টিপু সুলতান |
কলকাতায় টিপু সুলতান মসজিদ। |
‘মহীশূরের ব্যাঘ্র’ টিপু সুলতানের জন্ম ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর দেওয়ানাহাল্লিতে। ১৭৮২-১৭৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি মহীশূরের শাসক ছিলেন। মহীশূরের প্রকৃত শাসক (Defacto ruler) হায়দার আলীর পুত্র তিনি। মায়ের নাম ফাতিমা বা ফখরুননিসা। ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে বাবার মৃত্যুর পর টিপু মহীশূরের কর্ণধার হন। পণ্ডিত, দক্ষ সৈনিক এবং কবি হিসেবেও টিপু পরিচিত ছিলেন। ছিলেন ধর্মভীরু মুসলমান। ফরাসিদের অনুরোধে মহীশূরে তিনিই প্রথম গির্জা নির্মাণ করেন। বহু ভাষায় দক্ষ টিপু ফরাসিদের সহযোগিতায় মহীশূরের সংগ্রামকে ব্রিটিশ এবং অন্যান্য শক্তির বিরুদ্ধে বেগবান করেছিলেন; যার প্রমাণ মারাঠা, সিরা, মালাবারের শাসক, কুর্গ, বেন্দুর, কর্নাটক এবং ট্রাভানকরের (হিন্দু সামন্ত রাজত্ব) অভিযানে বাবার মতোই তারও ফরাসি প্রশিক্ষিত সৈন্যের ব্যবহার। মহীশূরের দ্বিতীয় যুদ্ধে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিজয় তার সামরিক জীবনে উল্লেখযোগ্য দিক। বাবার মৃত্যুর পর ব্রিটিশদের সঙ্গে তার স্বাক্ষরিত চুক্তি ইতিহাসে ম্যাঙ্গালোর চুক্তি হিসেবে খ্যাত। ১৭৬৬ সালে মহীশূরের প্রথম যুদ্ধে বাবাকে সহযোগিতা করেন টিপু। প্রথম অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধেও (১৭৭৫-১৭৭৯) তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। টিপুর নেতৃত্বে মহীশূরের সেনাবাহিনী ভারতবর্ষের রাজপুত্রদের জন্য সামরিক বিজ্ঞানের বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে রকেটের প্রবর্তক হিসেবেও টিপুর নাম আগে আসে। চতুর্থ মহীশূরের যুদ্ধে ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে লড়াই করে তিনি শহীদ হন ১৭৯৯ সালের ৪ মে।তারঁ এই শাহাদাতের মধ্য দিয়ে বস্তুত গোটা হিন্দুস্থানের ওপর নেমে এসেছিল পরাধীনতার অন্ধকার। টিপু সুলতান যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ইংরেজদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছেন,দেশের স্বাধীনতা আগলে রেখেছেন।কিন্তু তিনি শাহাদাত বরণ করলে শুধু হিন্দুস্থানই নয়,গোটা মুসলিম বিশ্ব যেন স্বাধীনতার এক অতন্দ্রপ্রহরী হারিয়ে অভিভাবক হারা অবস্থায় পড়ে যায়। তাই টিপু সুলতান ছিলেন ভারতবাসীর জন্য একজন চিরস্মরণীয় বীর। কিন্তু ইতিহাস বিকৃতি আর আমাদের উদাসীনতায় এই মুসলিম বীর আমাদের কাছে হয় অপরিচিত থেকেছেন নতুবা এমন পরিচয় লাভ করেছেন যা তার মতো মহান বীরের জন্য অবমাননার শামিল। সেনাপতি মীর সাদিক বিশ্বাসঘাতকতা না করলে এই ফলাফল অন্যরকম হতে পারত। শ্রীরঙ্গপত্তমে টিপু শায়িত। ব্যক্তিগত জীবনে তার ৪ স্ত্রী ছিলেন।
বাঘ প্রিতী
