রবিবার, ২৮ আগস্ট, ২০১১

ঈদাতঙ্ক(!)

 ঈদাতঙ্ক!
-নিমু মাহবুব

আমি মহা বিপদে আছি।বিপদে মানে ফাঁপড়ে আছি ঐ সন্ধি বেটাকে নিয়ে। বেটার বংশ লতিকা এত লম্বা যে আমার একার পক্ষে এ বেটার ইতিহাস উদ্ধার করা আর অগ্নি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া প্রায় সমান। ভাবতে পারেন এ আর এমন কঠিনতর কি। না গো ভাইসাহেবেরা ও ভগিনি সাহেবীরা। ব্যাকরণ নামক বাংলা ভাষার সংবিধানের সন্ধি অনুচ্ছেদের ধারা, উপধারা, প্রতিধারা সমূহের উপর আপনার মূল্যবান নয়ন দুটিকে আছাড় খাইয়ে আনুন। বলতে পারেন স্বরসন্ধি আর ব্যঞ্জনসন্ধির উপর থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিলেইতো সন্ধির কেল্লাফতে।এত্তোসোজা না গো।শুধু স্বরসন্ধি আর ব্যঞ্জনসন্ধির আওলাদ-পরজনের বংশ-দড়ি ম্যালা লম্বা।তার উপর আরো আছে র-জাত সন্ধি, স-জাত সন্ধি, অ-জাত সন্ধি, কু-জাত সন্ধি ইত্যাদি।ভাবতে পারেন আষাঢ় মাস সরবে প্রস্থান করার পরও কেন সন্ধি নিয়ে আষাঢ়ে গল্প পাঁতার এই অপচেষ্টা। পাঠক সাহেব ও পাঠিকা সাহেবীরা দয়া করে অধৈর্য লইয়েননা।শিরোনাম দেখেই তো বুঝতে পারছেন সন্ধি মিঞার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করা কোনভাবেই আজকের লেখার বিষয়বস্তু নয়।বিষয়বস্তু তো ঠিক করাই আছে।সেটা হল ঈদ।আর ঈদ নিয়েই আপদ মানে আতঙ্ক। সুতরাং বুঝা গেল সন্ধি বেটার বংশ লতিকার আলোকপাতের হেতু ঐ একটাই যে, ঈদ যোগ আতঙ্ক, সমান সমান ঈদাতঙ্ক শব্দটা সন্ধি আইনের কোন অনুচ্ছেদের কোন ধারার কত নং উপধারা অনুযায়ী গঠিত তা আমার মত কূপমন্ডুকের জ্ঞানের নেটওয়ার্কের বাইরে। যা-ই হোক সন্ধি বেটার লেজ নিয়ে লাড়া চাড়ায় আর কাজ নেই।কারণ এ বেটার সম্পর্কে আমার জ্ঞান সমুদ্র যে কত গভীর (!) তাই ইতিমধ্যে আপনারা বোধকরি আঁচ করতে পেরেছেন। তাই চলুন শিরোনামীয় বিষয়েই পা চালাই। ঈদ যোগ আতঙ্ক সমান সমান ঈদাতঙ্ক। আপনারা যা-ই বলুন, ঈদের সাথে যে আতঙ্কের এক বিরাট দহরম-মহরম আছে তা বাংলা নামক দেশটির (অ)বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের অজ্ঞতাপূর্ণ বেফাঁস মন্তব্যের মত আদৌ বেহুদা নয়। ভাবতেছেন ঈদ মানে তো খুশি, আনন্দ- উল্লাস, হৈ-হল্লুড়, আতশবাজি- পটকাবাজি ইত্যাদি। ঈদ আসে বলেই তো নতুন নতুন নানা রকম ফ্যাশনেবল জামা-কাপড় কেনা, মজার মজার পিঠা-পায়েস, শিরনি সেমাই খাওয়া, বড়দের পকেট কাটা মানে সেলামী আদায় আরো কত কি, আহা! আরে ভইজানেরা বোইনজানেরা গো, কয়েনের শুধু হেডই দেখলেন টেইলও যে আছে সেটার দিকেও একটু নেক দৃষ্টি দিন। ব্যাপার একেবারে পানির মত না হলেও অন্তত কেরোসিন তেলের মত সোজা মানে সাদা হতে বাধ্য।কালো টাকা , লাল টাকা আরো কত রং এর টাকা যদি সাদা হতে পারে তো কেরোসিন তেল পানির মত পরিষ্কার হওয়াও খুব সম্ভব। এখন তো ডিজিটাল সময়। এ সময় কোন কিছু্ একদম অসম্ভব নয়।দেখেননা এ যুগে পরপারে যাওয়া কত্তো সোজা। প্রতিদিন কত বনি আদম বিনা পাসপোর্টে ঐ দেশে তাশরিফ নিচ্ছেন তার হিসাব তো সংবাদজীবীরাও রাখতে পারছেননা।এবার মনে হয় ঈদাতঙ্ক শব্দটা আপনাদের ঘিলুতে আস্তে আস্তে দাগ কাটতে শুরু করছে।না কেটে তো উপায় নাই। কাটতেই যে হবে।কারণ, আর যা-ই বলিনা কেন আপনারা সবাই তো ঐ টালমাটাল সরি সরি ডিজিটাল যুগের দুপেয়ে আদম সন্তান। আচ্ছা, আর ডাক ডাক গুড় গুড় করে লাভ নেই। বরং খুলেই বলি। ইদাতংক হলো নব আবিষ্কৃত মানসিক প্রশান্তি হরণকারী একটি ডিজিটাল রোগ। থেরাপির প্রাজ্ঞসব থেরাপিষ্টবর্গ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অলসভাবে ব্যাপক জটিল ও কঠিন গবেষণার পর এ রোগ সনাক্ত করতে সক্ষম হন। চোখ কপালে তোলা খবর হলো  এ রোগে শুধু গৃহকর্তাগণকেই আছর করে। আর রমণীকুল এ রোগের কু দৃষ্টি থেকে একেবারেই মুক্ত। কারণ টিজ করার সুঅভ্যাস(!) ওনার নেই। ঈদ নামক এই আনন্দপূর্ণ উৎসব উপলক্ষে বাড়ি বা বাসার গিন্নি সাড়ে তের হাত লম্বা ফর্দ গৃহকর্তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যদি বলেন এ্ই চিরকুট সাইজের লিস্টটি এবারের ঈদের জন্য তো সে বাড়ির গৃহকর্তা ঈদাতঙ্কে আক্রান্ত হবেননা বুঝি খুশিতে বাগবাগ হবেন। তাই ঈদের শুভাগমনের সংবাদে কর্তাবৃন্দরা ঈদাতঙ্কে আক্রন্ত হন।আর শুধু গিন্নির সাড়ে বার হাতের ফর্দ হলেই নাহয় একটা দফা রফা করা যেত। ঈদাতঙ্ক রোগের আরো বহু কারণ পাওয়া গেছে থেরাপি ল্যাবে। একমাত্র ছেলের ঈদের ড্রেস হতে হবে কমপক্ষে পাঁচ সেট। নাহয় তো মুখ খানা একেবারে বেডিজিটাল দেখায়। আর আদুরী মা-মনিটির পোশাক-আশাকের সাথে নখ পালিশ, ঠোঁট পালিশ, আই ভ্রু, ইয়ার ভ্রু, চুল ক্লিপ, জুল ক্লিপ ইত্যাদি ডজনে ডজনে চা-ই চা-ই।চাঁন রাতে পার্লারে যেতে না পারলে তো বান্ধবীদের কাছে ওনার মাথা হেঁট হয়ে যায়।আর দ্রব্যমূল্যের অগ্রগতির এ যুগে এসব কথা মাথায় আসতেই কর্তার বেল মাথায় আকাশটা ধপ্পাস করে পতিত হয়। কারণ আরো আছে। কর্তার যদি ইয়াং সাইজের দু –একখানা শ্যালক শ্যালিকা থাকে তো ঈদাতঙ্ক রোগের চৌদ্দ আনা হাসিল হয়।তাদের দাবি-দাবা চাহিবার পূর্বেই পালন করিতে দুলাভাই সম্প্রদায় বাধ্য।নচেৎ ভিতরে ভিতরে  ইরাক যুদ্ধ শুরু হওয়ার গ্যারান্টি-ওয়ারেন্টি দেয়া যায়।তাই ঈদ আসলে তাদের ফাল্গুন মাস আর দুলাভাইকুলের সর্বনাশ।আর এই ঈদাতংকের কথা ভাবতেই তাদের ঈদাতংকের মাত্রা রিখটার স্কেলে ১৮০ পয়েন্টে উঠে।ঈদাতংকের ষোলকলা পূর্ণ হয় ঈদের দিন। এ দিন সেলামীভুকরা পিপিলিকার মত লাইন ধরে আসেন । অতপর পা ছুঁয়ে নিরবে সেলামীর দাবি জানান।কর্তা বেচারার কিচ্ছু করার নাই দাবি মেনে নেয়া ছাড়া।বুবুজানেরা- ভাইজানেরা গো সবাই একজোট হয়ে আমারে বাঁচন। ঈদাতঙ্ক রোগের প্রতিকার বর্নণায় আমাকে জনম থুক্কা দিতে হলো। কারণ কালা আলখেল্লাধারীদের কাছে ধরণা দেয়ার সামর্থ এই ছা পোষা ব্যক্তির নেই। বরং একটা কৌতক শুনা যাক। এক বাসার গিন্নি ও কর্তার সাথে মাঝে মাঝেই ঝগড়া লেগে যেত। প্রথমে গিন্নি কর্তার সাথে কিছুতেই পেরে উঠতেননা।কর্তা যখন বিজয়ীর হাসি হাসার জন্য রেডি ঠিক এ সময়ে গিন্নি বলে উঠতেন, আগামী মাসে আসন্ন ঈদটা মনে হয় মাটিই হবে।ব্যাস, ঈদের কথা শুনে ঈদাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে কর্তা বেটা তৎক্ষণাত চিতপটাং।

