দালাল থেকে যুদ্ধাপরাধী : চার দশকের বিবর্তন
॥ আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ॥
দেশের নদীগুলো এখন আর বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত না হয়ে উজানে উৎসের দিকে বইতে শুরম্ন করেছে। আজব তামাশা চলছে বাংলাদেশজুড়ে। দেশ শত্রম্নমুক্ত হওয়ার পর শোনা যেত মুক্তিযোদ্ধা আর দালালদের কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্বকালে দালাল বলতে জানতাম গরম্নর কেনাবেচার মধ্যস্বত্বভোগী একশ্রেণীর লোককে, যাদের পরিচিতি ছিল ‘গরম্নর দালাল’। কেন জানি না, মানুষ এই দালালদের সুদৃষ্টিতে দেখত না। কিন্তু সময় কিভাবে সব কিছু পাল্টে দেয়। ১৯৭২ সালে শুধু গরম্নর দালালেরা আর দালাল থাকল না, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিসৱানের পৰে ছিলেন, তারা হয়ে গেলেন দালাল। পাকিসৱানের দালাল। নতুন দেশে নতুন আইন করে দালালদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আইনটির নাম ‘কলাবরেটরস অ্যাক্ট’ অর্থাৎ ‘দালাল আইন’, যে আইনে পাকিসৱানের অখণ্ডতা রৰার পৰে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীরা ছিল ‘কলাবরেটর’ বা ‘দালাল’। কলাবরেটরস অ্যাক্ট প্রণীত হওয়ার আগেই তাদের একটি বড় অংশের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছিল। নতুন আইনে বিচার করে শাসিৱ দেয়ার জন্য খুব বেশিসংখ্যক দালাল জীবিত ছিলেন না। দালালদের ধরাধাম ত্যাগ অলৌকিক কোনো ব্যাপার ছিল না। যেকোনো যুদ্ধে সব কিছু বিজয়ী পৰের অনুকূলে থাকে এবং তাদের যেকোনো কর্মকে বিবেচনা করা হয় দেশের জন্য ‘অবদান’ হিসেবে। অতএব যারা ১৯৭১ সালে বিজয়ী হয়েছিলেন, তারা দালালদের বিচারের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বিগত ৪১ বছরে তখনকার দালাল হত্যা সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও এখন অনেকেই খোলামেলা সেসব বলতে ও লিখতে শুরম্ন করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে হাজার হাজার লোকের সামনে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে সংবাদপত্রে নিবন্ধ লেখা হচ্ছে। আনৱর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরম্নদ্ধে সরকার পৰের সাৰীদের অনেকেই জেরার সময় বলেছেন, যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা সাঈদীর এলাকায় ফিরে দালাল ও রাজাকার যাদেরকে পেয়েছে তাদেরকে হত্যা করেছে। শুধু বিজয়ের পরেই যে এই ‘কতলে দালাল’ চলেছে তা নয়, মুক্তিযুদ্ধ শুরম্নর আগেও এ কর্মটি সুচারম্নভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কয়েক দিন আগেও দৈনিক আমার দেশে এক নিবন্ধে উলেস্নখ করা হয়েছে কিভাবে পাকিসৱানি লে. কর্নেল জানজুুয়া ও তার ২০-২৫ জন সহকর্মীকে হত্যা করা হয়।
এমন ঘটনা দেশজুড়ে ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরম্নর আগে পাকিসৱানি সৈন্য ও অবাঙালি এবং বিজয় অর্জনের পর পাকিসৱানের দালাল, দলছুট পাকিসৱানি সৈন্য এবং অবাঙালিরা এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। যারা এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, ১৯৭৪ সালে জারিকৃত প্রেসিডেন্টের ১৬ নম্বর আদেশে তাদেরকে হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো আদালতে তাদের বিরম্নদ্ধে ওই সব হত্যার জন্য অভিযোগ আনা যাবে না। মুসলমান মুসলমানকে মারবে, বাঙালি বাঙালিকে মারবে, এতে দোষের কিছু নেই। সর্বত্র এমন ঘটে, কারণ আপনজনই বড় শত্রম্ন। জেনে হোক আর না জেনে হোক, বাঙালিরা যে অবাঙালি নেতাকে তাদের বীর মনে করে, সেই নবাব সিরাজউদ্দৌলাও বাঙালিদের হাতেই ধরা পড়েছিলেন এবং তাকে হত্যা করার জন্য তারই উজির মীরজাফরের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। বাঙালি প্রতিটি ৰেত্রে ইতিহাস গড়ার জন্য খ্যাত। উর্দু ভাষায় ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিসৱান’ সেস্নাগান দিয়ে চাঁদতারা মার্কা নিশান হাতে যারা রাজপথ গরম করেছে, সেই উর্দুর প্রতি বিবমিষা হতে তাদের সময় লেগেছে মাত্র এক বছর। যারা ‘পাকিসৱান জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মধ্যে মুক্তির দিশা খুঁজেছে, ভোল পাল্টে ‘জয় বাংলা’কে মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করতে তাদের সময় লেগেছে সাড়ে ১৮ বছর। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় যত লোককে সীমানৱ পাড়ি দিতে হয়নি, ১৯৭১ সালে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি লোককে সীমানৱ পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে এবং তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় যত লোক নিহত হয়েছে, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি লোক, যাদের বেশির ভাগই মুসলমান, তারা মুসলমানের হাতেই নিহত হয়েছে। অর্থাৎ ভাই ভাইকে হত্যা করেছে। ৯ মাসে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করা, এটাও বাঙালির সৃষ্ট রেকর্ড। বাংলার মাটিতে ৯০ বা ৯৩ হাজার দখলদার সৈন্যের আত্মসমর্পণ আরেকটি রেকর্ড, যদিও তারা আত্মসমর্পণ করেছিল ভারতীয় বাহিনীর হাতে। মুক্তিযুদ্ধের কোনো পর্যায়েই মুক্তিবাহিনীর কাছে কোনো যুদ্ধবন্দী ছিল না, এটিও একটি রেকর্ড। পাকিসৱান ২৪ বছরে সংবিধান প্রণয়ন না করে যে পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, বাংলাদেশ মাত্র ৯ মাসে সংবিধান রচনায় সফল হয়ে এ ৰেত্রে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের তখনকার সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরামর্শদাতা ভারতের সংবিধান প্রণয়নেও সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। বাংলাদেশ তার সংবিধান রচনার তিন বছরের মাথায় ‘ওপারে সকল সুখ’ বিবেচনায় সংবিধানে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতির অসারতা দেখিয়ে একদলীয় প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থার বিধান করে ইতিহাসে আরেকটি অধ্যায়ের সংযোজন ঘটায়।
‘পাকিসৱানের দালাল’ দিয়ে আলোচনার শুরম্ন। বাংলাদেশের প্রথম সরকার দালালদের বিচারে সুবিধা করতে পারেননি। আনৱরিকভাবে তারা চেয়েছেন বলেও মনে হয় না। কারণ তারা উভয় পৰের বাড়াবাড়ির প্রত্যৰ সাৰী। তারা নিজেরাই অনেক দালালকে সমূহ মৃত্যুর কবল থেকে রৰা করেছেন। নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। তা ছাড়া স্বল্পসংখ্যক লোক ছাড়া অভিযুক্তদের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ গঠন করা যায়নি সাৰ্য-প্রমাণের অভাবে এবং একই কারণে তাদের বিচার আটকে ছিল। এ অবস্থায় সরকার সাধারণ ৰমা ঘোষণা করলে ‘পাকিসৱানের দালাল’ অভিযোগে আটক বেশির ভাগ লোক মুক্তি লাভ করে এবং স্বাভাবিক নিয়মে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে জাতি গঠনে অবদান রাখতে শুরম্ন করে। বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে থাকা একটি দেশে অনেক সময় এমন ঘটে যে, একটি পরিবারে একজন সদস্যের সমৃদ্ধিতে অপর সদস্য ঈর্ষাণ্বিত হয়। পাকিসৱানের দালালেরা যখন তাদের ভুল স্বীকার করে রাজনীতির মূল ধারায় চলে আসে, তখন রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তেয় অতি বাম গোষ্ঠী ঈর্ষাণ্বিত হয়ে ওঠে। যেহেতু দালালির অভিযোগ কাজে লাগেনি, অতএব তারা নতুন অভিধা সৃষ্টি করে ‘স্বাধীনতার সপৰ শক্তি’ ও ‘স্বাধীনতার বিপৰ শক্তি’। স্বাধীনতার সপৰ শক্তির পৰে ক্রমে গঠিত হয়- ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, প্রজন্ম ’৭১, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সনৱান, এবং সব শেষে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরম্নদ্ধে সংগ্রাম করে ভারত বিদেশী শাসনমুক্ত হয়েছে। ভারত ও পাকিসৱান স্বাধীন হয়েছে। ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাদের সবাই বেসামরিক ব্যক্তি, তারা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন, রাষ্ট্রীয় ভাতা লাভ করেছেন এবং এখনো যারা জীবিত আছেন তারা ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু পাকিসৱান হাসিল করার জন্য পূর্ব বাংলায় যারা সংগ্রাম করেছেন, যাদের বেশির ভাগই পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন, তারা তাদের সংগ্রামের জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি, ভাতাও পাননি। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তাদের পৃথক কোনো সম্মান ছিল না, বরং পাকিসৱানি দুঃশাসন ও শোষণের প্রতিবাদ করায় পাকিসৱানের ২৪ বছরের অধিকাংশ সময় তাদেরকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। তারা কখনো ‘আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামী বা ’৪৭-এ জন্মগ্রহণকারী তাদের সনৱানদের ‘প্রজন্ম ’৪৭’ বা ‘আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামীর সনৱান’ নামে কোনো সংগঠন গড়ে তুলতে দেখা যায়নি। বাম ধারায় বিশ্বাসীরা রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পেরে অন্যদের রাজনৈতিক সাফল্যে ঈর্ষা পোষণ করেছেন এবং তারা যে তাত্ত্বিক পড়াশোনা করেছিলেন, তা কাজে লাগিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বকপোলকল্পিত কাহিনীসংবলিত গ্রন্থাদি রচনা শুরম্ন করেন। হোমারের রচনাই যেমন প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাস, ধর্ম, সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎস, বামপন্থীদের এই কল্পকাহিনীগুলোও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ ব্যাপারে বামপন্থীরা যথার্থই কৃতিত্বের দাবিদার।
স্বাধীনতাই যখন অর্জিত হয়েছে, তখন পৰ-বিপৰের আর কী থাকতে পারে। বিচারের উদ্যোগ যদি আদৌ না নেয়া হতো, তাহলেও কথা ছিল। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধে জড়িত সন্দেহে দখলদার বাহিনীর সেনাকর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করার পর সামরিক আদালতে তাদের বিচার করার জন্য সংবিধান সংশোধন ও আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। পাকিসৱানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী বা পাকিসৱানের দালালদের বিচার করার জন্য দালাল আইন ও অনেকগুলো ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছিল। দখলদার বাহিনীর অভিযুক্ত অফিসার, যারা ভারতে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ছিলেন, তাদের বিচার হয়নি, সরকার উদারতা দেখিয়ে চুক্তি করে তাদের ছেড়ে দেয়ার জন্য ভারতকে এখতিয়ার দিয়েছিল বলে। যারা অপরাধ করেছিলেন, তাদের ছেড়ে দেয়ার মধ্যে যদি মহানুভবতা ও উদারতা থেকে থাকে, তাহলে দেশবাসী, যাদের অপরাধ ছিল পাকিসৱানকে সমর্থন করা, তাদের অপরাধ এত গুরম্নতরভাবে নেয়ার মধ্যে কী তাৎপর্য নিহিত থাকতে পারে? লৰণীয় ব্যাপার হলো, হানাদার বাহিনীর অভিযুক্তদের মধ্যে শুধু অফিসার ছিলেন, সাধারণ কোনো সৈনিক ছিল না। অথচ প্রতিটি যুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়ে থাকে সৈনিকেরাই। অফিসারদের দ্বারা তারা নির্দেশিত হয় বলেই অভিযুক্ত হন অফিসাররা। তা ছাড়া বেশির ভাগ ৰেত্রে সৈনিকদের সম্পর্কে বিসৱারিত জানাও সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের জন্য চার দশক পর বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে সেই সব লোককে, যারা তখনকার সরকারের কোনো দায়িত্বে ছিলেন না, সেনাবাহিনী পরিচালনার যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন না, এমনকি সহায়ক বাহিনীর কুশীলবও ছিলেন না। বিশ্বের কোনো সেনাবাহিনী বেসামরিক লোকদের দ্বারা নির্দেশিত হয়ে কাজ করেছে, এমন একটি দৃষ্টানৱও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে সেটিই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, পূর্ব পাকিসৱানে ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর কমান্ড ছিল একটি রাজনৈতিক দলের হাতে, যে দলটি তখন দল হিসেবে সংখ্যালঘুও ছিল না। কেউ ভালো উর্দু জানলে হানাদার বাহিনী তার কথায় চলেছে, আদালতে এমন অভিযোগ আনা হয়েছে। একজনের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ এমন যে ১১-১২ বছরের দু’টি মেয়েকে ধর্ষণ করার পর আরো সাত-আটজন পালাক্রমে তাদের ধর্ষণ করেছে এবং এরপর তাদের একজন চিকিৎসা নিতে চিকিৎসকের বাড়ি গেছে। আজকাল কোনো কারণেই আর ধরণী দ্বিধা হয় না। ওই বয়সের কোনো শিশুর ওপর এতগুলো লোকের নিপীড়নের পরও কিভাবে তার পৰে জীবিত থেকে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সামর্থ্য ও বুদ্ধি বিবেচনা থাকে তা ধারণা করা কঠিন। ধর্ষণে যাদের এতই আগ্রহ, তারা যে এর ব্যতিক্রমও ঘটিয়েছে, এমন কাহিনী পাঠ করে বিস্ময়ও জাগে। মহান স্বাধীনতা দিবস উপলৰে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যিনি সেনাবাহিনীর একজন সাবেক অফিসার ছিলেন, তিনি একটি অনলাইন সংবাদপত্রে লিখেছেন, তাকে হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা ধরতে আসছে আঁচ করতে পেরে স্ত্রী ও দুই শিশুপুত্রকে ‘চাচা আপন বাঁচা’ তত্ত্ব অনুসরণ করে নৌকাযোগে নদীর ওপারে চলে যান। সৈন্যরা এসে তার স্ত্রী ও পুত্রদের বুকে পিসৱল ঠেকিয়ে বলে, তোমরা বন্দী। কিন্তু তারা তাকে কিছু করেনি, সাথেও নিয়ে যায়নি। বুঝতে কষ্ট হয়, তিনি কেমন বন্দী ছিলেন? তার প্রতি এত এমন সদয় আচরণই বা করা হলো কেন? যা হোক, সন্ধ্যার পর সেই সাবেক অফিসার নদী পার হয়ে আসেন, স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে নদীপথে পালান। পরদিন সৈন্যরা আবার এসে তার স্ত্রীকে না পেয়ে প্রহরীকে হত্যা করে। এখন সবই বিশ্বাস করতে হবে। ‘দশ চক্রে ভগবান ভূত’। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তরা পাকিসৱানের অখণ্ডতার পৰে ছিলেন এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করে না। কিন্তু হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ এনে এবং জোর করে তা প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে তাদের জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়া কতটা যৌক্তিক? বাংলাদেশের বাসৱবতা তারা যদি মেনে না নিতেন তাহলেও একটা কথা ছিল। তারা যদি অপরাধ করে থাকতেন তাহলে যখন থেকে তাদের বিরম্নদ্ধে অভিযোগগুলো প্রবলভাবে আনা হচ্ছিল এবং মিডিয়ার একটি অংশ তাদেরকে দানবীয়ভাবে প্রদর্শন করতে শুরম্ন করেছিল, তখন দেশ থেকে তাদের কেটে পড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু দেশকে ভালোবাসেন বলেই তখনো তারা বলেছেন, আমাদের একজন লোকও পালাবে না, বরং অসংখ্য অভিযোগ মাথায় নিয়ে কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে প্রমাণ করেছেন, ‘জীবনের চেয়ে দেশ বড়’।
কিন্তু এই বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে এখন কী চলছে? সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রধান খবর ‘একুশের শপথ যুদ্ধাপরাধের বিচার!’ ‘স্বাধীনতা দিবসের শপথ যুদ্ধাপরাধের বিচার!’ ‘বিজয় দিবসের শপথ যুদ্ধাপরাধের বিচার!’ ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের শপথ যুদ্ধাপরাধের বিচার!’ ‘নববর্ষের শপথ যুদ্ধাপরাধের বিচার!’ এ ধরনের বক্তব্য মোকাবেলা কী করে করা সম্ভব? ইতিহাস বিকৃতির কথা শোনা যায়। কিন্তু কারা ইতিহাস বিকৃতির জন্য দায়ী? যে ভ্রানৱ উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে নতুন প্রজন্ম তো জানারই সুযোগ পাবে না যে, এই ভূখণ্ড একদিন ভারত ছিল। পাকিসৱান ছিল। তারা জানবে না যে স্বাধীনতা আদায়ের জন্য লড়াই করতে হয়েছে পাকিসৱানি বাহিনীর সাথে। বরং জানবে যে যুদ্ধ হয়েছিল কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাথে। কে এই ইতিহাস শেখাচ্ছে? গোড়ায় গলদ হলে যা হয় বাংলাদেশ তার খেসারত দিচ্ছে। শেখ মুজিব একটি ইঁদুর মেরে সমস্যা নিষ্পত্তি করতে পারতেন। তিনি তা না করায় তার কন্যার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে সেই ইঁদুর মারার জন্য একটি বাড়ি ধ্বংসের। দেশ ও দেশবাসীকে এর মূল্য দিতে হচ্ছে