ছোটবেলা থেকেই টিপু, বাঘের গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। বাবাই তাঁকে বাঘের গল্প শোনাতেন। কিশোর বয়সে টিপু সুলতান বাঘ পুষতে শুরু করেন। বাঘ নিয়ে তাঁর ব্যঘ্রতার শেষ ছিলো না। বাবার মৃত্যুর পর তিনি যখন সিংহাসনে আরোহণ করলেন, তখন বাবার পুরোন সিংহাসনটি তিনি ঠিক পছন্দ করলেন না। তাই তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে কাঠের ফ্রেমের উপর সোনার পাত বসিয়ে তার উপর মণিমুক্তা ও রত্নখচিত একটি সিংহাসন বানিয়ে নিলেন, যাকে বরং "ব্যাঘ্রাসন"ই (Tiger throne) বলা যায়। কারণ আট কোণা ঐ আসনটির ঠিক মাঝখানে ছিলো একটি বাঘের মূর্তি। ৮ ফুট চওড়া আসনটির রেলিংয়ের মাথায় বসানো ছিলো সম্পূর্ণ স্বর্ণে তৈরি দশটি বাঘের মাথা, আর উপরে উঠার জন্য ছিলো দুধারে, রূপার তৈরি সিঁড়ি। আর পুরো ব্যাঘ্রাসনটাই ছিলো বাঘের শরীরের মতো ডোরাকাটা।
টিপু সুলতানের রাজ্যের প্রতীক ছিলো বাঘ। এই বাঘ ছিলো তাঁর অনুপ্রেরণার মতো। তাঁর রাজ্যের পতাকায় কানাড়ী ভাষায় লেখা ছিলো "বাঘই ঈশ্বর"।
"টিপু'স টাইগার"
১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর ও তাঁর বাহিনীর কাছে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধে টিপু ও তাঁর বাবা মারাত্মক নাজেহাল হন এবং টিপুর রাজ্যে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়, নিহত হয় অনেক সৈন্য। এমনিতেই তিনি প্রচন্ড ইংরেজ বিরোধী ছিলেন, তদুপরি এই পরাজয়ে তিনি আরো বেশি তেজদীপ্ত হয়ে ওঠেন। ঘটনাক্রমে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে হেক্টর মুনরোর একমাত্র পুত্রসুন্দরবনের সাগর দ্বীপে বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘ আক্রমণে নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে টিপুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। তিনি এই ধারণা কাজে লাগিয়ে একটি বিচিত্র খেলনা বানিয়েছিলেন, যা সারা দুনিয়ায় "টিপু'স টাইগার" (Tipu's Tiger) নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। ফরাসি যন্ত্রকুশলীদের দ্বারা নির্মিত প্রমাণ আকারের এই খেলনাটিতে ক্লকওয়ার্ক সিস্টেম ব্যবহৃত হয়েছিলো। খেলনায় দম দিয়ে ছেড়ে দিলে এর সাথে লাগনো একটি অর্গান পাইপ থেকে রক্ত হীম করা বাঘের প্রচণ্ড গর্জন, আর এক ইংরেজের প্রচণ্ড গোঙানির আওয়াজ বের হতো। পুরো খেলনাটি ছিলো এরকম: একজন ইংরেজ একটি বাঘের থাবার মধ্যে অসহায়ভাবে পড়ে গোঙাচ্ছে আর একটা বাঘ প্রচন্ড আওয়াজ করে সেই ইংরেজের বুকের উপর চেপে গলা কামড়ে ধরতো। তখন ইংরেজটি তার হাত উঠিয়ে চেষ্টা করতো বাঘের মাথাটি এদিক-ওদিক সরিয়ে দিতে। ভিতরকার অর্গান থেকে আরো বেরিয়ে আসতো মহীশূর সুলতানের প্রিয় গজলের সুর। "টিপু'স টাইগার" বানানোর পিছনে একদিকে যেমন ছিলো তাঁর ইংরেজদের প্রতি উষ্মা, তেমনি অন্যদিকে ছিলো প্রচন্ড ব্যঘ্রপ্রীতি। সময় পেলেই তিনি বাঘটিতে দম দিতেন; কখনও কখনও রাতের পর রাত একই জিনিস দেখে গায়ের জ্বালা মেটাতেন।
সূত্র:
আমারদেশ
উইকিপিডিয়া
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন