেরা গোষ্ঠীর চুরি, পুকুরচুরি, লুটপাট, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের গলাকাটা ব্যবসায় এসবের কবল থেকে দেশ ও জনগণ অন্তত এক-দুই দিনের জন্য নিরাপদ থাকত। এটাও রাস্তার গল্প এবং এ গল্প খবরের কাগজে ঠাঁই পায় না। এ গল্প হরতালকে উৎসাহিত করার ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা হয়। রাস্তার গল্প এটা মানতে রাজি নয়।
২. দেশ কিভাবে চলছে তার হিসাব-নিকাশ : খবরের কাগজের গল্প অনুযায়ী সরকারদলীয় লোকদের (দলের নেতা-পাতিনেতা ও অস্য-তস্যদের) দৃষ্টিতে দেশ খুব ভালোভাবে চলছে। অর্থনীতিতে ‘প্রবৃদ্ধি’ নামের কুমিরছানা বাড়ছে, আমদানি-রফতানি বাড়ছে (আসলে রফতানির চেয়ে আমদানি বাড়ছে), নগরীর বিলাসবহুল অট্টালিকা-শপিংমলের সংখ্যা বাড়ছে, নতুন নতুন টিভি চ্যানেল হচ্ছে, ফেনসিডিল-হেরোইন-ইয়াবার ব্যবসায়ের উন্নতি হচ্ছে, ডিজুস জেনারেশনের ফুর্তি-ফার্তা বাড়ছে, বহুজাতিক কোম্পানির পণ্য বিক্রির বিজ্ঞাপনের চাকচিক্য বাড়ছে, সরকারি দলের লোকদের শরীরের মেদ ও জেল্লা বাড়ছে। শিশুদের খেলার মাঠ দখল করে সরকারদলীয় লোকদের দালানকোঠা উঠছে। দিনবদল আর ডিজিটাল বাংলাদেশ খুব সুন্দরভাবে চলছে। এগুলোও খবরের কাগজের গল্প।
এর বিপরীতে রাস্তার গল্প শুনুন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি। গল্পটি অনেকের কাছে পাগলের প্রলাপ মনে হতে পারে, কিন' আমার খুব মনে ধরেছে। আপনাদেরও খুব মনে ধরবে। এই সেদিন নগরীর ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এক উদ্‌ভ্রান্ত পথচারীর পাল্লায় পড়েছিলাম। চেনা নেই জানা নেই, সেই পক্বকেশধারী পথচারী আচম্বিতে এক প্রশ্ন উত্থাপন করে বললেন, ‘ভাই সাহেব, জানেন তো, কবি শামসুর রাহমানের দেশ উটের পিঠে চলত। উটকে বলা হয় মরুভূমির জাহাজ। তাও তো ভালো, দেশ তখন চড়াই-উতরাই করে হলেও জাহাজের পিঠে করে চলত। এবার বলুন তো দেশ এখন কিভাবে চলছে? কী জবাব দেবো ভাবতে ভাবতে ভদ্রলোক নিজেই উত্তর দিলেন- ‘দেশ এখন চলছে দুর্ঘটনাকবলিত মিরসরাইয়ের বাসের মতো।’ আমি বললাম কী রকম? জবাবে তিনি বললেন, ‘বুঝলেন না, দেশ চলছে হেলপার দিয়ে, কোনো ড্রাইভার নেই।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর জেনারেল জিয়া আর যা-ই হোক হেলপার ছিলেন না, তারা ছিলেন ড্রাইভার, রাষ্ট্রের পরিচালক। এখন দেখেন, যেসব লোকেরা দেশ চালাচ্ছেন তারা কেউই ড্রাইভার নন, সবাই হেলপার। তার ওপর আবার মুঠোফোন নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন তারা। এ জন্যই দেশের আজ এই দশা।’ 
উদ্‌ভ্রান্ত লোকটি একদমে কথাগুলো বলে মিলিটারি প্যারেডের কায়দায় অ্যাবাউট টার্ন করে পাশের রেললাইন ধরে অন্ধকারে হেঁটে চলে গেলেন। লোকটা শিক্ষিত পাগল হবে হয়তো বা। ‘পাগলেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে কত কিছুই কহে বলেই তো রাস্তার গল্প তৈরি হয়ে যায়।’ খবরের কাগজে এসব গল্প জায়গা পায় না। 