দেশের নদীগুলো এখন আর বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত না হয়ে উজানে উৎসের দিকে বইতে শুরম্ন করেছে। আজব তামাশা চলছে বাংলাদেশজুড়ে। দেশ শত্রম্নমুক্ত হওয়ার পর শোনা যেত মুক্তিযোদ্ধা আর দালালদের কথা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্বকালে দালাল বলতে জানতাম গরম্নর কেনাবেচার মধ্যস্বত্বভোগী একশ্রেণীর লোককে, যাদের পরিচিতি ছিল ‘গরম্নর দালাল’। কেন জানি না, মানুষ এই দালালদের সুদৃষ্টিতে দেখত না। কিন্তু সময় কিভাবে সব কিছু পাল্টে দেয়। ১৯৭২ সালে শুধু গরম্নর দালালেরা আর দালাল থাকল না, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিসৱানের পৰে ছিলেন, তারা হয়ে গেলেন দালাল। পাকিসৱানের দালাল। নতুন দেশে নতুন আইন করে দালালদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল। আইনটির নাম ‘কলাবরেটরস অ্যাক্ট’ অর্থাৎ ‘দালাল আইন’, যে আইনে পাকিসৱানের অখণ্ডতা রৰার পৰে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীরা ছিল ‘কলাবরেটর’ বা ‘দালাল’। কলাবরেটরস অ্যাক্ট প্রণীত হওয়ার আগেই তাদের একটি বড় অংশের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছিল। নতুন আইনে বিচার করে শাসিৱ দেয়ার জন্য খুব বেশিসংখ্যক দালাল জীবিত ছিলেন না। দালালদের ধরাধাম ত্যাগ অলৌকিক কোনো ব্যাপার ছিল না। যেকোনো যুদ্ধে সব কিছু বিজয়ী পৰের অনুকূলে থাকে এবং তাদের যেকোনো কর্মকে বিবেচনা করা হয় দেশের জন্য ‘অবদান’ হিসেবে। অতএব যারা ১৯৭১ সালে বিজয়ী হয়েছিলেন, তারা দালালদের বিচারের দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বিগত ৪১ বছরে তখনকার দালাল হত্যা সম্পর্কে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও এখন অনেকেই খোলামেলা সেসব বলতে ও লিখতে শুরম্ন করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে হাজার হাজার লোকের সামনে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করার যৌক্তিকতা তুলে ধরে সংবাদপত্রে নিবন্ধ লেখা হচ্ছে। আনৱর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরম্নদ্ধে সরকার পৰের সাৰীদের অনেকেই জেরার সময় বলেছেন, যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা সাঈদীর এলাকায় ফিরে দালাল ও রাজাকার যাদেরকে পেয়েছে তাদেরকে হত্যা করেছে। শুধু বিজয়ের পরেই যে এই ‘কতলে দালাল’ চলেছে তা নয়, মুক্তিযুদ্ধ শুরম্নর আগেও এ কর্মটি সুচারম্নভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কয়েক দিন আগেও দৈনিক আমার দেশে এক নিবন্ধে উলেস্নখ করা হয়েছে কিভাবে পাকিসৱানি লে. কর্নেল জানজুুয়া ও তার ২০-২৫ জন সহকর্মীকে হত্যা করা হয়।
এমন ঘটনা দেশজুড়ে ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরম্নর আগে পাকিসৱানি সৈন্য ও অবাঙালি এবং বিজয় অর্জনের পর পাকিসৱানের দালাল, দলছুট পাকিসৱানি সৈন্য এবং অবাঙালিরা এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। যারা এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন, ১৯৭৪ সালে জারিকৃত প্রেসিডেন্টের ১৬ নম্বর আদেশে তাদেরকে হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো আদালতে তাদের বিরম্নদ্ধে ওই সব হত্যার জন্য অভিযোগ আনা যাবে না। মুসলমান মুসলমানকে মারবে, বাঙালি বাঙালিকে মারবে, এতে দোষের কিছু নেই। সর্বত্র এমন ঘটে, কারণ আপনজনই বড় শত্রম্ন। জেনে হোক আর না জেনে হোক, বাঙালিরা যে অবাঙালি নেতাকে তাদের বীর মনে করে, সেই নবাব সিরাজউদ্দৌলাও বাঙালিদের হাতেই ধরা পড়েছিলেন এবং তাকে হত্যা করার জন্য তারই উজির মীরজাফরের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। বাঙালি প্রতিটি ৰেত্রে ইতিহাস গড়ার জন্য খ্যাত। উর্দু ভাষায় ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিসৱান’ সেস্নাগান দিয়ে চাঁদতারা মার্কা নিশান হাতে যারা রাজপথ গরম করেছে, সেই উর্দুর প্রতি বিবমিষা হতে তাদের সময় লেগেছে মাত্র এক বছর। যারা ‘পাকিসৱান জিন্দাবাদ’ ধ্বনির মধ্যে মুক্তির দিশা খুঁজেছে, ভোল পাল্টে ‘জয় বাংলা’কে মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করতে তাদের সময় লেগেছে সাড়ে ১৮ বছর। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় যত লোককে সীমানৱ পাড়ি দিতে হয়নি, ১৯৭১ সালে তার চেয়ে অনেক গুণ বেশি লোককে সীমানৱ পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে এবং তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় যত লোক নিহত হয়েছে, তার চেয়ে বহু গুণ বেশি লোক, যাদের বেশির ভাগই মুসলমান, তারা মুসলমানের হাতেই নিহত হয়েছে। অর্থাৎ ভাই ভাইকে হত্যা করেছে। ৯ মাসে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করা, এটাও বাঙালির সৃষ্ট রেকর্ড। বাংলার মাটিতে ৯০ বা ৯৩ হাজার দখলদার সৈন্যের আত্মসমর্পণ আরেকটি রেকর্ড, যদিও তারা আত্মসমর্পণ করেছিল ভারতীয় বাহিনীর হাতে। মুক্তিযুদ্ধের কোনো পর্যায়েই মুক্তিবাহিনীর কাছে কোনো যুদ্ধবন্দী ছিল না, এটিও একটি রেকর্ড। পাকিসৱান ২৪ বছরে সংবিধান প্রণয়ন না করে যে পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, বাংলাদেশ মাত্র ৯ মাসে সংবিধান রচনায় সফল হয়ে এ ৰেত্রে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের তখনকার সরকারের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরামর্শদাতা ভারতের সংবিধান প্রণয়নেও সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। বাংলাদেশ তার সংবিধান রচনার তিন বছরের মাথায় ‘ওপারে সকল সুখ’ বিবেচনায় সংবিধানে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতির অসারতা দেখিয়ে একদলীয় প্রেসিডেনশিয়াল ব্যবস্থার বিধান করে ইতিহাসে আরেকটি অধ্যায়ের সংযোজন ঘটায়।
‘পাকিসৱানের দালাল’ দিয়ে আলোচনার শুরম্ন। বাংলাদেশের প্রথম সরকার দালালদের বিচারে সুবিধা করতে পারেননি। আনৱরিকভাবে তারা চেয়েছেন বলেও মনে হয় না। কারণ তারা উভয় পৰের বাড়াবাড়ির প্রত্যৰ সাৰী। তারা নিজেরাই অনেক দালালকে সমূহ মৃত্যুর কবল থেকে রৰা করেছেন। নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। তা ছাড়া স্বল্পসংখ্যক লোক ছাড়া অভিযুক্তদের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ গঠন করা যায়নি সাৰ্য-প্রমাণের অভাবে এবং একই কারণে তাদের বিচার আটকে ছিল। এ অবস্থায় সরকার সাধারণ ৰমা ঘোষণা করলে ‘পাকিসৱানের দালাল’ অভিযোগে আটক বেশির ভাগ লোক মুক্তি লাভ করে এবং স্বাভাবিক নিয়মে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে জাতি গঠনে অবদান রাখতে শুরম্ন করে। বাংলাদেশের মতো পিছিয়ে থাকা একটি দেশে অনেক সময় এমন ঘটে যে, একটি পরিবারে একজন সদস্যের সমৃদ্ধিতে অপর সদস্য ঈর্ষাণ্বিত হয়। পাকিসৱানের দালালেরা যখন তাদের ভুল স্বীকার করে রাজনীতির মূল ধারায় চলে আসে, তখন রাজনীতিতে অপাঙ্ক্তেয় অতি বাম গোষ্ঠী ঈর্ষাণ্বিত হয়ে ওঠে। যেহেতু দালালির অভিযোগ কাজে লাগেনি, অতএব তারা নতুন অভিধা সৃষ্টি করে ‘স্বাধীনতার সপৰ শক্তি’ ও ‘স্বাধীনতার বিপৰ শক্তি’। স্বাধীনতার সপৰ শক্তির পৰে ক্রমে গঠিত হয়- ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, প্রজন্ম ’৭১, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সনৱান, এবং সব শেষে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরম্নদ্ধে সংগ্রাম করে ভারত বিদেশী শাসনমুক্ত হয়েছে। ভারত ও পাকিসৱান স্বাধীন হয়েছে। ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাদের সবাই বেসামরিক ব্যক্তি, তারা সম্মানে ভূষিত হয়েছেন, রাষ্ট্রীয় ভাতা লাভ করেছেন এবং এখনো যারা জীবিত আছেন তারা ভাতা পাচ্ছেন। কিন্তু পাকিসৱান হাসিল করার জন্য পূর্ব বাংলায় যারা সংগ্রাম করেছেন, যাদের বেশির ভাগই পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন, তারা তাদের সংগ্রামের জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি, ভাতাও পাননি। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তাদের পৃথক কোনো সম্মান ছিল না, বরং পাকিসৱানি দুঃশাসন ও শোষণের প্রতিবাদ করায় পাকিসৱানের ২৪ বছরের অধিকাংশ সময় তাদেরকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে। তারা কখনো ‘আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামী বা ’৪৭-এ জন্মগ্রহণকারী তাদের সনৱানদের ‘প্রজন্ম ’৪৭’ বা ‘আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামীর সনৱান’ নামে কোনো সংগঠন গড়ে তুলতে দেখা যায়নি। বাম ধারায় বিশ্বাসীরা রাজনীতিতে সুবিধা করতে না পেরে অন্যদের রাজনৈতিক সাফল্যে ঈর্ষা পোষণ করেছেন এবং তারা যে তাত্ত্বিক পড়াশোনা করেছিলেন, তা কাজে লাগিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা টিকিয়ে রাখা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্বকপোলকল্পিত কাহিনীসংবলিত গ্রন্থাদি রচনা শুরম্ন করেন। হোমারের রচনাই যেমন প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাস, ধর্ম, সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎস, বামপন্থীদের এই কল্পকাহিনীগুলোও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ ব্যাপারে বামপন্থীরা যথার্থই কৃতিত্বের দাবিদার।
স্বাধীনতাই যখন অর্জিত হয়েছে, তখন পৰ-বিপৰের আর কী থাকতে পারে। বিচারের উদ্যোগ যদি আদৌ না নেয়া হতো, তাহলেও কথা ছিল। হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধে জড়িত সন্দেহে দখলদার বাহিনীর সেনাকর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করার পর সামরিক আদালতে তাদের বিচার করার জন্য সংবিধান সংশোধন ও আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। পাকিসৱানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী বা পাকিসৱানের দালালদের বিচার করার জন্য দালাল আইন ও অনেকগুলো ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছিল। দখলদার বাহিনীর অভিযুক্ত অফিসার, যারা ভারতে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ছিলেন, তাদের বিচার হয়নি, সরকার উদারতা দেখিয়ে চুক্তি করে তাদের ছেড়ে দেয়ার জন্য ভারতকে এখতিয়ার দিয়েছিল বলে। যারা অপরাধ করেছিলেন, তাদের ছেড়ে দেয়ার মধ্যে যদি মহানুভবতা ও উদারতা থেকে থাকে, তাহলে দেশবাসী, যাদের অপরাধ ছিল পাকিসৱানকে সমর্থন করা, তাদের অপরাধ এত গুরম্নতরভাবে নেয়ার মধ্যে কী তাৎপর্য নিহিত থাকতে পারে? লৰণীয় ব্যাপার হলো, হানাদার বাহিনীর অভিযুক্তদের মধ্যে শুধু অফিসার ছিলেন, সাধারণ কোনো সৈনিক ছিল না। অথচ প্রতিটি যুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়ে থাকে সৈনিকেরাই। অফিসারদের দ্বারা তারা নির্দেশিত হয় বলেই অভিযুক্ত হন অফিসাররা। তা ছাড়া বেশির ভাগ ৰেত্রে সৈনিকদের সম্পর্কে বিসৱারিত জানাও সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের জন্য চার দশক পর বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে সেই সব লোককে, যারা তখনকার সরকারের কোনো দায়িত্বে ছিলেন না, সেনাবাহিনী পরিচালনার যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন না, এমনকি সহায়ক বাহিনীর কুশীলবও ছিলেন না। বিশ্বের কোনো সেনাবাহিনী বেসামরিক লোকদের দ্বারা নির্দেশিত হয়ে কাজ করেছে, এমন একটি দৃষ্টানৱও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে সেটিই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, পূর্ব পাকিসৱানে ১৯৭১ সালে সেনাবাহিনীর কমান্ড ছিল একটি রাজনৈতিক দলের হাতে, যে দলটি তখন দল হিসেবে সংখ্যালঘুও ছিল না। কেউ ভালো উর্দু জানলে হানাদার বাহিনী তার কথায় চলেছে, আদালতে