বুধবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

মন্তব্য প্রতিবেদন : ভারতবন্ধুরা কাছা খুলে নেমেছে

মন্তব্য প্রতিবেদন : ভারতবন্ধুরা কাছা খুলে নেমেছে

মাহমুদুর রহমান
সুশীল(?) দৈনিক প্রথম আলো এবং টাইমস অব ইন্ডিয়া গত সপ্তাহখানেক ধরে খানিকটা আকস্মিকভাবেই ভারত-বাংলাদেশ আবহমান কালের ‘বন্ধুত্বের’ স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিশেষত তরুণদের মগজ ধোলাইয়ের কাজে যৌথভাবে মাঠে নেমেছে। তাদের ভাষায়, বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীবন্ধন অধিকতর জোরদার করার জন্যই এই যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই উপলক্ষে প্রকাশিত বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক পত্রিকাটির গত বুধবারের সংখ্যাটি পাঠ করে এক প্রকার অনাবিল আনন্দ উপভোগ করেছি।
পাঠকের স্মরণে থাকার কথা যে, ২০০৭ সালে প্রথম আলো ও তাদের সহযোগী ইংরেজি পত্রিকা দি ডেইলি স্টার জেনারেল মইন উ আহমেদের নেতৃত্বাধীন ভারতপন্থী সামরিক সরকারের Friend, Philoshoper, Guide-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। এদেশের রাজনীতির বহুল বিতর্কিত ‘মাইনাস-টু’ ফর্মুলার শুধু সমর্থনই পত্রিকা দু’টি ও সম্পাদকদ্বয় করেননি, এর পক্ষে জনমত গঠনের জন্যও সেই সময় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাদের সেই কর্মকাণ্ড নিয়ে দেশের বিশিষ্টজনরা গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি করেছেন। এবারের একুশে বইমেলায় ‘জেল থেকে জেলে’ ও ‘কার মান কখন যায়’ নামে আমার দুটি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কসহ অন্যান্য বিষয়ে এদেশের সুশীল(?) সমাজের নেতৃত্ব প্রদানকারী এবং সবচেয়ে শক্তিশালী মিডিয়া হাউসের কাজ-কারবার নিয়ে উভয় গ্রন্থেই আমার নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণ রয়েছে।
তবে অতীতচারিতা নয়, আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য মূলত প্রথম আলোর সর্বশেষ মগজ ধোলাই প্রকল্প সম্পর্কে জনগণকে সাধ্যমত সচেতন করে তোলা। বুধবারের সংখ্যায় ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব প্রগাঢ় করার যৌথ উদ্যোগ চালু হওয়ার পর থেকে পুরো সপ্তাহ ধরে প্রথম আলোতে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ এবং প্রচারণা চলছে। 
পত্রিকাটির ঘোষণা অনুযায়ী কথিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উত্সব গত বৃহস্পতিবার আরম্ভ হয়ে আজ ২৯ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে। তবে আমার ধারণা, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে কৃতজ্ঞতা ও বন্ধুত্বের এইসব অমিয় বাণী দেশবাসীকে শুনে যেতে হবে। আগাম প্রচারণার ধরন দেখে মনে হচ্ছে ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে একই গোষ্ঠীর ব্যবহৃত সফল মিডিয়া কৌশলের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও লেখালেখি করা যাবে। আপাতত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীবন্ধনে ফিরে যাই।
গত বুধবারের প্রথম আলোতে যে আবেগাপ্লুত ভাষায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার আবহমান ‘বন্ধুত্বের’ কথা বলে হাহাকার করা হয়েছে, তাতে এ দেশের চিহ্নিত ভারতপন্থীদের কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত রূপটিই যেন ফুটে উঠেছে। আমার আনন্দ অনুভবের কারণটা ওখানেই। ক্রমেই জেগে ওঠা বাংলাদেশের তরুণদের গভীর দেশপ্রেমের প্রকাশ বোধহয় তাদের প্রভুদের অন্তরে পর্যন্ত কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। উপায় খুঁজে না পেয়ে তাই নতুন করে ঘুম-পাড়ানিয়া গানের আয়োজন করতে বাধ্য হয়েছে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বাংলাদেশীয় দোসররা। আমাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশীর সঙ্গে মৈত্রীবন্ধন এগিয়ে নেয়ার স্লোগান নিয়ে প্রথম আলোর বুধবারের সংখ্যায় দেশের তিন বিশিষ্ট সুশীল(?) বুদ্ধিজীবী, সম্পাদক কলম ধরেছেন। তাদের প্রত্যেকের লেখা নিয়েই একে একে আলোচনা করব। তবে, শুরু করছি ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘লঙ্ঘিতে হবে অনাস্থার দুর্গম গিরি’ শিরোনামে লেখাটি দিয়ে। অত্যন্ত উচ্চমার্গের বাংলায় লিখিত কলামটি পড়ে যে কোনো পাঠকেরই মনে হতে পারে, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার সব দায় কেবল হতভাগা বাংলাদেশীদের। তার লেখা থেকেই বরঞ্চ উদ্ধৃত করি!