৩. বিরোধী দলের আন্দোলনের হিসাব-নিকাশ : এবার বিরোধী দলের আন্দোলনের ‘গল্পে’ আসা যাক। বিরোধী দল যখন ক্ষমতার বাইরে থাকে তখন জনগণ তাদের কাছে দলীয় স্বার্থের রাজনীতির পরিবর্তে জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি প্রত্যাশা করে। কিন' সে রাজনীতি যদি নিছক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি, এমনকি জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আপস করে অথবা নির্লিপ্ত থেকে শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি হয়, তাহলে জনগণ হতাশ হয়। এখন বিরোধী দলের আজকের রাজনীতি নিয়ে খবরের কাগজের এবং রাস্তার কিছু গল্প শোনা যাক।
দেশের প্রধান বিরোধী দল আজ সরকারের সংবিধান নিয়ে স্বেচ্ছাচার, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া বাতিল ও সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস'া বাতিলের বিরুদ্ধে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। সরকার বিরোধী দলের এ আন্দোলন ফ্যাসিবাদী কায়দায় দমনের চেষ্টা করছে। এভাবে ক্ষমতান্ধ সরকার যদি বিরোধী দল ও জনগণের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখে, তাহলে রাজপথ ক্রমেই আরো বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। সে ক্ষেত্রে ১/১১-এর মতো বা তার চেয়েও ভয়াবহ কোনো অঘটন না ঘটলে আন্দোলন একপর্যায়ে চরমে পৌঁছে ’৯০-এর মতো অথবা তার চেয়েও বড় অভ্যুত্থানে রূপ নিতে পারে। তাতে বর্তমান সরকারের পতনের মাধ্যমে রাজনীতিতে নতুন পটপরিবর্তন ঘটতে পারে। এ রকম একটি প্রত্যাশা ইতোমধ্যে জনমনে তৈরিও হচ্ছে। বলা যায়, বিরোধী দলের আন্দোলন নিয়ে এগুলোই হচ্ছে এ সময়কার খবরের কাগজের গল্প।
কিন' এর বিপরীতে রাস্তার গল্প হলো, বিরোধী দল সরকারের ‘চাণক্য’ চালে পড়ে গতানুগতিক খুচরা (সাবসিডিয়ারি) ইস্যুর আন্দোলনের ফাঁদে আটকা পড়েছে। দেশের রাজনীতি ও সার্বিক পরিসি'তি আজ স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ সঙ্কটে নিপতিত। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আজ বিপন্ন। ডাকনামে যে বাংলাদেশকে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র বলে জানি, তার অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। ভারতীয় শাসক-শোষকগোষ্ঠী ও তাদের এ দেশীয় দালাল রাজনীতিক-সুশীল-বুদ্ধিজীবীদের চাণক্য রাজনীতির অধীনে ‘ট্রানজিট’ নামের এক প্রতারণামূলক বয়ান কূটকৌশলে জনগণকে গিলিয়ে বর্তমান সরকার ভারতকে তার এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে (যুদ্ধ-সঙ্ঘাত-সংক্ষুব্ধ অঞ্চলে) অবাধ যাতায়াতের জন্য বাংলাদেশের স'ল ও জল ভূখণ্ডে এবং সমুদ্রবন্দরে করিডর দেয়ার সব আয়োজন চূড়ান্ত করে ফেলেছে। যে রাষ্ট্রটি অনেক রক্ত, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, সেই স্বাধীন বাংলাদেশ অচিরেই পরিণত হতে চলেছে ভারতের করিডোর রাষ্ট্রে। ভারতকে করিডোর দিলে ‘দেশ আর্থিকভাবে বিরাট লাভবান হবে, বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হবে’- এরূপ মিথ্যা প্রতারণামূলক প্রচারণা বহু আগে থেকেই চালানো হচ্ছে। কিন' প্রকৃত অবস'া হচ্ছে, ভারতকে করিডোর দিলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। দেশের নিজস্ব উৎপাদন ও সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত হবে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে। নেপাল-ভুটানের সাথে ট্রানজিট আর ভারতকে দেয়া করিডোর এই দুটোকে এক বস' বানিয়ে ‘বাঙ্গাল’কে হাইকোর্ট দেখানো হচ্ছে।
অন্য দিকে এ সরকার দেশের সমুদ্রাঞ্চলের তেল-গ্যাসের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লক দাসত্বমূলক চুক্তির মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানি কনোকো-ফিলিপসের হাতে তুলে দিয়েছে। অন্য আরেকটি ব্লক (৫ নম্বর ব্লক), যেটি সরকার এর আগে টেন্ডারের মাধ্যমে টাল্লু কোম্পানিকে ইজারা দেয়ার প্রস'তি সম্পন্ন করেছিল, সেটি বিনাবাধায় বিনাপ্রতিবাদে ভারত তার দখলে নিয়ে নিয়েছে। সমগ্র দেশ ও জাতির এরূপ ভয়াবহ অবস'াকে আড়াল করার উদ্দেশে সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম, আল্লাহর ওপর আস'া, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি বিতর্ক এবং সেই সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস'া বাতিল, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা- এগুলো সবই হচ্ছে দেশী-বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পরিকল্পিতভাবে তৈরী ‘বাইপ্রোডাক্ট’ ইস্যু।
অথচ দেশের প্রধান বিরোধী দলের আন্দোলনে আজকের গুরুতর জাতীয় ইস্যুর কোনো নামগন্ধ নেই। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যেখানে সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানির দখলে চলে যাচ্ছে, করিডোরের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব যেখানে প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছে- আর এভাবে দেশের অস্তিত্বই আজ যখন বিপন্ন, তখন জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে নিবদ্ধ রাখার জন্য বিরোধী দলকে ঠেলে দেয়া হয়েছে ‘বাইপ্রোডাক্ট’ ইস্যু নিয়ে আন্দোলনে। বিরোধী দলকে বোকা কুমির বানিয়ে ঠেলে দেয়া হয়েছে শেয়ালের ঠ্যাং ছেড়ে লাঠি কামড়ে ধরার রাজনীতিতে। দেশের সম্পদ যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব যদি না থাকে, নিজের রাষ্ট্র যদি অন্যের করিডোরে পরিণত হয়, তাহলে সংবিধানে বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম, আল্লাহর ওপর আস'া কিংবা সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা এসব দিয়ে কী হবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন দিয়েই বা কী হবে? পরাধীন দেশে দাসত্বের শৃঙ্খল পরে ক্ষমতায় গিয়ে কী হবে শুনি? এগুলো খবরের কাগজের গল্প নয়, এগুলো সব রাস্তার গল্প।
উপসংহার : রাস্তার সর্বশেষ গল্প হলো, দেশের মানুষ আর দাসত্বের বিনিময়ে ক্ষমতার রাজনীতি দেখতে চায় না। জনগণ চায় একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জনগণ দলীয় সংবিধান ও দলীয় শাসনের পরিবর্তে চায় জনগণের সংবিধান ও জনগণের শাসন। জনগণের এই আকাঙক্ষা পূরণ খবরের কাগজের গতানুগতিক গল্প দিয়ে সম্ভব নয়। তার জন্য দরকার রাস্তার গল্পের। আর রাস্তার গল্প মানেই তরুণ প্রজন্ম ও আবালবৃদ্ধবনিতার মহাজাগরণ। রাস্তার গল্প মানে জনতার মহা উত্থান। রাস্তার গল্প মানেই আসল লড়াই। বিরোধী দলগুলোর সেই হুঁশ হবে কি?
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট

বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১১

কিসের বিজয়? কার বিজয়?? গোলামীর জিঞ্জীরে এখোন স্বদেশ;


 কিসের বিজয়? কার বিজয়?? গোলামীর জিঞ্জীরে এখোন স্বদেশ;
 আত্নার সাথে আর কত করবে প্রতারণা??? জাগো বাঙ্গালী জাগো
        নিমু মাহবুব

বিজয় বিজয় বিজয়!কিসের বিজয়?? কার বিজয়??? কোথায় বিজয়??? নতুন বতোলে পুরনো মদ শুধু। বিজয়ী কি দেশ??? দেশের মানুষ??? দেশের স্বাধীনতা???? দেশের অর্থনীতি??? দেশের রাজনীতি????? সংস্কৃতি????? পাকিস্তানের মত হাঙ্গরের নগ্ন বিশ্বাসঘাতকতা থেকে দেশ মুক্ত হয়েছে ঠিকই। কিন্ত আজ দেশকে, দেশের স্বাধীনতাকে, দেশের মানুষকে, দেশের অর্থনীতিকে, রাজনীতিকে, সংস্কৃতিকে, অক্টোপাসের বিষাক্ত ছোবলের মত গ্রাস করছে বন্ধুরূপি শয়তান একটি দেশ। কি রাজনীতিতে, কি অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে সবখানে তাদের নগ্ন হস্তক্ষেপ।

কি পেয়েছে চল্লিশ বছরে দেশ??? পেয়েছে একটি সংবিধান! স্বাধীনতা শূধু সংবিধানে সীমাবদ্ধ।

এই দেশে আঈন আছে প্রয়োগ নেই।বিচার আছে ন্যায়বিচার নেই। সংবিধান আছে তার মান্যতা নেই।

 এই দেশে দেশেপ্রেমিক রাজনৈতিক নেই। আছে শাসনের নামে বংশানুক্রমিক শোষণ করার অধীকার।

 স্বাধীনতা কি সীমান্তে পাখীর মত গুলি খেয়ে মরা??? স্বাধীনতা কি সীমানত্ দিয়ে ফেনসিডিলের জোয়ার???? স্বাধীনতা কি ফারাক্কা বাধে দেশ মরূভূমি হওয়া???? স্বাধীনতা কি টিপাইমুখ ড্যামের পক্ষে কথা বলা???? স্বাধীনতা কি হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য ঘাটতি??????? স্বাধীনতা কি অশ্লীল, নগ্ন আকাশ সংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল?????? স্বাধীনতা কি পাকিস্তানি বাহিনীর ভারতের কাছে আত্নসমর্পণ?????
 স্বাধীনতা কি দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ণ হওয়া????  স্বাধীনতা কি লুটেরাদের অভয়ারণ্য???? স্বাধীনতা কি সন্ত্রাসীদের রাজত্য???? স্বাধীনতা কি শেয়ার বাজারে হাজার হাজার কোটি টাকা হাওয়া????? আর পারছিনা।

আমি স্বাধীন নই। তোমরা যারা স্বাধীন তারা নাচো, গাও, আনন্দ করো। আমাকে করতে বলোনা। কারণ আমি স্বাধীন নই, আমার স্বাধীনতা নেই। আমি দেখছি, আমি জিঞ্জীরে আবদ্ধ পাখীর মতই পরাধীন। আমার দেশ পরাধীন, আমার দেশের মানুষ পরাধীন, আমার রাজনীতি পরাধীন, অর্থনীতি পরাধীন, আমার মাসসিকতাও পরাধীন।আমি কোথাও স্বাধীনতার ছায়া দেখিনা। কোথাওনা, কোথাওনা।
আমার বুক ফেটে আসে কান্না, হৃদয়ে ভেসে উঠে হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস। আমি কোথাও স্বাধীনতা দেখিনা। 

সোমবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১১

এক টোকাইয়ের আত্ন কাহিনী


নিমু মাহবুব
এতবড় পৃখিবীতে মাথা গোজার নাইরে ঠাঁই

আমি ছাড়া পৃথিবীতে আপন আমার কেহ নাই
বাবা আমার অকালেতে রোগে শোকে মারা যায়,
মা চলে যায় পরের ঘরে আমায় করে অসহায়
দুঃখ সাথি করে আমি আসেছি এই ভুবনে,
এতটুকু সুখ পেলামনা হতভাগা জীবনে
পৃথিবীতে বেঁচে থাকা হলো আমার বড় দায়,
মায়াভরা দুনিয়াতে আমি শুধু অসহায়
আমিও তো মানুষ হয়ে এসছি এই দুনিয়ায়,
তবে কেন আমার জীবন নিভিতে চায় অবেলায়?
বিধি আমি তোমার কাছে করেছি কি অপরাধ?
দিলে না' জীবনে এতটুকু সুখের স্বাদ
যার কাছে যাই সে গালি দেয় পথের টোকাই বলে,
পণ করেছি ওপারেতে যাব এবার চলে

বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১১

উলুঘ খান বিন তুঘলক বনাম হাসিনা বিনতে মুজিব

 উলুঘ খান বিন তুঘলক বনাম হাসিনা বিনতে মুজিব

নিমু মাহবুব
তুঘলক সমাচার
ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে মুহম্মদ বিন তুঘলক এক অতি পরিচিত নাম। তার প্রকৃত নাম উলুঘ খান। ১৩৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। উলুঘ খান ওরপে মুহম্মদ বিন তুঘলক ইতিহাসে তার কিছু সংস্কারের জন্য নন্দিত  নিন্দিত ও সমালোচিত। বিশেষ করে তিনি তার পাঁচটি পরিকল্পনার জন্য ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত। পরিকল্পনাগুলো হলো-
        
       ১. দেবগিরিতে রাজধানী স্থাপন।দাক্ষিণাত্যে বিদ্রোহ দমন, সাম্রাজ্যের কেন্দ্রতে রাজধানী স্থাপন, মোঙ্গল আক্রমণ থেকে সাম্রাজ্যকে সংরক্ষণ ও রাজধানীতে ইসলামী সংস্কৃতি প্রবর্তন ইত্যাদি কারণে উলুঘ খান দিল্লি সালতানাতের রাজধানী দিল্লি থেকে ৭০০ মাইল দূরে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু দেবগিরিতে ১৩২৭-২৮ সনে রাজধানী স্থাপন করেন। এ সম্পর্কে পক্ষে বিপক্ষে ঐতিহাসিকরা সমানভাবে বিভক্ত।তবে একথা ঠিক যে এত প্রচুর অর্থ খরচ হয়েছিল ও জনগণকে বেশ কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছিল। ফলে তার এ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।
      
       ২. খোরাসান অভিযান।খোরাসান ছিল ততকালে খুবই সমৃদ্ধ দেশ। সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের দরবারে আশ্রয়প্রাপ্ত কয়েকজন আভিজাত্যের অনুপ্রেরণায় তিনি খোরাসান দখল করার পরিকল্পনা নেন। এ লক্ষে তিনি তিন লক্ষ সত্তুর হাজার সৈন্যের এ বিরাট বাহিনী গঠন করেন। কিন্তু রাজনৈতিকপট পরিবর্তন হওয়ার কারনে তার এ পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়। রাজকোষের প্রচুর অর্থ অপচয় হয়।

        ৩. করাচিল বা কুর্মাচল অভিযান। সুলতান ১৩৩২-৩৩ সালে হিমালয়ের পাদদেশে করাচিল নামক পার্বত্য রাজ্যের বিরুদ্ধে একাট অভিযান পরিচালনা করেন। পাকৃতিক দুর্যোগের পতিত হলে এ অভিযানে দিল্লির বাহিনী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। অনেকের মতে তিন কিংবা দশ জন সৈন্য জীবিত ছিল।

        ৪.  প্রতিক তাম্র মুদ্রা প্রচলন।অর্থ সমস্যা সমাধানের জন্য তুঘলক ১৩২৯ সালে প্রতিকি তাম্য মুদ্রা প্রচলন করে ততকালীন যুগের সর্বাপেক্ষা অভিনব এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এখানে উল্লেখ্য যে সে সময়ে বিনিময় মুদ্রা হিসেবে স্বর্ণ মুদ্রা ও রৌপ্য মুদ্রা প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্র কর্তৃক কৃত্রিম মুদ্রা নিরোধের কোন ব্যবস্থা নাথাকায় দেশের সর্বত্র জাল মুদ্রায় ছেয়ে যায়।  ঐতিহাসিক  W. Haig তার Cambrige History od India- র ১৪৬ পৃষ্ঠায় বলেন, every Hindu house was turned into a mint ( প্রত্যেক হিন্দুগৃহ মুদ্রা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়)। ফলে তার এ পরিকল্পনাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

          ৫. দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি। তুঘলকের সর্বশেষ পরিকল্পনা ছিল দোয়াব অঞ্চলে কর বৃদ্ধি। এ অঞ্চলে কর বৃদ্ধির ফলে জনসাধারণের অবস্থা শোচণায় হয়ে পড়ে। রায়তশ্রেণী ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হয়। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
        তুঘলকের উপরোক্ত পরিকল্পনা গুলো সময়ের বিচারে ছিল অযোক্তিক ও উদ্ভট। তাই বর্তমানেও কেউ কোন উদ্ভট কাজ করলে বলা হয় তুঘলকি কান্ড।

         হাসিনা সমাচার-----
         ১. বিমান বন্দরের নাম পরিবর্তন।হাসিনা সরকার গত ২২ ই ফেব্রুয়ারি ২০১১ তে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নাম পরিকর্তন করে। এতে খরচ হয় বারো হাজার কোটি টাকারও বেশি। আইলায় বিধ্বস্ত অর্থনৈতিকভাবে অধ্বঃপতিত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় নাম পরিবর্তনের খেসারত বাংলাদেশের মানুষকে বইতে হবে বহু বছর।

         ২. তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার। ১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাদের জন্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বশতঃ বিরোধীদলের কয়েকজন নেতাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। হাস্যকর অভিযোগে তাদেরকে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছে বহু দিন। গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ছেড়ে দিয়ে এদেশের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য তাদের বিচার করা হচ্ছে যা ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম প্রহসন হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকবে। যখন জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন তখন তা নাকরে ( ভিনদেশী রাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য) জাতিকে বিভক্ত করা হচ্ছে।

         ৩. তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল। হাসিনা সরকারের সর্বাপেক্ষা উদ্ভট ও সেচ্ছাচারী কাজের মধ্যে একটি হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির অবসান।  এর ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে হবে। বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে কখনো গ্রহণযোগ্য, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করে হাসিনা দেশকে অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দিল।

        ৪. ভারতকে বিনা মাসুলে ট্রনজিট নামে  করিডোর প্রধান। হাসিনা সরকারের আরেকটি জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখাত সিদ্ধান্ত হলো ভারতকে সম্পূর্ণ  বিনা মাসুলে করিডোর প্রধান। এর মধ্য দিয়ে দেশের অবকাঠামো, স্বার্থ ও নিরাপত্তাকে বিসর্জন ও বিকিয়ে দেয়া হয়েছে।
         
         ৫. ঢাকাকে দিখন্ডিত। চারশ বছরের ইতিহাসে সমৃদ্ধ ঢাকাকে মাত্র চার মিনিটে দ্বিখন্ডিত করে হাসিনা সরকার উদ্ভট, অগ্রহণযোগ্য, অগণতান্ত্রিক, খামখেয়ালীপনার নজির স্থাপন করল।