প্রহরীহীন কারাগারে

অনিমের মনটা বেশ বিষণ্ন।কিছুই ভালো লাগছেনা। পড়ালেখায়ও মন বসছেনা। চিন্তা শুধু এতবড় বাসায় সে একলা কেমন করে থাকবে।এর আগে সে কখনো ঢাকায় একলা থাকেনি। থাকার প্রয়োজনও হয়নি। মেঝো ভাই শাহিন সাহেবের কড়া নির্দেশ এবার ঈদে অনিমের বাড়ি যাওয়া হবেনা। ঈদের পরেই ইউনিভার্সিটির ভর্তি পরিক্ষা। এখন থেকেই যদি কিছু কিছু স্যাক্রিফাই করতে না শিখে তো বড় হয়ে শিখবে কি করে। বাড়ি গেলে মিরাজ, রমিজ, রাজু, তুহিনদের সাথে আড্ডা দিবে আর ভার্সিটি ভর্তিতে ফেল মারবে তা হবেনা। বরং এখানে থেকে মন দিয়ে এ কয়েকদিন ভালো করে পড়ুক। সামনের ঈদে নাহয় বেশি করেই বেড়াতে পরেবে। শাহিন সাহেবের স্ত্রী অনকে বুঝিয়েছেন যে এখানে একলা থাকলে অনিমের কোন পড়ালেখাই হবেনা। মনমরা হয়ে থাকবে এবং এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। কিন্তু শাহিন সাহেব যেটা একবার বুঝেছেন তা থেকে তাকে ফেরাতে পারে এমন প্রাণী পৃথিবীতে বিরল।অবশেষে রফা হলো অনিম ঈদের আগের দিন য়াবে আর পরের দিন চলে আসবে।
অনিম বরাবরই ঈদে ভাইয়া ভাবীর সাথে একত্রে গ্রামের বাড়ি যায়। এবার ঈদে সবাইে একটু আগেই গ্রামে যাচ্ছে। এর অবশ্য কারণও আছে। অনিমের বড় ভাই নাছিম সাহেবের স্ত্রী পরপর তিনটি মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়ার পর এবার একটি ফুটফুটে ছেলে উপহার দিয়েছে। তাই এবার ঈদের আনন্দ পাঁচ ভাইয়ের ফ্যামিলিতে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