“কথায় আছে তুমি প্রতিবেশী নির্বাচন করতে পার না। আমরা ভারত বিভাগের সময় প্রতিবেশী চিনে নিয়েছি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সময় প্রতিবেশীরাই বাংলাদেশের জনগণকে আশ্রয় দিয়েছে এবং স্বাধীন হতে সাহায্য করেছে। এ এমন এক আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত যে, ত্রিপুরায় সে দেশের নাগরিকের চেয়ে শরণার্থীর সংখ্যা বেশি হয়ে গিয়েছিল। এমন হৃদ্যতা আমরা হেলায় হারাতে যাব কার জিদে, কার স্বার্থে, কার ছলে, কার কর্মে।...
প্রতিবেশীরা যদি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও আন্তর্জাতিক আইন রীতি মেনে তাদের স্বীয় ভূমিকে কাঁটাতারের বেড়া বা ‘মাজিনো’ লাইন দিয়ে ঘিরে ফেলতে চায়, আমরা সেখানে ‘না’ বলার কে! তবে দেশের সীমান্তে বা অভ্যন্তরে আইনের নামে গুলি করে যে নরহত্যা ঘটে, তা অতীব দুঃখজনক। এরূপ ঘটনা শুধু দুঃখবহ নয়, লজ্জাকরও বটে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে।...”
বিস্ময়করভাবে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের লেখার কোথাও ভারতের পানি, ভূমি, মাদক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বেরুবাড়ীর চুক্তিভঙ্গ, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বাহিনী সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দেয়াসহ সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশীর অন্যান্য অপকর্ম এবং বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার প্রদানে সে দেশের শাসকশ্রেণীর অনীহা ও সঙ্কীর্ণতার কোনো উল্লেখ নেই। এক ১৯৭১ সালে সহায়তার জন্য আমাদেরকে সহস্র বছরের দাসত্ব গ্রহণের একতরফা আহ্বানই ফুটে উঠেছে লেখাটির সর্বাঙ্গে। ভিনদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এত আগ্রহ ও সমর্থন যে ভারতীয় শাসকশ্রেণীর, তারাই আবার কাশ্মীর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যের জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ৬৫ বছর ধরে সেনাবাহিনীর বুটের নিচে পিষ্ট করে রাখে কোন আদর্শ ও নৈতিকতার ভিত্তিতে—এই যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপন করলে আমার বিরুদ্ধে বোধ হয় ভারত-বিরোধিতার অভিযোগ তুলবেন না বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীবন্ধনের উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তার পেছনে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ যে ক্রিয়াশীল থেকেছে, এই সত্য যারা এ দেশের জনগণকে ভুলিয়ে দিতে চান, তাদের বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষশক্তি হিসেবে বিবেচনা করার উপায় নেই। ১৯৭১ সালের পাকিস্তানপন্থী রাজাকারদের সঙ্গে এদের চরিত্রগতভাবে কোনো পার্থক্য নেই। তখনকার রাজাকাররা পিন্ডির কবল থেকে আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করেছে, আর চল্লিশ বছর বাদের দিল্লির পদলেহী গোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বিরোধিতা করছে।
বিচারপতি হাবিবুর রহমান অন্যের জিদ, ছল, স্বার্থ ও কর্মে ভারতমাতার হৃদ্যতা হেলায় না হারানোর জন্য দেশবাসীকে নসিহত করেছেন। একই লেখার অন্য এক স্থানে তিনি হিন্দু অবিভক্ত পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের মহানুভবতা ও বিশাল হৃদয়েরও জয়গান গেয়েছেন। তার লেখা পড়ে ধারণা হতে পারে, মুসলমান পরিবারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে এই বিরল গুণগুলো থাকে না, তারা সবাই স্বার্থপর ও ক্ষুদ্র হৃদয়ের মানুষ। অবশ্য এমনও হতে পারে লেখক তার নিজ পরিবারে কোনো বিশাল হৃদয়ের মানুষ খুঁজে পাননি। যাই হোক, আমি যতদূর জানি বিচারপতি হাবিবুর রহমান জন্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গেরই নাগরিক। ১৯৪৭ সালের তারই কথিত ভারত বিভাগের (স্বাধীনতা অর্জন নয়) পর তিনি সম্ভবত সপরিবারে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর থেকে পালিয়ে এপারের রাজশাহীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে আসার সময় হিন্দু কর্তাদের মহানুভবতার কথা কেন তার স্মরণে পড়েনি, এ এক পরম বিস্ময়। আজন্ম পরিচিত ও মহত্ সব প্রতিবেশীদের ছেড়ে বাংলাদেশের অজানা ভূমিতে হিজরত করতে কে তাকে বাধ্য করেছিল? তার মতো অগাধ পাণ্ডিত্যসম্পন্ন ব্যক্তি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র আদর্শে মহীয়ান ভারতে থেকে গেলে নিশ্চয়ই সে দেশেরও প্রধান বিচারপতির আসন অলঙ্কৃত করতেন, রাষ্ট্রের শীর্ষ নির্বাহীও হতে পারতেন বাংলাদেশের ন্যায়। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা সংখ্যায় ২৫ শতাংশ হলেও সরকারি চাকরিতে আজ পর্যন্ত ৩ শতাংশ অতিক্রম করতে না পারার ব্যর্থতার জন্যও বিচারপতি হাবিবুর রহমান সম্ভবত সেখানকার মুসলমানদের অশিক্ষা ও মেধাশূন্যতাকেই দায়ী করবেন। শিক্ষা কিংবা মেধার সেই অভাব তার তো নিশ্চয়ই ছিল না। ভারত ছেড়ে আসার পর সেদেশের গুণকীর্তনের মধ্যকার স্ববিরোধিতা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতো একজন পণ্ডিত ব্যক্তির নজর এড়িয়ে যাওয়া বিস্ময়কর ঠেকেছে।
সীমান্তে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার মধ্যেও লেখক আপত্তিকর কিছু খুঁজে পাননি। সত্যিই তো, তাদের জমিতে তারা তারের বেড়া কেন, কংক্রিটের দেয়াল তুললেও-বা আমরা বলার কে? কিন্তু কথা হলো সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া এবং মৈত্রীবন্ধন কি হাত ধরাধরি করে চলতে পারে? এদিকে আবার বন্ধুর চাহিদামত বাংলাদেশকে শত খণ্ডে বিভক্ত করে করিডোর দেয়ার জন্য এই একই সুশীল(?) গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই উদগ্রীব হয়ে আছে। কাঁটাতারের বেড়া অক্ষত রেখে কোন পন্থায় করিডোর দেয়া যেতে পারে, এই প্রশ্নের জবাবও বিচারপতি হাবিবুর রহমানের লেখায় নেই। অনেক কুণ্ঠাসহকারে লেখক সীমান্ত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু সেখানেও ভারতীয় হত্যাকারী বাহিনী বিএসএফের নাম ব্যবহৃত হয়নি। এ যেন মোঙ্গল বাহিনীর বাগদাদ ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস রচনা করব অথচ হালাকু খান পর্দার অন্তরালে থেকে যাবে। অথবা মার্কিন বাহিনী কর্তৃক ইরাক ধ্বংস এবং সেখানে যুদ্ধের নামে গণহত্যা ও লুণ্ঠন চালানো নিয়ে লেখালেখিতে জর্জ বুশ সিনিয়র ও জুনিয়র নাম দু’টি উল্লেখ করা যাবে না। উল্টো বিচারপতি হাবিবুর রহমান আমাদের নাগরিকদের হত্যা বন্ধে ‘সংশ্লিষ্ট সবাইকে’ সচেষ্ট হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অর্থাত্ ফেলানীকে নির্মমভাবে হত্যা করে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখার দায় ফেলানীর ওপরও খানিকটা চাপিয়েছেন বাংলাদেশের এই বিশিষ্ট ভারতপ্রেমী নাগরিক। ‘লঙ্ঘিতে হবে অনাস্থার দুর্গম গিরি’ শিরোনামের লেখাটির মূল সুর হলো বৃহত্ প্রতিবেশীর সব অত্যাচার, অবিচার বিনা প্রতিবাদে সহ্য করে এবং জাতির সব স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে হলেও আধিপত্যবাদী ভারতের সঙ্গে হৃদ্যতা আমাদের বজায় রাখতেই হবে। স্বাধীনতার চেতনার কী অপূর্ব বয়ানই না করেছেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান!
গান্ধীবাদী কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ তার লেখায় অনেকটা বাংলাদেশের জনগণের স্বঘোষিত মুখপত্র সেজে দাবি করেছেন যে, তারা নাকি ভারতের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের জন্য আকুল হয়ে আছে। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের মূল ধারার শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীরা শুধু নন, সাধারণ মানুষও যে ভারতের সঙ্গে স্থায়ী বন্ধুত্ব চায়, তা তারা গত নির্বাচনে জানিয়ে দিয়েছে।’ ২০০৮ সালের নির্বাচন যে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর একটি ‘রেফারেন্ডাম’ ছিল এই চমকপ্রদ তথ্যটি সৈয়দ আবুল মকসুদের কাছ থেকেই প্রথম জানলাম। জানি না ভবিষ্যতে এটাও শুনতে হবে কিনা ২০০৮ সালের ডিজিটাল নির্বাচনে শেখ হাসিনা বিপুলভাবে জয়লাভ করায় সিকিমের মতো করে বাংলাদেশের ভারতভুক্তিও জনগণ কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে গেছে। সৈয়দ আবুল মকসুদ হয়তো ভুলে গেছেন যে ১৯৯১ এবং ২০০১ সালে একই বাংলাদেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাহলে কি ওই দুই নির্বাচনে জনগণ শেখ হাসিনার ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের বিরুদ্ধেও রায় প্রদান করেছিল? নাকি শেখ হাসিনার মতো করে এখন থেকে সৈয়দ আবুল মকসুদও দাবি করবেন যে এ দেশে কেবল ১৯৯৬ এবং ২০০৮-এর নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য ও পক্ষপাতশূন্য হয়েছিল, বিএনপি যে দুই নির্বাচনে জয়লাভ করেছে সেখানে জনরায় পাল্টে দিতে যথাক্রমে সূক্ষ্ম ও স্থূল কারচুপির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশের একমাত্র প্রকাশ্য গান্ধীবাদী কলামিস্টের এই আজব বিশ্লেষণ আমার অন্তত বোধগম্য হয়নি। অবশ্য, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এসব বিষয়ে আমার জ্ঞান ও লেখাপড়াও যত্সামান্য। তবে বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীই বোধ হয় একটিমাত্র জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে দেশের তাবত্ মানুষের দীর্ঘমেয়াদি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কোনোপ্রকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে সম্মত হবেন না। তাছাড়া ২০০৮-এর নির্বাচনেও তো প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার মহাজোটের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। সৈয়দ আবুল মকসুদের দাবি অনুযায়ী এই ভোটাররাও কি ভারতের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব পিয়াসী? 
সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখাটির স্ববিরোধিতা অতুলনীয়। লেখার যে অনুচ্ছেদে তিনি বাংলাদেশের জনগণের ভারতের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের প্রবল আকাঙ্ক্ষার দাবি করছেন, তার ঠিক আগের অনুচ্ছেদের প্রথম লাইনেই লিখেছেন, অনন্তকাল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক একই রকম থাকে না। একদিকে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের বাসনা আবার অপরদিকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যে পরিবর্তনশীল সে বিষয়ে স্বীকারোক্তি, পাঠকের মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা একেবারে। লেখার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘দুই দেশের অভিন্ন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হাজার হাজার বছরের। একই জাতিসত্তার মানুষ দুই দেশের নাগরিক। তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও মোটের ওপর এক।’ এখানে লেখক দুই দেশ বলতে কি বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ বুঝিয়েছেন? কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তো বৃহত্ ভারতের একটি অবহেলিত, উপেক্ষিত রাজ্য মাত্র। আর যদি লেখক পুরো ভারত বুঝিয়ে থাকেন—তাহলে পাঞ্জাবি, তামিল, কাশ্মীরি এবং বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সাহিত্য এক হয় কী করে? আমরা কি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরেই উর্দুর বিরুদ্ধে লড়াই করে এদেশে বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করি নাই? আরও কথা আছে। আমাদের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার কথা বলতে গিয়ে তিনি যদি পাক-ভারত উপমহাদেশ বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে পাকিস্তানের অবস্থান কোথায়? পূর্ব পাঞ্জাবের হিন্দু অধিবাসীদের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য মোটের ওপর এক হলে, পশ্চিম পাঞ্জাবের মুসলমান অধিবাসীদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বয়ানটা কী রকম হবে? নাকি ব্রাহ্মণ্যবাদের অনুসারীদের কাছে বাবরের আওলাদ (ভারতীয় জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দের দেয়া বিশেষণ), ম্লেচ্ছ মুসলমানরা অস্পৃশ্য! পাগল প্রেমিক যেমন দয়িতার রূপ-গুণে কোনো খুঁত খুঁজে পায় না, সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখাতেও আমি তেমনই ভারত-প্রেমে দেওয়ানা একজন অন্ধ সুশীলকেই খুঁজে পেয়েছি।
