বাসের
জানালা দিয়ে রাস্তার পাশের ছোট্ট চা দোকানের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখ একটা চায়ের পেয়ালায়।
দোকানি চা’টা বানিয়েছেন মাত্র।খদ্দের এখনো তা হাতে নিয়ে চুমুক দেয়নি। পাক খেয়ে ধোঁয়া
উঠছে কাপ থেকে। কিন্তু মনের চোখ আমার ওখানে নেই।সে আছে দূরে কোন এক পল্লী গাঁয়ে। হরেক
রকম বাহারি রঙের ফুলের বাগানের মাঝখানে ছোট্ট একটি কুড়ে ঘর। আর সেখানেই আছে আমার প্রাণপাখি।
যাকে একবারের জন্যও দেখিনাই অথচ সেই আমার অনন্ত পথের সহযাত্রী। হঠাৎ “এক্সকিউজমি, এই
যে শুনছেন”-এ ভাবনার ঘোর চড়ুই পাখির মত পুড়ুত করে উড়ে গেল।মিজাজটাই বিগড়ে গেল। ইশ!
কি সব দারুণ দারুণ কল্পনা হচ্ছিল।“এই যে শুনছেন”এর দিকে তাকালাম। বয়স বাইশ কি তেইশ।
চকলেট কালারের বোরকা পরা। মাথায় সাদা রঙের উপর কালো রঙের ফুল করা স্কার্প।নেকাব পরা
নেই।নাহ! এসব ঠিক হচ্ছেনা। কার মেয়ে কার বউ আল্লাই মালুম। আমি দেখে আর তা আপনাদের বলে
কি লাভ!
-আমি
কি আপনার পাশে বসতে পারি?
যাত্রাপথে পাশের সিটে অপরিচিত মেয়ে মানুষ বসলে কার
মনের অবস্থা কি রকম হয় তা এক জানেন ভু্ক্তভুগি আর এক জানেন খোদা তা’য়ালা। আমার কিন্তু
মোটেই ভালো লাগছেনা। বাসের সব গুলো সিটে চোখ বুলিয়ে নিলাম। না, আর কোন সিট খালি নেই।
-বসেন।
সায়েদাবাদ
থেকে জোনাকী পরিবহনের একটা বাসে চেপে বসলাম দেড় ঘন্টা হয়ে গেল। কিন্তু এখনো যাত্রাবাড়ি
চৌরাস্তাই পার হতে পারলাম না। কি সব ওভারব্রিজ টোভার ব্রিজ বানাচ্ছে। তাতে রাস্তার
অবস্থা এমন যেন পয়লা চাষ দেয়া জমি। আসলে ব্রিজ ট্রিজ সব হলো ধান্দাবাজি। শেরে বাংলাও
নেই সোহরাওর্দীও নেই । তাই রাজনীতি এখন পকেট ভারি করার হাতিয়ার।
যাত্রাপথে
সহযাত্রীর সাথে যেচে কথা বলার অভ্যেস আমার কোন কালেই ছিল না।এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হওয়ার
সম্ভাবনা নেই। কিন্তু মেয়েটা মনে হয় কিছুটা ইঁচড়ে পাকা। আমাকে বলে বসল, আপনি কোথায়
যাবেন? সহযাত্রীকে কোথায় যাবেন জিজ্ঞেস করাটা অভদ্রতা।বড়জোর -আপনি বেশি দূর যাবেন কি
বলা যেতে পারে। রাগে মনে মনে ফুলে গেলাম। মেয়েটা মনে হয় তার ভুল বুঝতে পেরেছে। বলল
স্যরি। আমি বল্লাম, না ঠিক আছে, লক্ষীপুর যাব। না জিজ্ঞেস করতেই বলল আমিও। বললাম ও,
আচ্ছা।
বাসে
কিম্বা ট্রেনে সব সময় জানালার পাশের সিট আমার পছন্দ।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি দূরের বাড়ি-ঘর
আর গাছগাছালির দিকে। মনের হয় বাস নয় ঘর-বাড়ি আর গাগাছালিরাই ৬০ কিমি বেগে ছুটে চলছে।
তাতে আমার মনে কবি কবি ভাব জমে যায়। তখন নিজেকে নজরুল ভাবতে ইচ্ছে করে। ভাবনা গুলো
আবার গোত্তা খায়।বিয়ে করেছি দু’মাস হতে চলল। বউকে দেখা গোল্লায় যাক তার একটা ছবিও কপালে