সকালে ভাইয়া ভাবী চলে গেছেন। অনিম যাবে আরো তিন দিন পর। বাসায় একলা অনিম। সারাদিন কম্পিউটার টিপাটিপি করে কোন রকমে সময়টা কেটেছে। ইফতারের পর এখন আর কম্পিইটারও ভাল লাগছেনা। একটা রহস্য উপন্যাস পড়বে মনে করে প্রথম বইটা নিয়েই দেখে পিচাশের কাহিনী। এতে সে একটু ভয় পেয়ে যায় যদিও ভুত-প্রেত, চিাশ টিচাশে তার বিশ্বাস নেই। কিন্তু এখন যেন এসব বাস্তব মনে হচ্ছে। বাসাটাকে তার মনে হচ্ছে একটা অঘোষিত কারাগার। এখানে সে বন্ধি আছে। কিন্তু কোন প্রহরী নেই।নিজেই বন্ধি নিজেই প্রহরী।
সন্ধার পর থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। অনিম কোন রকম দু’টো খেয়ে নিয়ে একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। ফ্যানটা ফুল স্পিডে ছেড়ে দিল। কিন্তু ঘুম তার আসছেনা। কেমন য়েন ভয় ভয় করছে। টেলিভিশনে দেখা, উপন্যাসে পড়া শতশত ভুত-প্রেত, দৈত্য-দানব যেন তার মনকে আচ্ছন্ন করতে চাইছে। সে বারবার মন থেকে এসবকে তাড়িয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু তারপও অদৃশ্য অশরীরী শয়তানরা যেন আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে ভয় দেখাচ্ছে। এরই মাঝে কোথায় যেন টিংটিং করে একটা শব্দ হলো। কিছুক্ষণ পর আবারো একই টিংটিং শব্দ। প্রথমে সে পাত্তা দেয়নি। আবার যখন একিই শব্দ ধ্বনিত হলো তার মনে হলো কোন অশরীরী যেন তাকে ভয় দেখাচ্ছে। একথা ভাবতেই তার শরীরের সব রক্ত হিম হয়ে গেল। পৃথিবীর সব আতঙ্ক তাকে যেন গিলে খাচ্ছে।গলা যেন শুকিয়ে মরুভূমির বালির মত তৃষ্ণার্ত হয়ে গেল। বুকের ভিতর যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে পিটাচ্ছে।কি করবে সে কিছুই ভাবতে পারছেনা। কিছুক্ষণ পর আবারো সেই শব্দ। এবার তার মনে হলো যমদূত যেন তার শিয়রে দাঁড়ানো। হঠাৎ তার আল্লাহর স্মরণ হলো। জোরে “আল্লাহ” বলে গায়ের কাঁথাটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে শোয়া থেকে উঠে গেল। উঠেই লাইটা জ্বেলে দিল। তারপর যা দেখল তাতে এতক্ষণের ভুত প্রেত দেও-দানবের ও এসবের আতঙ্কের কথা ভেবে তার সত্যি হাসি পেল।

 রমযানের শুরুতে সেহরী ও ইফতারের সময়সূচির একটা ক্যালেন্ডার সে এনেছিল এবং তা টিউব লাইটের এক মাথার সাথে সুতা দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। সেই ক্যালেন্ডারের উপরের মাথার টিনের পাতটা ফ্যানের বাতাসের সাথে দোল খেয়ে গিয়ে টিউব লাইটের সাথে বাড়ি খাচ্ছে। আর তাতেই টিংটিং শব্দ হচ্ছে। এ ধরণের শব্দ তো পুরো রমযান জুড়েই হয়েছে। অথচ এর আগে কখনই তা অনিমের মনযোগ আকর্ষণ করেনি। আজ যখন প্রহরীহীন কারাগারে সে একলা তখন সামান্য এ শব্দও তার কাছে দৈত্য দানব রূপে হাজির হয়েছে।