যশস্বী সম্পাদক মতিউর রহমান তার লেখায় ভারতকে দরজা খুলে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি কুশলী মানুষ। তাই বিচারপতি হাবিবুর রহমান এবং সৈয়দ আবুল মকসুদের মতো প্রেমময় আবেগের তোড়ে পুরোপুরি ভেসে যাননি। সৈয়দ আবুল মকসুদ পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণের ইতিহাস, সাহিত্য এক করে ফেললেও সাবধানী মতিউর রহমান লিখেছেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নানা অনিষ্পন্ন সমস্যার চেয়ে বড় ও ইতিহাস-নির্ধারিত বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে গভীর ঐক্যের সুর। অর্থাত্ প্রেমের আকুতিতে তেমন তফাত্ না থাকলেও লেখার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ন্ত্রিত মন্তব্য করে তথাকথিত নিরপেক্ষতার আবরণ ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। পেশাদার সম্পাদকের পরিমিতিবোধ এখানে কিছুটা হলেও ক্রিয়াশীল থেকেছে। কলকাতায় অনুষ্ঠিত মৈত্রীবন্ধন উত্সবে গিয়ে অবশ্য সম্পাদক মতিউর রহমান তার আবেগ আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেননি। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অমোচনীয় আবেগে বাঁধা। আমাদের আছে অভিন্ন ইতিহাস, আছে অভিন্ন সংস্কৃতির উত্তরাধিকার।’ অর্থাত্ আবারও সেই দেহ-মনে লীন হয়ে যাওয়ার আকুতি।
তার সম্পাদিত পত্রিকাটির উদ্দেশ্য পরিষ্কার। বাংলাদেশকে যে কোনো মূল্যে ভারতীয় বলয়ের মধ্যে বেঁধে রাখতে হবে। ভারতীয় জেনারেলরা বলছেন, ১৬ কোটি মানুষের এই ভূখণ্ডটিকে আর কখনও ভারতীয় রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না। সে কাজটি তারা করবেন বন্দুক, বুলেট ব্যবহার করে। আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় এজেন্টরা মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমান্তরালভাবে এ দেশের তরুণ সমাজের মগজ ধোলাইয়ের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজটি চালিয়ে যাবেন। তরুণদের ভারতপ্রেমে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারলে ভারতীয় জেনারেলদের কষ্ট করে কামান-বন্দুক ব্যবহার করতে হবে না।
প্রচারণার মুন্সিয়ানা আমরা ২০০৮ সালের নির্বাচনে এবং ভারতকে বিনাশুল্কে করিডোর দেয়ার প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ করেছি। প্রথম আলো, দি ডেইলি স্টার, চ্যানেল আই এবং সিপিডি অক্ষশক্তি যৌথভাবে প্রায় দেড় যুগ ধরে শুধু অব্যাহত প্রচারণার কল্যাণে ট্রানজিটের মোড়কে করিডোরকে হালাল করে ফেলেছে। এবার শুরু হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়ার পালা। একই চিহ্নিত গোষ্ঠী যে তাদের আগের খেলায় অবতীর্ণ হয়েছে, তার সর্বশেষ প্রমাণ গত বুধবারের প্রথম আলো। সেই এক-এগারো থেকেই সুশীলের (?) তকমাধারী ভারতপ্রেমীদের দেশবিরোধী চরিত্র উন্মোচনের চেষ্টা করে চলেছি। জেল, জুলুম, হয়রানি, হুমকি কোনো কিছুরই পরোয়া করিনি। সুশীলদের অনুকরণে কোনো সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের বিনিময়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তা খোঁজার বৃথা চেষ্টায় ঈমান বিসর্জন দিইনি।
ক’দিন আগে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। সেই সফরে ডেইলি স্টার কার্যালয়ে তিনি কয়েকজন সম্পাদকের সঙ্গে মিলিত হয়ে এদেশের গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও হয়রানি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সম্পাদকদের সঙ্গে সভায় মার্কিন দূতাবাস থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও সভাস্থল (Venue) নিয়ে আপত্তির কারণে সেখানে অনুপস্থিত থেকেছি। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার মিডিয়া গ্রুপের ঠিক বিপরীত মেরুতে আমার আদর্শিক অবস্থান। কাজেই মার্কিন দূতাবাসের সন্তুষ্টি অর্জনের চাইতে বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনতার পক্ষে কলমের লড়াই অব্যাহত রাখাই আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যাচ্ছে, ভারতের সেবাদাসরা শেষ পর্যন্ত কাছা খুলেই ময়দানে নেমেছে। ভয়ঙ্কর প্রতিকূলতার মধ্যেও এ দেশের তরুণদের প্রতি আবারও দেশমাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষায় জেগে ওঠার আহ্বান জানাই। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, অর্থ ও কৌশলে প্রতিপক্ষ অধিকতর শক্তিশালী হলেও বাংলাদেশের তরুণদের জাগরণের চিহ্ন সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি। মহান আল্লাহ সহায় থাকলে ১৯৭১ সালের মতো এবারও আমরাই বিজয়ী হবো।
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
আমার দেশ: ২৯/০২/২০১২

বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

দেশপ্রেম যখন বিপজ্জনক আবেগ

দেশপ্রেম যখন বিপজ্জনক আবেগ

দেশপ্রেম যখন বিপজ্জনক আবেগ

॥ আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ॥

দেশপ্রেম যে কখনো কখনো বিপজ্জনক হতে পারে, বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে দেশী-বিদেশী শাসকেরা দেশবাসীকে নানাভাবে বিভক্ত করার চেষ্টা করে যে কাজটি করতে সক্ষম হয়নি, গত ৪০ বছরে তিন মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সুচারুভাবে সেটি সম্পন্ন করেছে। এই বিভাজন ভাষাগতও নয়, ধর্মীয়ও নয়। ‘স্বাধীনতার পক্ষ’ ও ‘স্বাধীনতার বিপক্ষ’ শক্তি নামে দু’টি পক্ষ দাঁড় করিয়ে মাঝখানে একটি সীমারেখা টেনে দেয়া হয়েছে। এ রেখাকে সীমারেখা না বলে ‘লক্ষ্মণ রেখা’ বলাই উত্তম। আওয়ামী লীগের টেনে দেয়া এই লক্ষ্মণ রেখা অতিক্রম করলে দেশের কে কী অভিধায় ভূষিত হবেন তা অনুমান করাও কঠিন। রামায়ণের কাহিনী অনুসারে রাম তার স্ত্রী সীতাসহ অযোধ্যা থেকে ১৪ বছরের জন্য নির্বাসিত হন এবং ভ্রাতৃ-অন্তপ্রাণ লক্ষ্মণ তাদের অনুগমন করেন এবং দণ্ডকারণ্যে বনবাস যাপনকালে একদিন রাম শিকারে গেলে সীতার প্রহরায় ছিলেন লক্ষ্মণ। রামের ফিরে আসতে বিলম্ব দেখে সীতা লক্ষ্মণকে বলেন ভাইকে খুঁজে আনতে। লক্ষ্মণ প্রথমত সম্মত হননি, কিন' সীতার পীড়াপীড়িতে রাজি হলেও কুটিরের চার পাশে একটি রেখা টেনে সীতাকে নিষেধ করেন যাতে কিছুতেই তিনি সেই রেখা অতিক্রম না করেন। লক্ষ্মণ চলে যাওয়ার পর সাধুবেশী রাক্ষস রাজা রাবণ উপসি'ত হয় এবং ভিক্ষা চায়। রাবণের কৌশল বুঝতে না পেরে সীতা ভিক্ষা দিতে রেখা অতিক্রম করতেই রাবণ তাকে বলপূর্বক পুষ্পক রথে তুলে লঙ্কায় নিয়ে যায় এবং এরপর সীতাকে উদ্ধারের জন্য দীর্ঘ যুদ্ধ চলে।

আওয়ামী লীগ যেহেতু দেশপ্রেমের মনোপলি দখল করেছে, অতএব তাদের অপছন্দনীয় যে কাউকে স্বাধীনতার বিপক্ষের লোক বা স্বাধীনতাবিরোধী বলে চিহ্নিত করতে কোনো দ্বিধা করছে না। কারণ তারা আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে ক্ষমতায় গিয়ে, গাড়িতে-বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেশ পরিচালনা করে ‘লক্ষ্মণ রেখা’ অতিক্রম করেছে। অতএব রাবণের হাতে তাদেরকে পড়তেই হবে। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা না হয় অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন, ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্য বিস্তারের আশঙ্কায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে অপরাধ(?) করেছেন, কিন' বিএনপি বা বিরোধী দলের অন্যদের কেন একই অপবাদের শিকার হতে হচ্ছে? ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিএনপি চেয়ারপারসন ও বিরোধীদলীয় নেতা ভারতে না গিয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কেন ছিলেন, এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বেগম জিয়াকে কটাক্ষ করে অনেক বাজে মন্তব্য করেছেন। কিন' শেখ হাসিনাও তো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে সপরিবারে ঢাকা শহরেই অবস'ান করেছেন। তাদের কারো গায়ে আঁচড়টুকু পড়েছিল, এমন শোনা যায়নি। এ নিয়ে তার দেশপ্রেমে ঘাটতি ছিল- এমন প্রশ্ন কেউ তোলেনি। তাহলে কি ব্যাপারটি এমন যে কেউ যদি নিজেকে সবার চেয়ে সেরা বলে মনে করেন, তাহলে একটি পর্যায়ে নিজের অস্তিত্ব ও অতীত সম্পর্কে বিস্মৃত হন। মির্জা গালিবের একটি কবিতায় আছে, ‘হাম উঁহা হ্যায় জাহা সে হামকো ভি কুচ হামারি খবর নেহি আতি’। (আমি এমন এক স্তরে পৌঁছে গেছি, যেখান থেকে আমি নিজের কোনো খবরও পাই না)।

দেশপ্রেম এক বিস্ময়কর অনুভূতি ও আবেগ এবং দেশের জন্য মানুষ জীবন ও সম্পত্তি বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করে না। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী সর্বত্র সমভাবে প্রযোজ্য। ২০০ বছর ধরে বিশ্বের বহু দেশ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে। কোথাও রক্তক্ষয় বেশি হয়েছে, কোথাও কম হয়েছে। কিন' এমন কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না যে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত কোনো একটি দেশের শতভাগ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। উপমহাদেশে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ের সময় এর বিরোধিতা করার মতো যথেষ্ট লোক ভারতজুড়েই ছিল। তারও আগে ১৮৫৭ সালে ‘সিপাহি বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পেছনে ভারতীয়দের অবদানই ছিল বেশি। তা না হলে তখনই ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিদায় নিতে হতো অথবা এ দেশেই তাদের কবর রচিত হতো। 