জোটেনি।বিয়েটা হয়ে যায় হঠাৎকরে ।দুই পরিবার পূর্ব পরিচিত। তাদের ফ্যামিলি চেয়েছিল বাগদানটা
সেরে রাখতে।তারপর সময় করে অনুষ্ঠান। কিন্তু আমার ফ্যামিলি ওসব এ্যান্গেজমেন্ট টেন্গেজমেন্টের
ধার মাড়ায়নি। তাদের এককথা, কালেমাটাই হয়ে যাক। হলোও তাই। তাই হালকা নাস্তা-পানি খেয়ে
আমরা সেইযে ওদের বাসা থেকে বের হয়েছি তারপর আর ওই বাসার মাটি আমার মাড়ানো হয়নি।কথা
ছিল যত দ্রূত সম্ভব সময় করে অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলা হবে।কিন্তু একদিন দু’দিন করে সময়
চলে যাচ্ছে ঠিক আমার ছুটি আর মিলছেই না। ছুটি চাইতেই অফিসের ম্যানেজার আজ অমুক হাসপাতালে,
নয় তো কাল অমুকের বউয়ের ডেলিভারি, আজ রবিবার তো কাল বৃহষ্পতিবাবের অজুহাত দেখান। কিচ্ছু
না পেলে আজ আপনাকে অমুক টেবিলে খুবই প্রয়োজন বলে নাকচ করে দেন। এইসব করে আজ প্রায় দেঢ়
মাস হতে চলল।ম্যানেজারের ভাব দেখে ইচ্ছে করে- চাকরিটাই ছেড়ে দেই। কখনো কখনো গলা অবধি
এসে যায় “শালা একটা .....”।কিন্তু থাক।অবশেষে অনেক তাবিজ-তদবিরের পরে দু’দিনের ছুটি
পাওয়া গেল।
ভাবনার
তারটা মাঝে মাঝে ছিঁড়ে যায়। আমার কেন জানি মনে হয় পাশের মেয়েটা বুঝি হাসে। দু’একবার
হালকা আওয়াজও হয়ে থাকবে হয়তো।সরাসরি তাকাতে শরম লাগে। তাই আড় চোখে চেয়ে দেখেছি কিন্তু
কিছুই বুঝলাম না।ছোট বেলায় আমাদের ক্লাসে একটা আমড়া কাঠের ঢেঁকি ছিল।স্যার তাকে বলতেন,
কিরে আদুভাই তুই হাসিস না কাঁদিস? সে বলতো, না স্যার, আমি থাকিই এরকম। এই মেয়েরও কি
ওই রকম মুদ্রাদোষ আছে নাকি আল্লাহই মালুম।
কুমিল্লার
আলেখারচরে এসে বাস যাত্রা বিরতির জন্য থামল। গাড়ি থেকে হুড়মুড় করে নামতে গিয়ে জ্যাম
লেগে গেল। গাড়ি থেকে নেমে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ফ্রেস হয়ে লাঞ্চ সেরে নিলাম। বিল দিতে
হোটেলের কাউন্টারে গেলে আরেকটা জটলার মুখোমুখি হলাম। পকেটে হাত দিতেই আঁতকে উঠলাম।
টের পেলাম মানিব্যাগ হাওয়া।মানিব্যাগটা বাসে উঠার আগেই না নামতে গিয়ে নাকি হোটেলের
কাউন্টারে যাওয়ার পর গায়েব হয়েছে তা এক জানে পকেটমার আর এক জানে আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা।হোটেলের
ম্যানেজার চিৎকার চেঁচামেচি হৈ-হল্লা শুরু করে দিয়েছেন। বাসের কন্টাক্টারকে বললাম,
ভাই আপনি একটু ম্যানেজ করেন। আমি লক্ষীপুর গিয়েই আপনাকে দিয়ে দিব। কন্টাক্টর ইতস্তত
করছে। এই সময় এগিয়ে এল মেয়েটি। সব শুনে বিলটা দিয়ে দিল। গাড়িতে উঠে আমাকে বলল, হুম,
হাঁদারামদের এই রকমই হয়। একটা এমক্যাশ নাম্বার দিচ্ছি লক্ষীপুর গিয়ে পাঠিয়ে দিবেন।
আমি পেয়ে যাব। হাঁদারাম বলে সে আমাকে টিটকারী না তিরস্কার করল নাকি অন্য কিছু ইশারা