          হাসিনা সরকারের বড় উদ্ভট পাঁচটি সিদ্ধান্ত নির্বাচন করতে গিয়ে মাথার তার গুলোতে ঢাকা শহরের জ্যামের মতই জ্যাম লেগে যায়। তবু আমি নিজেকে ব্যর্থ বলে মনে করি। শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি, বিডিআর বিদ্রোহ, গ্রামীন ব্যাংক থেকে ড. মুহম্মদ ইউনুছকে অপসারণ, পদ্মাসেতু দুর্নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য চার -পাঁচগুন বৃদ্ধি, ৬ মাসে তিনবার জ্বালানী তেলেরর দাম বাড়ানো, মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপতার করে রিমান্ডে নির্যাতন, আমার দেশ, চ্যানেল ওয়ান, যমুনা টিভিসহ গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ, ছাত্রলীগের হত্যা, ধর্ষণ, টেন্ডারবাজি ইত্যাদিকে আশ্রয় প্রশ্রয় প্রদান, মুসলিমবিশ্বের সাথে বিশেষ সম্পর্ক পরিত্যাগ, ব্যর্থ, নতজানু ও একদেশমুখী পররাষ্ট্রনীতি, তিস্তা চুক্তিতে ব্যর্থতা, বঙ্গোপসাগরের গ্যাসকুপ বিদেশী কোম্পানীকে ইজারা, বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ  দলীয় করণসহ  হাসিনা সরকারের উদ্ভট কাজের পিরিস্তি এত লম্বাযে কোনটা রেখে কোনটা লিখব তা বুঝতে পারছিনা।

         বিন তুঘলক বনাম বিনতে হাসিনা। উলুঘ খান বিন তুঘলকের উপরে বর্ণিত পাঁচটি পরিকল্পনা বাদ দিলে তিনি ছিলেন জনদরদী ও জনকল্যানকামী শাসক। তার সম্পর্কে একজন হিন্দু ঐতিহাসিকের ড. ইশ্বরী প্রসাদ বলেন, "মুহম্মদ বিন তুঘলক মধ্যযুগের মুকুটধারী শাসকদের মধ্যে অবিসংবাদিতরূপে যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন"। তিনি আরো বলেন, Of all the king who sat upon the throne of Delhi since Muslim conquest, he was undoubtedly the most learned and accomplished. ( মুসলিম বিজয়ের সময় হতে যেসব সুলতান দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেছেন তাদের মধ্যে তিনি সর্বাধিক বিদ্বান ও গুনসম্পর্ণ ব্যক্তি।) [ Ishwari Prasad - A Short History of Muslim Rule in India] । এখন কোন উদ্ভট বা হাস্যকর কাজের জন্য যদি তাকে তুঘলকি কান্ড বলা হয় তবে শেখ হাসিনার বর্তমান উদ্ভট, অযৌক্তিক,  হাস্যকর কাজের জন্য ভবিষ্যতে কি এ রকম কোন কাজকে শেখীকান্ড বা হাসিনীকান্ড বলে অভিহিত করা অযৌক্তিক হবে?????????????????

সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১১

বেহেস্তির বিয়া ভাঙ্গি গেছে




বেহেস্তিরে চাইতো আইছে
বিদাশী এক হোলা
জাগা-জমি ম্যালা আছে,
আছে টিঁয়ার গোলা

বিদাশেত্তন সোনা আইনছে
আইনছে দামি শাড়ি,
টয়োটা এক গাড়ি কিনবো,
গুলশানেতে বাড়ি

মা খুশি বাপ খুশি
খুশি আপনজনে
খুশি নয়গো কুটনিবুড়ি
শতানি যে মনে

হাড়াহতিবেশি খুশি
খুশি ছোড বইনে
দুলাভাইরে কুতকুতি
দিবো অনুক্ষণে

হটাৎ করি গুজব উইটলো
বেহেস্তির ' হুড়ি
গুজবটা যে ছড়াই দিছে
হাড়ার কুটনিবুড়ি

বরপক্কেরে চুপি চুপি
বুড়িয়ে কয়, বাছা
জাননিগো বেহেস্তির যে
নাকটা খানিক বোঁচা

বরপক্ক কতাহুনি
রণে দিছে ভঙ্গ,
তলাই আর দেহেনো যে
এটা বুড়ির রঙ্গ

বেহেস্তির বিয়া ভাঙ্গি গেছে
তাই দেয়না কাউরে সঙ্গ
কুটনিবুড়ি মুক্ত হবে
কবে যে বঙ্গ?