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাজনের সময়ও মুসলমানদের একটি বড় অংশ পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভারতেই রয়ে গেছে। আবার অনেক হিন্দু অখণ্ড ভারতের পক্ষাবলম্বন করেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানেই ছিলেন, যার প্রমাণ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান কংগ্রেস। পূর্ব বাংলা আইন পরিষদে কংগ্রেসের ১৩ জন নির্বাচিত সদস্যও ছিলেন। পাকিস্তান সরকার তাদেরকে দেশদ্রোহী হিসেবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়নি। একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহু দল-মতের অস্তিত্ব থাকবে, এটিই স্বতঃসিদ্ধ। এই সত্যকে মানতে না পারলেই বিভাজন ও সঙ্ঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশকে আর কেউ ভালোবাসে না, অথবা আর কেউ ভালোবাসলেও তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো বাড়াবাড়িতে দেশ আজ সেই সঙ্ঘাতের মুখে। এ সঙ্ঘাত থেকে দেশকে উদ্ধার করতে যে বোধ প্রয়োজন, আওয়ামী লীগের সেই বোধের উৎস রুদ্ধ হয়েছে। 

বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন এক কথা, আর দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশকে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী, দেশদ্রোহী, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক প্রত্যয় ব্যক্ত করা ভিন্ন ব্যাপার। আওয়ামী লীগবহির্ভূত জনগণের অবশিষ্টাংশ বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করলেই কারো দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করার যে ম্যানিয়া বা বাতিক আওয়ামী লীগ পুষে রেখেছে, তা এখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের বাতিকগ্রস্ত একটি দলের নেতৃত্বে দেশের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারাচ্ছন্ন তা উপলব্ধির জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। দেশকে একটি স'ায়ী সঙ্ঘাতময় পরিসি'তির মধ্যে রেখে দেশের উন্নয়ন আশা করা আর বোকার স্বর্গে বাস করা একই কথা।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর যখন স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ ও সুসংহত করাই ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের প্রধান কাজ, ঠিক সে সময় তারা তাদের বিরুদ্ধে সদ্য গজিয়ে ওঠা বিরোধী রাজনৈতিক দল জাসদের নেতাকর্মী ও যারাই ভারতের সাথে আওয়ামী লীগের অতিরিক্ত মাখামাখির বিরুদ্ধে সামান্য আওয়াজ তুলেছে তাদেরকে নির্মূল করার অভিযানে নেমেছিল। তাদেরকে হত্যা করেছে। বিনাবিচারে কারাগারে আটকে রেখেছে। অথচ মাত্র কিছু দিন আগেই তারাও মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সহযোদ্ধা হিসেবে একত্রে যুদ্ধ করেছে। জাসদ তখন দাবি করত যে আওয়ামী সরকার তাদের ৪০ হাজার নেতাকর্মী হত্যা করেছে। কিন' এখন ইতিহাসের গতি পাল্টেছে জাসদ আওয়ামী লীগের সাথে গাঁটছড়া বাঁধায়। জাসদ নেতারা এখন শেখ হাসিনার ইশারায় রাজনৈতিক মাঠে ওঠবোস করেন। কী বিচিত্র এই দেশ! আর বিচিত্র এ দেশের রাজনীতি! স্বাধীনতার পর যারা তখনকার নেতৃত্বে ছিলেন তাদের আহ্বান একটাই হওয়া উচিত ছিল যে প্রত্যেকের কাছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দাবি হচ্ছে, তারা তাদের নিজ নিজ অবস'ান থেকে দেশের জন্য তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবেন। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও নতুন উদ্যমে দেশকে গড়ার জন্য এ আহ্বান মন্ত্রের মতো কাজ করতে পারত। কিন' তার পরিবর্তে পরিত্যক্ত সম্পত্তি লুণ্ঠন, উচ্চপদ দখলের প্রতিযোগিতা, বিদেশ থেকে আসা ত্রাণসামগ্রীর ঢালাও চুরির প্রতিযোগিতা এবং যে ক্ষীণ রাজনৈতিক ভিন্নমত ছিল তা মেনে নেয়ার সহনশীলতা না থাকায় দেশ শুরুতেই যে অসি'রতার চক্রে পড়েছে, তা থেকে ৪০ বছরেও বের হতে পারেনি। কবে পারবে সে সম্পর্কে ধারণা করার খেইও হারিয়ে ফেলেছেন প্রকৃত বিশেষজ্ঞরা। 

জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম স্বভাবগতভাবে থাকলেও দেশপ্রেমকে জাতীয় ঐক্যের প্রতীকে পরিণত করতে হলেও প্রয়োজন মেধাবী নেতৃত্বের, যে নেতৃত্ব শুধু নিজেকে ও দলীয় লোকদেরকে দেশপ্রেমিক বিবেচনা করার পরিবর্তে সবাইকে দেশপ্রেমিক ভাববে, কারো মধ্যে দেশপ্রেমের ঘাটতি আছে মনে হলে তাদেরকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। কিন' নেতৃত্বের মধ্যে যদি দেউলিয়াপনা থাকে, দেশের সব জনগোষ্ঠীকে একভাবে দেখার দৃষ্টি না থাকে, অন্যের ত্রুটিকে পুঁজি করে দেশকে অসি'তিশীল করে রাখার মানসিকতা থাকে, তাহলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সার্বক্ষণিক আতঙ্কের মধ্যে থাকবে এবং কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলবে। যখন দেশ সঙ্কটে পড়বে তখন তারা আর সঙ্কট উত্তরণে ঝাঁপিয়ে পড়বে না। ইতিহাসে চরম নিন্দিত শাসকদের অন্যতম হিটলারও তার দেশবাসীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ছয়-সাত বছরের মধ্যে জনগণকে পিতৃভূমি রক্ষায় যুদ্ধের জন্য প্রস'ত করেছিলেন। দেশপ্রেমের আবেগকে সঠিক পথে চালিত করতে পারলে তা দেশের জন্য যথার্থই কল্যাণকর। কিন' এই আবেগকে প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করে জনগণের একটি অংশকে ক্ষেপিয়ে তুললে তা নৈরাজ্য সৃষ্টি ছাড়া দেশের জন্য শুভ কিছু বয়ে আনবে না তা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কারণ আওয়ামী দেশপ্রেমের মাত্রা সব সীমা ছাড়িয়ে রূপ নিয়েছে ধর্মান্ধতায়, যার বিপদ আসন্ন। দেশপ্রেমে মাতাল হয়ে তারা আরেকটি যুদ্ধ করতে প্রস'ত। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু, ধ্বংস। প্রায় প্রতি বছর সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও জনভারে ন্যুব্জ, নানা সঙ্কটে বিপর্যস্ত এই ক্ষুদ্র জনপদ ১৯৪৭ সালে মৃত্যু ও ধ্বংস দেখেছে। ১৯৭১ সালের ঘটনা ছিল হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা। সাময়িক বিরতির পর ধ্বংসের কবলে পতিত হওয়াই কি বাংলাদেশের ললাট লিখন? যে দেশপ্রেম জনগোষ্ঠীর একটি অংশের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে, প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ছুরি উঁচিয়ে ধরতে প্ররোচিত করে দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়, এমন দেশপ্রেম নিন্দনীয়, ঠিক যেভাবে শেষ পর্যন্ত নিন্দিত হয়েছিল হিটলার ও তার অনুগতদের দেশপ্রেম।

বাংলাদেশে দেশপ্রেমের একচ্ছত্র ইজারাদার আওয়ামী লীগের দেশপ্রেম নিয়েই জনগণ বেশি সন্দিহান। কারণ বিপদে পড়লেই সীমান্তের ওপারে তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় রয়েছে। জনগণের সন্দেহের থোড়াই পরোয়া করে আওয়ামী লীগ। মহান সৃষ্টিকর্তাই এই দলটির নেতাকর্মীদের এমন উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, তারা সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করতে দ্বিধা করেন না। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বেমালুম অস্বীকার করা, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ অধিবেশনে যোগ দিতে এসে বিরোধী দলের নেতার সাথে বৈঠকে বসার সম্ভাবনা সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ‘চোর-বাটপারদের সাথে কিসের বৈঠক’ বলে দেশে ফিরে তিনি এমন কথা বলেননি বলে এড়িয়ে যাওয়া এবং মাত্র ১৩ দিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রুনি-সাগর হত্যাকারীদের ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে’ ঘোষণা করে পরে এ সম্পর্কে ভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়ার যোগ্যতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আর কোনো দল দেখাতে পারেনি। তারা ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থে দেশকে বারবার সঙ্কটে ফেলেছে এবং জনগণকে সেই সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসতে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। কিন' সব কিছুর একটা শেষ আছে। সীতাকে অপহরণকারী রাবণকেও পরাজিত হতে হয়েছিল। তার সোনার লঙ্কা আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল। দেশ ধ্বংস হওয়ার আগেই দেশবাসী আওয়ামী রাবণের হাত থেকে মুক্ত হবে বলে আশা করি। আরো একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো, দেশপ্রেমের তকমা পাওয়া দেশপ্রেমিকের জন্য প্রয়োজনীয় কোনো বিষয় নয়। স্যার উইলিয়াম স্কট দেশপ্রেমের ওপর তার এক কবিতার শুরুতে উল্লেখ করেছেন, ÔBreathes there the man with soul so dead. Who never to himself hath said, This is my own, my native land!Õ’ এবং কবিতার শেষে বলেছেন এমন দেশপ্রেমিক তার নিজ দেশে কখনোই সম্মান বা স্বীকৃতি লাভ করবেন না। অতএব প্রকৃত দেশপ্রেমিকদের আফসোস করার কোনো কারণ নেই।