এমন অভিযোগ আনা হয়েছে। একজনের বিরম্নদ্ধে অভিযোগ এমন যে ১১-১২ বছরের দু’টি মেয়েকে ধর্ষণ করার পর আরো সাত-আটজন পালাক্রমে তাদের ধর্ষণ করেছে এবং এরপর তাদের একজন চিকিৎসা নিতে চিকিৎসকের বাড়ি গেছে। আজকাল কোনো কারণেই আর ধরণী দ্বিধা হয় না। ওই বয়সের কোনো শিশুর ওপর এতগুলো লোকের নিপীড়নের পরও কিভাবে তার পৰে জীবিত থেকে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সামর্থ্য ও বুদ্ধি বিবেচনা থাকে তা ধারণা করা কঠিন। ধর্ষণে যাদের এতই আগ্রহ, তারা যে এর ব্যতিক্রমও ঘটিয়েছে, এমন কাহিনী পাঠ করে বিস্ময়ও জাগে। মহান স্বাধীনতা দিবস উপলৰে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যিনি সেনাবাহিনীর একজন সাবেক অফিসার ছিলেন, তিনি একটি অনলাইন সংবাদপত্রে লিখেছেন, তাকে হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা ধরতে আসছে আঁচ করতে পেরে স্ত্রী ও দুই শিশুপুত্রকে ‘চাচা আপন বাঁচা’ তত্ত্ব অনুসরণ করে নৌকাযোগে নদীর ওপারে চলে যান। সৈন্যরা এসে তার স্ত্রী ও পুত্রদের বুকে পিসৱল ঠেকিয়ে বলে, তোমরা বন্দী। কিন্তু তারা তাকে কিছু করেনি, সাথেও নিয়ে যায়নি। বুঝতে কষ্ট হয়, তিনি কেমন বন্দী ছিলেন? তার প্রতি এত এমন সদয় আচরণই বা করা হলো কেন? যা হোক, সন্ধ্যার পর সেই সাবেক অফিসার নদী পার হয়ে আসেন, স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে নদীপথে পালান। পরদিন সৈন্যরা আবার এসে তার স্ত্রীকে না পেয়ে প্রহরীকে হত্যা করে। এখন সবই বিশ্বাস করতে হবে। ‘দশ চক্রে ভগবান ভূত’। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্তরা পাকিসৱানের অখণ্ডতার পৰে ছিলেন এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করে না। কিন্তু হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের সাথে জড়িত বলে অভিযোগ এনে এবং জোর করে তা প্রমাণের চেষ্টা চালিয়ে তাদের জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়া কতটা যৌক্তিক? বাংলাদেশের বাসৱবতা তারা যদি মেনে না নিতেন তাহলেও একটা কথা ছিল। তারা যদি অপরাধ করে থাকতেন তাহলে যখন থেকে তাদের বিরম্নদ্ধে অভিযোগগুলো প্রবলভাবে আনা হচ্ছিল এবং মিডিয়ার একটি অংশ তাদেরকে দানবীয়ভাবে প্রদর্শন করতে শুরম্ন করেছিল, তখন দেশ থেকে তাদের কেটে পড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু দেশকে ভালোবাসেন বলেই তখনো তারা বলেছেন, আমাদের একজন লোকও পালাবে না, বরং অসংখ্য অভিযোগ মাথায় নিয়ে কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে প্রমাণ করেছেন, ‘জীবনের চেয়ে দেশ বড়’।
কিন্তু এই বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে এখন কী চলছে? সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে প্রধান খবর ‘একুশের শপথ যুদ্ধাপরাধের বিচার!’ ‘স্বাধীনতা দিবসের শপথ যুদ্ধাপরাধের বিচার!’ ‘বিজয় দিবসের শপথ যুদ্ধাপরাধের বিচার!’ ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের শপথ যুদ্ধাপরাধের বিচার!’ ‘নববর্ষের শপথ যুদ্ধাপরাধের বিচার!’ এ ধরনের বক্তব্য মোকাবেলা কী করে করা সম্ভব? ইতিহাস বিকৃতির কথা শোনা যায়। কিন্তু কারা ইতিহাস বিকৃতির জন্য দায়ী? যে ভ্রানৱ উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়েছে, তাতে নতুন প্রজন্ম তো জানারই সুযোগ পাবে না যে, এই ভূখণ্ড একদিন ভারত ছিল। পাকিসৱান ছিল। তারা জানবে না যে স্বাধীনতা আদায়ের জন্য লড়াই করতে হয়েছে পাকিসৱানি বাহিনীর সাথে। বরং জানবে যে যুদ্ধ হয়েছিল কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের সাথে। কে এই ইতিহাস শেখাচ্ছে? গোড়ায় গলদ হলে যা হয় বাংলাদেশ তার খেসারত দিচ্ছে। শেখ মুজিব একটি ইঁদুর মেরে সমস্যা নিষ্পত্তি করতে পারতেন। তিনি তা না করায় তার কন্যার ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে সেই ইঁদুর মারার জন্য একটি বাড়ি ধ্বংসের। দেশ ও দেশবাসীকে এর মূল্য দিতে হচ্ছে