করল আমি তা’র ধার দিয়েও গেলামনা।বরং তাকে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, চাইনিজ-জাপানি, জানা-অজানা
সব ভাষায় ধন্যবাদ আর শুকরিয়া জানালাম।ঝুমুর স্টেশনে আসলে সে সিট থেকে উঠে গেল। একশ
টাকার দুটা নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, পকেটে তো নিশ্চয়ই কানা-কড়িও নেই। ভাড়া দিয়ে
বাড়ি যাবেন। বলেই গাড়ি থেকে নেমে গেল।আমি তো তাজ্জব! হা হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকলাম অথচ
আমারও ঝুমুরেই নেমে যাবার কথা।যাক, উত্তর স্টেশনে এসে গাড়ি থেকে নেমে সোজা চকবাজার
চলে গেলাম।তাহিয়া এন্টারপ্রাইজে গিয়ে ফয়েজ ভাইকে বললাম এই নাম্বারে ৪৫০ টাকা এমক্যাশ
করেন। তারপর সোজা বাড়ি।
পরদিন
বিয়ের অনুষ্ঠানে মাথায় পাগড়ি পরে শশুরালয়ে গেলাম। অনুষ্ঠানের মাঝখানে কে একজন আমাকে
অন্দরের একটি রুমে নিয়ে গেল। আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে একষট্টি পার। রুমে তেমন কোন
আসবাবপত্র নেই। একটা খাট, একটা শোকেস আর এককোণে একটা ছোট্ট টেবিল। টেবিলের উপর চোখ
পড়তেই আমি আঁৎকে উঠলাম।এযে আমার চুরি যাওয়া মানিব্যাগ। হাতে নিয়ে দেখলাম হুম!এটা আমার
মানিব্যাগটাই। খুলে দেখলাম মাথায় টুপি দিয়ে তোলা আমার ছবিটি আছে বহাল তবিয়তে।যখন ভাবছি
মানিব্যাগটা কিভাবে এখানে আসতে পারে তখন দ্বিতীয়বারের মত ভিমরি খাওয়ার মত অবস্থা। আমার
সামনে নববধুর সাজে সজ্জিত যে মানুষটি দাঁড়ানো সে আর কেউ নয়, গতকাল বাসে আমার পাশের
সিটে বসা সহযাত্রী। আমাকে বলল, আসমান থেকে পড়েছেন? বললাম না, আসমান থেকে নয় একেবারে
আরশে আজিম থেকে পড়েছি। পড়ে হাড়-গোড় সব ভেঙ্গে ফেলেছি। সে বলল, ভাবছেন মানিব্যাগটা আমার
কাছে কেমন করে এলো। আমি মাথা নাড়লাম। উত্তরে সে যা বলল তা সংক্ষেপে এইরুপ।
গাড়িতে
উঠার পূর্ব অবধি আমরা কেউ কাউকে কখনো দেখিনি। তার ঢাকা থেকে গ্রামে ফেরার কথা ছিল আরো
দু’দিন আগে।কিন্তু তার এক নাছোড়বান্দা বান্ধবীর ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান থাকাতে দেরি
হয়ে গেল। গাড়িতে উঠেই সে আমাকে চিনতে পারে। আমার কি একটা ফটো যে কোনভাবে তার হাত অবধি
গড়িয়েছে। কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারিনি।কুমিল্লার আলেখারচরে যাত্রা বিরতিতে সিট থেকে
উঠার সময় আমার মানিব্যাগটা সিটের উপর পড়ে যায়। সে দেখে ফেলে এবং কৌশলে নিয়ে নেয়।তা
সে ফেরত দেয়নি মজা করার জন্য।কারণ আমাকে চিনতে তার কোন রকম ভুল হয়নি।
চোখ
তুলে তার দিকে তাকালাম। সে একটা মুচকি হাসি দিল। সে হাসি দেখার সৌভাগ্য খোদা তা’য়ালা
যাকে দিয়েছেন তার মত সুখী পৃথিবীতে আর কে হতে পারে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন