পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ২১ মার্চ, ২০১২

‘বন্ধু’ ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত- মাহমুদুর রহমান

‘বন্ধু’ ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত

মাহমুদুর রহমান
দ্বিতীয় পর্ব
বাংলাদেশে যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী ভারত থেকে প্রবেশ করেছে, তার মধ্যে সারি নদী একটি। এই নদীটি মাইনথ্রু (Mainthru) নামে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ে জন্মলাভ করেছে। মাইনথ্রু সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সারি নাম নিয়েছে এবং ছাতকের কাছে সুরমা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এছাড়া গোয়াইনঘাট উপজেলায় গোয়াইন (Goyain) নদীর পানিও সারির সঙ্গে মিশেছে। পাহাড়ি নদী সারি-গোয়াইন মেঘালয় থেকে প্রচুর পাথর, মোটা বালু এবং পলিমাটি বহন করে নিয়ে আসে। নদীতীরবর্তী বিপুলসংখ্যক মানুষ এই নদী থেকে পাথর সংগ্রহ এবং পরিবহনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। সুতরাং, নদীটির বেঁচে থাকা কেবল পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বাংলাদেশের অন্তত কিছু মানুষের সংসার খরচ মেটানোর জন্যও আবশ্যক।
এই মাসেই ভারত সরকার মাইনথ্রু নদীতে ৬৩ মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করে সেখানে একটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র উদ্বোধন করেছে। এই বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় আমার জানা মতে, আন্তর্জাতিক আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও ভারত সরকার বাংলাদেশের অনুমতি নেয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করেনি। সিলেট অঞ্চলের জনগণ ‘সারি নদী বাঁচাও’ আন্দোলন গড়ে তুললেও ভারতের প্রতি অতিমাত্রায় অনুগত বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অদ্যাবধি কোনো রকম প্রতিবাদ পর্যন্ত জানানো হয়নি। এই বাঁধ নির্মাণের প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ নম্বর ধারা উল্লেখ করা আবশ্যক। সেই ধারায় বলা হয়েছে, ‘Guided by the principles of equity, fairness and no harm to either party, both the governments agree to conclude water sharing Treaties/Agreements with regard to other common rivers.’ অর্থাত্, সমঅধিকার, ন্যায্যতা এবং কোনো পক্ষের জন্য ক্ষতিকারক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করার নীতি অনুসরণ করে, উভয় পক্ষ অন্যান্য অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে সম্মতি প্রদান করছে। সুতরাং, সারি নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণের আগে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে এই নদীর পানিবণ্টন চুক্তি না করে গঙ্গা-চুক্তির ৯ নম্বর ধারা সুস্পষ্টভাবে ভঙ্গ করেছে। এই চুক্তিবহির্ভূত পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারত সরকার সিলেট অঞ্চলের পরিবেশ ও জনগণের জীবনধারণকে আজ যে হুমকির মুখে ফেলেছে, তার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ভারতের সেবাদাসের ভূমিকা পালনকারী ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ সরকারও সমভাবে দায়ী। তারা দেশের স্বার্থ বিষয়ে নীরব থেকে ভারতকে বাঁধ নির্মাণ ও গঙ্গা চুক্তি ভঙ্গে উত্সাহিত করেছে।
এবার টিপাইমুখ প্রসঙ্গে আসি। সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারাই উজানে ভারতের মণিপুর রাজ্যের বরাক নদী। ভারত সেই বরাক উপত্যকার টিপাইমুখ নামক স্থানে ৩৯০ মিটার দৈর্ঘ্যের এবং ১৬৩ মিটার উচ্চতার এক অতিকায় বাঁধ (mega-dam) নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। সাম্রাজ্যবাদী ভারতের শাসকশ্রেণী যে জায়গাটিকে এই বাঁধ নির্মাণের জন্য বেছে নিয়েছে, সেটি পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। ১৯৮৮ সালেও এই অঞ্চলে ৬.৬ রিখটার মাত্রার একটি তীব্র ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা রয়েছে যে, মণিপুর অঞ্চলে ৮ কিংবা অধিক রিখটার মাত্রার ভূমিকম্প যে কোনো সময় হওয়া সম্ভব। এমন এক স্থানে অতিকায় বাঁধ নির্মাণ সেই ভূমিকম্প প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। ৮ রিখটার স্কেলের ঊর্ধ্বমাত্রার ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ায় টিপাইমুখ বাঁধ ভাঙলে মণিপুর ও ঘন বসতিপূর্ণ সিলেট অঞ্চলে যে ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা হবে, তা সুনামি কিংবা পরমাণু বোমা বিস্ফোরণজনিত ক্ষয়ক্ষতিকেও হার মানাবে। অর্থাত্ এই বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে আমাদের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে ভয়াবহ এক টাইম বোমার সঙ্গে বসবাস করতে হবে।
এ কারণেই মণিপুরের স্থানীয় অধিবাসীরাও বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। অবশ্য, এসব আন্দোলনকে দিল্লির শাসকশ্রেণী বরাবরের মতোই উপেক্ষা করে চলেছে। তাছাড়া সেই ১৯৪৯ সাল থেকেই বিদ্রোহী মণিপুর ভারতীয় সেনাবাহিনীর পদতলে পিষ্ট একটি রাজ্য মাত্র। এ তো গেল ভূমিকম্পজনিত সর্বনাশের আশঙ্কার কথা। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সঙ্গত কারণেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, একবার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হয়ে গেলে সেখানে কেবল জলবিদ্যুত্ উত্পাদনই করা হবে না, ভবিষ্যতে সময়-সুযোগমত পানি প্রত্যাহার করে পদ্মা অববাহিকার মতো মেঘনা অববাহিকাকেও ধ্বংস করা হবে। সে কারণেই ক্ষমতাসীন মহাজোট এবং ভারত থেকে নিয়মিত মাসোহারাপ্রাপ্ত তথাকথিত সুশীল (?) গোষ্ঠী ব্যতীত বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। জনমতের এই বিরূপতা উপলব্ধি করে বহুরূপী রাজনীতিক, স্বৈরাচারী এরশাদ পর্যন্ত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে সিলেটে লংমার্চের লোক-দেখানো নাটক মঞ্চস্থ করতে বাধ্য হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সোল এজেন্সির দাবিদার সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তাদের রাষ্ট্রবিরোধী চরিত্র অনুযায়ী আমাদের মাতৃভূমি ধ্বংসকারী যাবতীয় ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেখেও সর্বপ্রকারে লজ্জাহীন দালালি অব্যাহত রেখেছে। টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে সরকারের মন্ত্রী এবং অন্যান্য নেতার গত তিন বছরের বক্তব্য এবার খানিকটা ঝালিয়ে নেয়া যেতে পারে।
একসময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী এবং বর্তমানে বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেছিলেন, টিপাইমুখ বাঁধ হলে নাকি বাংলাদেশের লাভ হবে। আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রী, তিস্তাপাড়ের রমেশচন্দ্র সেন বলেছেন, আগে বাঁধ নির্মিত হোক, তারপর বাংলাদেশের ক্ষতি হলে তখন দেখা হবে। পানি প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান তো আর এক কাঠি সরেস। তিনি ভারতের অবস্থান সমর্থন করে বাণী দিয়েছেন, ভারত তাদের নদীতে বাঁধ দিলে আমাদের বলার কী আছে? অর্থাত্ আন্তর্জাতিক নদীর (International/Transboundary river) সংজ্ঞা সম্পর্কে দক্ষিণাঞ্চলের এই অখ্যাত, দেশবিরোধী আওয়ামী রাজনীতিবিদের কোনো ধারণাই নেই। তবু তিনি শেখ হাসিনার প্রিয় পানি প্রতিমন্ত্রী। এদের আচরণদৃষ্টে মনে হয়, আওয়ামী লীগ করলেই বোধহয় ভারতের দালালে রূপান্তরিত হতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর দিল্লির পদলেহনকারী বক্তব্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে নিজের কাছেই ঘৃণাবোধ হয়। এক-এগারোর সামরিক জান্তার সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত এই বিচিত্র, রহস্যময় ব্যক্তিটি বিগত প্রায় চার বছর ধরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজ অব্যাহতভাবে করে চলেছেন। কাজেই তিনি টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সমর্থন করে সভা, সেমিনার, টেলিভিশনে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন অথবা পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করেছেন, সেগুলোকে আবর্জনা জ্ঞান করে বিবেচনার বাইরেই রাখলাম।
১৯৯৬ সালের বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী, প্রবীণ রাজনীতিবিদ আবদুর রাজ্জাক মাত্র কিছুদিন আগে মারা গেছেন। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে কটু কথা বলাটা সৌজন্যের মধ্যে পড়ে না। তবু জনগণকে সঠিক তথ্য জানানোর খাতিরে তার কিছু কর্মকাণ্ডের বিবরণ বাধ্য হয়েই দিতে হচ্ছে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করে গেছেন। পাঠকের স্মরণে থাকার কথা যে, আবদুর রাজ্জাক একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল নিয়ে ২০০৯ সালে টিপাইমুখ পরিদর্শনের নামে ভারতে আনন্দ সফর করে এসেছিলেন। দিল্লি থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করে ভারত সরকারের পক্ষে তিনি যেভাবে সাফাই গেয়েছিলেন, তাতে দেশের সব দেশপ্রেমিক নাগরিক স্তম্ভিত হয়েছে। বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে, সংসদের বক্তৃতায়, টেলিভিশন টকশোতে এবং বিভিন্ন গোলটেবিল বৈঠকে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পক্ষে মরহুম আবদুর রাজ্জাক রহস্যজনক কারণে রীতিমত ওকালতি করেছেন। দিল্লি থেকে ফিরেই ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে যা বলেছিলেন শুধু সেটুকুই ২০০৯ সালের ৫ আগস্টের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করছি, ‘সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্পে ভারত এমন কিছু করবে না, যা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতি বা হুমকির কারণ হবে। ভারতীয় দুই মন্ত্রী এ ব্যাপারে আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার ভারতে ছয় দিনের সফর শেষে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন।
রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, ভারত এমন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে না বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি বলেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে, বিদ্যুতের জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হলে সুরমা ও কুশিয়ারাতে আগে যে পানি আসত, তা আরও বাড়বে।’
মরহুম আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্য নিয়ে অধিকতর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
সর্বশেষ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট ৫৪টি অভিন্ন নদী সংযুক্ত করে উজানে একতরফা পানি প্রত্যাহারের পক্ষে যে রায় ঘোষণা করেছেন তা রীতিমত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ২০০২ সালে ভারত সরকার সে দেশের আদালতেরই একটি রায়ের প্রেক্ষিতে এই বৃহত্ নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ি দাবি করেছিলেন, অভিন্ন নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারত বন্যা এবং খরার কবল থেকে রক্ষা পাবে। বাংলাদেশের জীবন-জীবিকা ধ্বংসকারী এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী এই প্রকল্পটির পরিকল্পনার কথা ১৯৮০ সালে সর্বপ্রথম প্রকাশ পেলেও ২০০২ সাল পর্যন্ত এটা কেবল আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। প্রধান বিচারপতি এস এইচ কাপাদিয়ার (SH Kapadia) নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রদত্ত রায়ে একটি নির্ধারিত সময়ের (Time-bound) মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। রায়ে আরও বলা হয়েছে, ‘We direct the Union of India to forthwith constitute a committee for interlinking of rivers. We direct the committee to implement the project.’ (আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিচ্ছি যে, তারা যেন অনতিবিলম্বে নদী সংযোগ প্রকল্পের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। আমরা কমিটিকেও প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্দেশ দিচ্ছি)। সুপ্রিমকোর্টের এই রায় বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত গঙ্গার পানি চুক্তির ৯ নম্বর ধারার (লেখার প্রারম্ভে উদ্ধৃত) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কেবল তাই নয়, ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের নজিরবিহীন রায় প্রতিটি আন্তর্জাতিক নদী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। আমি এই প্রসঙ্গে কেবল Helsinki Agreement এবং UN Convention-এর আলোকে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায়ের বিশ্লেষণ করব। এই দুটি ছাড়াও ভাটির দেশের অধিকার রক্ষায় আরও যেসব আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেগুলো লেখার কলেবর সীমিত রাখার লক্ষ্যে আপাতত উল্লেখ করা থেকে বিরত রইলাম।
১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ হেলসিংকিতে আন্তর্জাতিক নদীর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে যে চুক্তি (Agreement) স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেখানে পরিষ্কারভাবে কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক একতরফা পানি প্রত্যাহারকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চুক্তিটির নাম ‘Convention on the Protection and the Use of Transboundary Watercourses and International Lakes’। এই চুক্তিতে মোট ২৮টি ধারার মধ্যে আমার আজকের লেখার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ধারাগুলিই কেবল পাঠকের আন্তর্জাতিক আইন-কানুন বোঝার সুবিধার্থে এখানে উদ্ধৃত করছি। পাঠকের ধৈর্যের ওপর অত্যাচার হবে জেনেও বিনীতভাবে তাদের ওই ধারাগুলো মনোযোগের সঙ্গে পড়বার অনুরোধ করছি। আমি মনে করি, একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে হলে জনগণের তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত হওয়া অত্যাবশ্যক।
* 2-1. The parties shall take all appropriate measures to prevent, control and reduce any transboundary impact. (পক্ষগুলো সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং হ্রাস করা যায়।)
* (2-2c) The parties shall in particular take all appropriate measures to ensure that transboundary waters are used in a reasonable and equitable way, taking into particular account their transboundary character, in the case of activities which cause or are likely to cause transboundary impact. (পক্ষগুলো সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে যুক্তিসঙ্গতভাবে এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার নিশ্চিত হয়, বিশেষত আন্তর্জাতিক নদীর চরিত্রের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।)* (2-6) The riparian parties shall co-operate on the basis of equality and reciprocity, in particular through bilateral and multilateral agreements, in order to develop harmonized policies, programmes and strategies covering the relevant catchment areas, or parts thereof, aimed at the prevention, control and reduction of transboundary impact and aimed at the protection of environment of transboundary waters or the environment influenced by such waters, including the marine environment. (নদীতীরবর্তী পক্ষগুলো পরস্পরের সঙ্গে ন্যায্যতা ও দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে সহযোগিতা করবে, দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে সমন্বিত নীতিমালা প্রণীত হবে, সংশ্লিষ্ট নদীখাত এলাকা অথবা তার অংশবিশেষে এমন কর্মসূচি অথবা কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যাতে করে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করা যায় এবং নদীজ পরিবেশসহ আন্তর্জাতিক নদী অঞ্চলের পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্য অর্জিত হয়।)* ৪) The parties shall establish programmes for monitoring the conditions of transboundary waters. (পক্ষগুলো আন্তর্জাতিক নদীর অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করবে)* 9-1. The riparian parties shall on the basis of equality and reciprocity enter into bilateral or multilateral agreements or other arrangements, where these do not yet exist, or adopt existing ones, where necessary to eliminate the contradictions with the basic principles of this convention, in order to define their mutual relations and conduct regarding the prevention, control and reduction of transboundary impact. The riparian parties shall specify the catchment area or parts thereof, subject to co-operation. These agreements or arrangements shall embrace relevant issues covered by this convention, as well as any other issues on which the riparian parties may deem it necessary to co-operate. (অভিন্ন নদীতীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো ন্যায্যতা ও পারস্পরিক দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদন অথবা অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, যদি বিদ্যমান কোনো ব্যবস্থা না থাকে, অথবা বিদ্যমান ব্যবস্থায় এই কনভেনশনের সঙ্গে কোনো অসঙ্গতি থাকলে প্রয়োজন অনুসারে সেটি দূর করবে, যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অথবা আচরণ নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও হ্রাস করা সম্ভব হয়। রাষ্ট্রগুলো যার যার রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত নদীখাতের এলাকা নির্দিষ্ট করবে। এই চুক্তি অথবা ব্যবস্থা এমনভাবে প্রণয়ন অথবা গ্রহণ করতে হবে, যাতে এই কনভেনশনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় এবং অন্যান্য ইস্যুতেও অভিন্ন নদীর তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো তাদের মধ্যে প্রয়োজন অনুসারে সহযোগিতা করবে।)
কাজেই হেলসিংকি চুক্তির আলোকে ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের রায় যে আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। এই বিতর্কিত, সংকীর্ণ ও একপাক্ষিক রায়ে আন্তর্জাতিক নদী রক্ষা ও নদীজ পরিবেশ সংরক্ষণ, অভিন্ন নদী তীরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর বাধ্যবাধকতা এবং একে অপরের সঙ্গে অবশ্যকরণীয় সহযোগিতার প্রসঙ্গগুলো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।
(তৃতীয় ও শেষ পর্ব আগামী বুধবার)
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
সূত্র: আমারদেশ, 21/03/2012

ওরা জাতির পিতাকে সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে- সি রা জু র র হ মা ন

ওরা জাতির পিতাকে সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছে

সি রা জু র র হ মা ন
উনি বাংলাদেশে ফিরে প্রথমে হলেন রাষ্ট্রপতি, তারপর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে নিজে হলেন নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী। অন্তত আমি তাতে হতাশ হয়েছিলাম। মুজিব ভাই পাকিস্তান থেকে প্রথমে লন্ডনে এসেছিলেন। পাকিস্তানে তাকে এ ধারণা দেয়া হয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানকে ‘অটোনমি‘ (স্বায়ত্তশাসন) দিতে রাজি হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে শুনে তিনি রীতিমত একটা ধাক্কা খেয়েছিলেন।
আমি তাকে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির আনুপূর্বিক বিবরণ দিয়েছিলাম। এটাও তাকে বলেছিলাম, স্বাধীন বাংলাদেশের পুনর্গঠন এবং জনসাধারণের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা মেটানো কঠিন হবে। তিনি যদি রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রী না হয়ে গান্ধীর মতো একটা অভিভাবকের (হাতে একটা চাবুক রাখার কথাও বলেছিলাম তাকে) ভূমিকা নেন তাহলে ভালো হবে বলেও বলেছিলাম তাকে। মুজিব ভাইকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনতাম। তখন তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন। তারপর আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মসহ তার রাজনৈতিক জীবন এবং স্বল্প কিছুকালের মন্ত্রিত্ব লক্ষ্য করেছি সাংবাদিক হিসেবে। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা তার বিশেষ ছিল না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের গোটা রক্তক্ষরা সময় তিনি ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে। দেশে তখন কী ঘটেছে, কে কী করেছে, এসব সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না।
আমি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম যাই তার মাসখানেক পরে। আমি দিল্লি হয়ে কলকাতায় যখন পৌঁছি তখন তিনি মনুমেন্ট ময়দানের পাদদেশে বিশাল জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। কলকাতার সাংবাদিক বন্ধুরা বলছিলেন, শেখ মুজিব এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীকে নির্বাচনী বৈতরণী পার করে দিতে। শুনেছিলাম, ঢাকা থেকে যশোর-খুলনা যাওয়া সুবিধাজনক নয়। তাই ঢাকা যাওয়ার আগেই একখানি ভারতীয় গাড়ি ভাড়া নিয়ে আমি সে দুটো জেলা সফর করি। আমার সঙ্গে আরও ছিলেন ডেনমার্কের ‘ইনফরমেশন‘ পত্রিকার সম্পাদক ও ডেনিশ রেডিওর ভাষ্যকার পল নিলসেন। আমার সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ দেখবেন বলে দু’দিন ধরে তিনি কলকাতায় অপেক্ষা করছিলেন।
বিবিসিতে নিয়মিত খবর পেয়েছি এবং সেসব খবর প্রচার করেছি। তা সত্ত্বেও যশোর এবং খুলনায় ক্ষয়ক্ষতি যা দেখেছি তাতে স্তম্ভিত হয়েছি। বিশেষ করে বেনাপোল থেকে যশোর যাওয়ার রাস্তা যেখানে খুলনা রোডের সঙ্গে মিশেছে, সেখানে ধবধবে সাদা কঙ্কালের স্তূপের দৃশ্য এখনও প্রায়ই আমার মনে পড়ে। ভারতীয় বিমানে ঢাকা যাওয়ার পথে কলকাতার পত্রিকায় বাংলাদেশ বিমানের ট্রেনিং ফ্লাইট বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পড়ে কান্না সামলাতে পারিনি। নিহত পাইলটদের মধ্যে একাধিক আমার পরিচিত ছিলেন। বিশেষ করে ক্যাপ্টেন নাসিরুদ্দিন হায়দার সবুজ কলকাতায় আমার বন্ধু এবং মুকুল ফৌজে সহকর্মী ছিলেন।
তেজগাঁ বিমানবন্দরে নেমে দেখি লোকে লোকারণ্য। অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পাঁচ-ছয় হাজার লোক নিয়ে আমাকে অভ্যর্থনা করতে এসেছেন। বিবিসিতে চাকরি করি, খবর পড়ি, তারই জন্য মানুষের এত কৃতজ্ঞতা অত্যন্ত গভীরভাবে প্রাণকে স্পর্শ করেছিল। পরদিন সকালে জনদুই বন্ধু এসেছিলেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দেখা করতে। একজন অপরিচিত তরুণও এলেন। বললেন, শেখ ফজলুল হক মণির সঙ্গে দেখা করলে আমার উপকার হবে। প্রধানমন্ত্রীর (শেখ মুজিব) সঙ্গে সাক্ষাত্ এবং অন্য কোনো ব্যাপারে সাহায্যের প্রয়োজন হলে তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় জানালাম। বন্ধুরা বললেন, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধানমন্ত্রিত্বকে তার পরিবারের কোনো কোনো সদস্যসহ কিছু লোক অর্থকরী ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
মুজিবকে ওরা ঘিরে রেখেছিল
লন্ডনে হাইকমিশনারের অফিস থেকে ওরা টেলিফোন করে বলেছিলেন, ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর প্রিয় পাইপের তামাক পাওয়া যাচ্ছে না, আমি কিছু তামাক নিয়ে গেলে ভালো হবে। আমি দু’পাউন্ড এরিনমোর তামাক আর ভালো দেখে ডানহিলের একটা পাইপ (তার মৃতদেহের সঙ্গে যে পাইপটা ৩২ নম্বর রোডের বাড়ির সিঁড়িতে পড়েছিল) নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো নিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই পুরনো গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব বললেন, পরে কখনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে। আমার বিস্ময়ের কারণ এই ছিল যে, ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার ২০ বছরের বেশি দিনের পরিচয় এবং মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতার কথা তিনি ভালো করেই জানতেন। তবে আমি জানতাম, মুক্তিযুদ্ধে তিনি পুরোপুরি আমাদের পক্ষে ছিলেন না।
আমি ফিরেই আসছিলাম, কিন্তু অন্য একজন কর্মকর্তা নিরাপত্তা প্রহরীদের আমার পরিচয় দিয়ে এসে বললেন, আপনি সরাসরি চলে যান, দেখি কে আপনার পথ আটকায়। প্রহরীরা স্যালুট করে আমাকে ভেতরে যেতে দিলেন। মুজিব ভাই খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে ডেকে পাশে বসালেন, কর্মচারীদের বললেন, ‘সিরাজ স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছে, ওকে মিষ্টিমুখ করাও, রসগোল্লা খাওয়াও।’ মন্ত্রী কামরুজ্জামান আর তোফায়েল আহমেদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে। তাছাড়া চার-পাঁচজন অচেনা লোক, তারা ‘জি হুজুর’ ভঙ্গিতে হাতজোড় করে বসেছিলেন। আমি তামাক আর পাইপ তার হাতে দিলাম। তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সপ্রশংস দৃষ্টিতে পাইপটা দেখলেন। বললেন, ‘আমি ঘুষ খাই না, কিন্তু সিরাজ আমার ভাই, সে পাইপ এনেছে, সেটা আমি খাব।’ এমন সময় কবি জসিম উদ্দিন মনোজ বসুর নেতৃত্বে এক ডজনেরও বেশি কলকাতার লেখককে নিয়ে ঢুকলেন। তারা সবাই লাল ফিতায় বাঁধা নিজেদের বই টেবিলে রাখলেন আর ঝুঁকে প্রধানমন্ত্রীর চরণ স্পর্শ করে তাকে প্রণাম করলেন। আমার খুব খারাপ লেগেছিল বয়োজ্যেষ্ঠ লেখকদের এই হীনমন্যতা দেখে। আমি বিদায় চাইলাম। মুজিব ভাই আমার হাত ধরে বললেন, ‘কাল ভোরে ভোরে আসিস, তোর সঙ্গে অনেক কথা আছে।’
পরদিন তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধে আমার ভূমিকার কথা তিনি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে শুনেছেন। আমাকে তিনি পুরস্কৃত করতে চান। আমি বললাম, আমি চাই তার সবচেয়ে প্রিয় পোট্রেট। কামাল লোহানী তখন ভারপ্রাপ্ত জনসংযোগ অধিকর্তা। তিনি গণভবনে হাজির ছিলেন। মুজিব ভাই তার সব ফটো তার কাছে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। আমি বললাম, পরদিন সকালে আমি চাটগাঁ যাচ্ছি, ২২ ফেব্রুয়ারি তার সঙ্গে দেখা করব।
সড়কপথে চট্টগ্রাম
দাউদকান্দিতে বড়সড় একদল তরুণ (তারা দাবি করেছিলেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা) সড়কে ব্যারিকেড তৈরি করেছেন। ওখানে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা বাস চাপা পড়ে মারা গেছেন। শেখ মুজিব নিজে এসে বিচার না করলে সে সড়ক দিয়ে কেউ যেতে পারবে না। আমি বিবিসির সিরাজুর রহমান, বিবিসির কাজে চাটগাঁ যাচ্ছি শুনে আমাকে যেতে দিতে রাজি হলো তারা, তবে এ শর্তে যে আমাকে কিছু বলতে হবে। এমন সময় জিপে হাজির হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল ভানোট। তিনি জানতে চাইলেন, আমি নিরাপদ আছি কিনা। বললাম, আমার নিরাপত্তার কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা হচ্ছে জনপ্রিয়তার। কর্নেল ভানোট ‘বাই বাই’ বলে চাটগাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে একজন আমাদের গাড়িতে চাটগাঁ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। আরও কয়েকটা ব্যারিকেড তিনি আমাদের পার করে দিয়েছিলেন, তবে সবখানেই আমাকে ছোটখাটো বক্তৃতা করতে হয়েছিল।
চাটগাঁয় ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানির মাঠে বিরাট জনসভাসহ অনেক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে হয়েছে। অনেক ফুলের তোড়া আর মালা পেয়েছিলাম। ফিরতি পথে ভোরে ভোরে বেরিয়ে পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন বন্ধুরা। পথঘাট নিরাপদ নয়, ডাকাতি, গাড়ি ছিনতাই অহরহ হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় নভেম্বরে মা মারা গিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনাদের ভয়ে কাছের এক গ্রামে লুকিয়ে থাকা ভাইরাও তার জানাজায় আসতে পারেননি। বৃদ্ধ বাবা গ্রামের বাড়িতে সম্পূর্ণ একলা। ঠিক করলাম, ফেনী থেকে চৌমুহনী হয়ে আমিশাপাড়ায় আব্বার সঙ্গে দেখা আর আম্মার কবর জিয়ারত করে ঢাকা ফিরব। লাকসামে বড় সেতুটি মুক্তিযোদ্ধারা ভেঙে দিয়েছিল। ফিরতেও হবে আবার ফেনী হয়ে। এদিকে সন্ধ্যার পর ফেরি চলে না। আইডব্লিউটিএ ব্যবস্থা করেছিল যে আমার জন্য দাউদকান্দির ফেরি সন্ধ্যা ৮টা পর্যন্ত দেরি করবে। সুতরাং ফেরার চিন্তাও আছে।
শহীদ দিবসের ফুল আর আমার গাড়ি
বাবা-ছেলে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম কিছুক্ষণ। আব্বা খুব শুকিয়ে গিয়েছিলেন। গ্রামের বুয়ার রান্না মোটেই খেতে পারেন না। বুয়াকে বললাম, একটা মুরগি জবাই করে কেটেকুটে দিতে। নিজেই আমি সে মুরগি, কচি লাউয়ের তরকারি আর মসুর ডাল রান্না করলাম। বাবা-ছেলে আর ড্রাইভার একসঙ্গে বসে খেলাম। ততক্ষণে বেলা পড়ে গেছে। আব্বার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার যাত্রা শুরু। ফেনী ঘুরে কুমিল্লার কাছাকাছি যখন এসেছি তখন সন্ধ্যা ৭টা পার হয়ে গেছে। হেডলাইটের আলোয় দেখি দুটি ছেলে রাইফেল উঁচিয়ে পথরোধ করে আছে।
সেদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি। ওরা কুমিল্লায় ডিসি সাহেবের বাংলো থেকে শহীদ মিনারের জন্যে ফুল আনতে যাবে, অতএব আমার ভাড়া করা গাড়িটা তাদের দরকার। বললাম, তাতে কোনো সমস্যা নেই, আমিও ডিসি সাহেবকে সালাম দিতে যাব, ওরা আমার সঙ্গে আসতে পারে। আমার প্রস্তাব তাদের মনঃপূত হলো না। ওদের গাড়ির চাবি দিয়ে ড্রাইভার আর আমাকে নেমে যেতে হবে। ড্রাইভার বুদ্ধিমান লোক। বলল, উনি কে জানলে তোমরা এ গাড়ি নেবে না। আমি বিবিসির সিরাজুর রহমান শোনার পর ওদের সুর সম্পূর্ণ বদলে গেল। দাবি করল, ওদের ‘অটোগ্রাফ’ দিতে হবে। হেডলাইটের আলোয় রাইফেলের বাঁটে কাগজ রেখে ওদের অটোগ্রাফ দিলাম। ওরা বলল, অন্য কারও গাড়ি নেবে তারা।
২২ তারিখ সকালে গেলাম পুরনো গণভবনে। মুজিব ভাই কিছুটা বিদ্রূপের সুরেই বললেন, আমার তো ধারণা ছিল বাংলাদেশে ফুলের মালা শেখ মুজিবুর রহমানই পান। আমি বললাম, বড় ভাইয়ের গৌরবের ছিটেফোঁটা তো ছোট ভাইদের গায়েও লাগে। উনি বরাবরের মতো পাশে বসতে বললেন। বললেন, দেশে কি আর ফিরবি না? আমি বললাম, ফিরব না কেন, অবশ্যই ফিরব। তিনি জানতে চাইলেন, দেশে এসে কী করবি? এবারে বিদ্রূপের পালা আমার। বললাম, এসে আপনার অফিসের বাইরে ফুলের দোকান করব। আর আপনার কর্মচারীদের ঘুষ দেব। ফুলের মালা আপনার কাছে আসবে আর পেছন দরজা দিয়ে আমার কাছে ফিরে ফিরে যাবে; ব্যবসায় ভালো হবে, কী বলেন? এবারে হো-হো করে হাসলেন মুজিব ভাই।
একজন কর্মচারী এক স্তূপ ফটো এনে রাখলেন তার সামনের কফি টেবিলের ওপর। মুজিব ভাই তার নিজের ছবিগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিলেন। বললেন, ছবিগুলো তোর ভাবীর কাছে নিয়ে যা, তাকেই বলিস একটা ছবি পছন্দ করে দিতে। আমি বললাম, সেটা তার পছন্দ হবে, আমি চাই আপনার পছন্দের ছবি। একসময় লক্ষ্য করলাম, একটা ছবি তিনি দেখছেন বারবার করে। পকেট থেকে কলম বের করে তার হাতে দিলাম। বললাম, লিখে দিন যে এ ছবিটা আপনি আমাকে দিলেন। আর জনসংযোগ বিভাগকে বলে দেবেন, এ ছবি যেন আর কোথাও ব্যবহার না করা হয়। তিনি ছবির নিচের দিকের ডান কোণে লিখলেন, ‘স্নেহের সিরাজকে, তোমার মুজিব ভাই, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।’ আমি বললাম, পরশু লন্ডনে ফিরে যাচ্ছি, মুজিব ভাই। তিনি বললেন, বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের যেসব প্রস্তাব আবু সাঈদ চৌধুরীকে দিয়েছিলি সেগুলো লিখে তার কাছে দিয়ে যাস। আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
নতুন স্বাধীন দেশের কিছু আলামত
পুরনো এত কথা লেখার কয়েকটা উদ্দেশ্য আছে। একটা হচ্ছে, নতুন প্রজন্মের পাঠকদের স্বাধীন বাংলাদেশের গোড়ার দিকের একটা খণ্ডচিত্র দেয়া। দেশ তখনও ভারতীয় সেনাদের দখলে। আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, এমন কিছু লোক প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে আছে যারা চায়নি যে, কেউ তাকে সুপরামর্শ দিক। তারা স্তব-স্তুতি আর ফুলের মালা দিয়ে তাকে সম্মোহিত করে রেখেছিল এবং সেই অবসরে তারা পুরোদমে লুটপাট করেছে। দুর্নীতি প্রধানমন্ত্রীর নিজের পরিবারেও ঢুকে পড়েছিল।
কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে দেখে এসেছিলাম, নবগঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জওয়ানরা রবারের স্যান্ডেল পরে কুচকাওয়াজ করছে। ঢাকায় এসে দেখি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জিপে চড়ে আর সে বাহিনীর উর্দি পরে রক্ষী বাহিনীর লোকেরা ঢাকার রাস্তায় হাওয়া খাচ্ছে। তখন শুনেছিলাম, রক্ষী বাহিনীর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন তোফায়েল আহমেদ এবং ভারতীয়দের গড়ে দেয়া মুজিব বাহিনীর অধিনায়করা (শেখ ফজলুল হক মণি, শেখ কামাল, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ)। মুজিবের যারা সমালোচনা করছিল রক্ষী বাহিনী তাদের ধরে নিয়ে গেছে, তারপর আর তাদের কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। পরের বছরের ৭ মার্চ মধ্যমেয়াদে সংসদ নির্বাচন দিলেন মুজিব ভাই। উদ্দেশ্য ছিল, একদলীয় আওয়ামী লীগ সংসদ প্রতিষ্ঠা করা। সে নির্বাচন দেখতে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে হেলিকপ্টারে চড়ে দুটো জনসভায় গিয়েছি। সে নির্বাচনে অসাধুতা আর বলপ্রয়োগে আওয়ামী লীগের আসন দখলের খবর পরিবেশন করেছি। বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক সঙ্কট, দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার মৃত্যু আর রক্ষী বাহিনীর ৪০ হাজার মানুষ হত্যার খবর নিয়মিত পরিবেশন করেছি।
বাংলাদেশের মানুষ তখন রণক্লান্ত। তারা মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করেছে, কিন্তু গণতন্ত্রকে হত্যা করে মুজিবের আজীবন রাষ্ট্রপতি হওয়া সহ্য করতে তারা রাজি ছিল না। আমার কোনো সন্দেহ নেই, মুজিব ভাইকে সম্মোহিত আর নিষ্ক্রিয় রেখে যারা লুটপাট চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিল তাদের পরামর্শেই এসব অপকর্ম তিনি করেছিলেন। কিন্তু ততদিনে জাতির সহ্যসীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাগুলো জনকয়েক সেনা অফিসার ঘটালেও তাদের বিদ্রোহের পেছনে জাতির সম্মতি ছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান ফেরেশতা ছিলেন না, কিন্তু তার অনেক সদ্গুণ ছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা হিসেবে তিনি অবশ্যই জাতির পিতা ছিলেন। তিনি উপমহাদেশের হানাহানি আর বিবাদের অবসান করতে চেয়েছিলেন। কট্টর যুদ্ধাপরাধী বলে শনাক্ত করা ১৯৫ পাকিস্তানি সৈন্যকে মুক্তি দিতে তিনি সেজন্যই রাজি হয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ও ভুট্টোর সঙ্গে শিমলা চুক্তি করেছিলেন, স্বয়ং লাহোর সফর করেছেন তিনি। স্বদেশেও তিনি সামাজিক শান্তি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল তাদের জন্য তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন।
প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসা
স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকালে দেশে মোটামুটি সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা প্রায় ছয় বছর দিল্লিতে গোয়েন্দা বাহিনী র’-এর হেফাজতে থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন ঘৃণা আর প্রতিহিংসার বাসনা নিয়ে। তার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ১৩ দিনের মাথায় রাষ্ট্রপতি জিয়া এক গভীর ষড়যন্ত্রে নিহত হন, যে ষড়যন্ত্রের কোনো সুরাহা আজও হয়নি। জেনারেল এরশাদের সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন দিয়েছেন শেখ হাসিনা, ওই স্বৈরতন্ত্রকে ৯ বছর স্থায়ী হতে সাহায্য করেছেন।
নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে হাসিনা দু’বার ক্ষমতা পেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। জাতির দুর্ভাগ্য, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বক্ষণ তিনি প্রতিহিংসার মন্ত্র প্রচার করেছেন, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। বর্তমান দফায় ক্ষমতা পেয়ে তিনি ‘বিচার বিচার’ স্লোগান তুলেছেন। কিন্তু কার বিচার, কিসের বিচার? তার দুই দফা প্রধানমন্ত্রিত্বকালে যে হাজার হাজার মানুষ খুন হয়েছে, হাজার হাজার নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তাদের বিচার? সাংবাদিক হত্যার বিচার? রুনি ও সাগরের হত্যার বিচার? মোটেই নয়। চার দশক আগে কী ঘটেছিল অথবা ঘটেছিল বলে কল্পনা করা হচ্ছিল, সেসবের বিচারের নামে তিনি আবার বাংলাদেশের আকাশ-বাতাসকে ঘৃণার ধোঁয়ায় বিষাক্ত করে দিয়েছেন। যারা তাঁর সমালোচনা করে তাদের সবাইকে যুদ্ধাপরাধী অপবাদ দিয়ে জেলে পোরা হচ্ছে। গদি রক্ষার জন্য তিনি জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক সম্পদকে ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
বাংলাদেশী জাতি অতীতকে ভুলে যেতে চেয়েছিল, মুজিবকে তারা জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা সমাহিত অতীতকে শান্তিতে থাকতে দেননি। কী প্রয়োজন ছিল অযথা মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ইত্যাদি মিথ্যা খেতাব দেয়ার? শেখ হাসিনা মনে করেন, তার বাবা (এবং হয়তো তিনি স্বয়ং) ছাড়া বাংলাদেশে আর কারও কোনো অবদান নেই। শহীদ জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারকে তিনি অশ্রাব্য গালাগাল করেন, জিয়ার পরিবারকে হয়রানি করার কোনো চেষ্টারই তিনি ত্রুটি রাখেন না।
একথা শেখ হাসিনা একবারও কি ভাবেন না যে, ঢিলটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়? জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে তার অবিরাম গীবতের কারণে অনেকেই এখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার ও তার বাবার ভুল-ত্রুটি অন্যায়-অবিচারের ঘটনাগুলো খুঁড়ে বের করতে বাধ্য হচ্ছেন। হাসিনা নিজের মানসম্মান নিয়ে চিন্তিত কিনা জানি না, কিন্তু জাতির পিতার স্মৃতিকে নতুন করে অবমানিত করার, তার ভাবমূর্তিকে নতুন করে হত্যা করার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে, মৃত্যুদিনে তার কথা ভাবি। কিন্তু আর কোনো লেখকের মতো স্তব-স্তুতি-ভারাক্রান্ত মিথ্যা লিখতে ইচ্ছা করে না। তখন মনে পড়ে যায়, সত্তরের দশকে যারা তাকে স্তব-স্তুতি দিয়ে ভুলিয়ে রেখে তার ও জাতির সর্বনাশ করেছিল তাদের কথা। শেখ হাসিনা অতীত থেকে শিক্ষা নেননি। বরং অতীতের ভুল-ত্রুটিগুলোর অনুকরণ করতে চাইছেন তিনি। তার বাকশালী মনোভাব বাংলাদেশকে কোনো কল্যাণ দিতে পারবে না, যেমন পারেনি পঁচাত্তরের বাকশাল। (লন্ডন, ১৯.০৩.১২)
serajurrahman@btinternet.com
সূত্র: আমারদেশ, 21/03/2012

রবিবার, ১৮ মার্চ, ২০১২

ভালো ডাক্তার চিনবেন কিভাবে? - আবু আহমেদ

ভালো ডাক্তার চিনবেন কিভাবে?

॥ আবু আহমেদ ॥

একজন ডাক্তার ভালো কি মন্দ সেটা রোগীরাই ভালো বলতে পারেন। তেমনিভাবে একজন শিক্ষক ভালো কি মন্দ সেটা তার ছাত্ররাই ভালো বলতে পারেন। আমি একবার আমার এক সাবেক ছাত্রীকে, যে এখন হাইকোর্টের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার- তাকে প্রশ্ন করলাম, ভালো উকিল কে? সে উত্তর দিয়েছিল- সেই ভালো উকিল, দিনশেষে যে মক্কেলের জন্য মামলাটা জিততে পেরেছে। আমি ভাবলাম উত্তরটা তো ভালোই দিয়েছে। তাকে বললাম, তোমার ওকালতির জীবন কেমন যাচ্ছে। সে বলল, মোটামুটি, একজন সিনিয়রের সাথে আছি। যাক, অনেক শিক্ষকের পেটে অনেক বিদ্যা থাকে, তবে মুখে বের হয় না। ছাত্ররা ভাবে, স্যার জানেন অনেক কিন' পড়াতে পারেন না। এমন শিক্ষকদেরও কদর আছে। তবে ক্লাসরুমে নয়, গবেষণায়। তেমনিভাবে ডাক্তারদের মধ্যেও এমন অনেকে থাকতে পারেন, যারা ডাক্তারিবিদ্যা জানেন অনেক কিন' রোগী ভালো করতে পারেন না অথবা রোগীরা তার সামনে গেলে সন'ষ্টচিত্তে ফেরত আসেন না। ভালো ডাক্তারিবিদ্যা রোগী ভালো করার ক্ষেত্রে সব সময় কাজে না দিলেও, ক্লাসরুমে ভালো কাজ দিতে পারে, তিনি যদি চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষক হন।

আমি একবার একটা ছোট্ট বই পড়েছিলাম, লিখেছিলেন খ্যাতিমান চিকিৎসক ও অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী। বইটির নাম হুবহু মনে নেই, তবে হয়তো হবে এমন- ‘রোগ চিনবেন কিভাবে?’ ওই বই পড়লে কোন রোগের কী চিহ্ন, কোন রোগের জন্য কী ল্যাব টেস্ট করাতে হবে ইত্যাদি সম্বন্ধে জানা যায়। তবে ভালো ডাক্তার চিনবেন কিভাবে এ ব্যাপারে বোধ করি কোনো অধ্যাপক ডাক্তার কিছু লেখেননি। লিখলে ভালো হতো। অনেক লোক উপকৃত হতো। একজন ভালো ডাক্তার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রোগী এক ডাক্তার থেকে আরেক ডাক্তারের কাছে ছুটছে শুধু একজন ভালো ডাক্তার পাওয়ার জন্য। এ ক্ষেত্রে লোকমুখে বা পুরনো রোগীদের কাছে শোনা কথা রোগীর সম্বল। জাতীয় অধ্যাপক ডাক্তার নুরুল ইসলাম ভালো ডাক্তার চেনার একটা সহজ পদ্ধতি সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন। সেই পদ্ধতি হলো- উনিই ভালো ডাক্তার- যে ডাক্তার কম ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছেন। শুনেছি জাতীয় অধ্যাপক ডাক্তার ইব্রাহিমও অনেক বড় ডাক্তার ছিলেন। তিনি জীবিত থাকলে নিজে রোগী হয়ে না গেলেও কোনো আত্মীয়কে নিয়ে তার সামনে অবশ্যই যেতাম। জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ভালো ডাক্তার চেনার যে উপায় বাতলে দিয়েছেন তার সাথে আমিও একমত। আমার যত ভয় বেশি ওষুধকে নিয়ে। একবার এক অসুখে পড়ে আমি তিন ডাক্তার বদল করেছি শুধু কম ওষুধ নেয়ার জন্য। অনেক ডাক্তারকে দেখি পৃষ্ঠাভর্তি প্রেসক্রিপশন লিখছেন, যদিও অন্য ভালো ডাক্তারেরা বলবেন- ওই প্রেসক্রিপশনের তিন-চতুর্থাংশই অপ্রয়োজনীয়। ওষুধ অপ্রয়োজনীয় হলেও আমি অত ভয় করতাম না, না হলে দুটো টাকা বেশিই গেল, কিন' ওষুধের যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। ওষুধ শুধু রোগ সারায় না, ওষুধ রোগ সৃষ্টিও করে!


আজকে যে আমাদের সমাজে এত লাখ লাখ লোক রোগী হলো, এরা কি সবাই ভেজাল আর দূষিত খাদ্য খেয়ে রোগী হয়েছে? আমার বোধ অনুযায়ী এসব রোগীর এক বিরাট অংশ ওষুধের শিকার। বাকিটা সৃষ্টি করেছে হাসপাতাল! কি বিশ্বাস হয় না? জিজ্ঞেস করুন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এমন সচেতন রোগীদের। ব্যথা হয়েছে, ডাক্তার সাহেব অবলীলায় ব্যথানাশকের ওষুধ দিলেন। কিন' ওই ওষুধ যে রোগীর কিডনির ওপর আঘাত হানতে পারে, এটা কি রোগী জানেন? ভিটামিনেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে এইটা বা কয়জন রোগী জানেন! কিন' অনেকেই তো ওষুধের দোকান থেকে হরদম ভিটামিন এ, ভিটামিন বি, ভিটামিন ই, ভিটামিন ডি ট্যাবলেট কিনে খাচ্ছেন। ভাবছেন খাওয়া-দাওয়া যখন দূষিত, তখন ভিটামিন সাপ্লিমেট দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবেন। কিন' তা কি হচ্ছে? আসলে অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ভালো খাবারের বিকল্প কোনো ভিটামিন ট্যাবলেট হতে পারে না। দেশে যে কয়েক শ’ ওষুধ কোম্পানি আছে এদের কাজ কী? নিশ্চয়ই ওষুধ তৈরি করে মানুষকে তা খাওয়ানো। ওষুধ না খাওয়াতে পারলে তাদের লাভ হবে কিভাবে? আর ওষুধ খাওয়ানোর জন্য ভালো মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে আমাদের ডাক্তার সাহেবদের। এখন বুঝুন- কেন কোনো কোনো ডাক্তার এত বেশি ওষুধ লেখেন। বিশ্বের কোথাও কি আপনারা এত ওষুধের দোকান দেখেছেন? যে দেশে প্রকাশ্যে এত এত ডাক্তারের সাইনবোর্ড, এত এত ওষুধের দোকান, এত এত ল্যাব টেস্টের সেন্টার, এত এত হাসপাতাল, সে দেশে রোগী তো বেশি থাকবেই। রোগী কম থাকলে যে এদের ব্যবসায় কমে যাবে। এই সব সেন্টার আর হাসপাতালের মান কে নিয়ন্ত্রণ করছে? কেউ না। নিজেরা স্বাধীনভাবে চলে। শুনেছি আরো ২৫টি কলেজকে প্রাইভেট সেক্টরে অনুমোদন দেয়া হয়েছে ডাক্তার তৈরির জন্য। জানি না ওই সব কলেজের তৈরি ডাক্তারেরা আবার কেমন হয়। ডাক্তারদের গুণাগুণ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেক রোগী আবার ফরেন ডিগ্রিধারী ডাক্তারদের পেছনে ছোটেন। কী করবে, ডাক্তার বাছার ক্ষেত্রে তাদের সামনে অন্য ভালো উপায়ই বা কী আছে। প্রফেসর নুরুল ইসলামের সেই ভালো ডাক্তার চেনার কৌশলের সাথে আমার যোগ করতে ইচ্ছা হয় নিম্নের কয়েকটি কথাও: এক. উনিই ভালো ডাক্তার যে রোগীকে কোনো ওষুধই দিলেন না। শুধু বললেন, আপনি ভালো আছেন, এভাবে এভাবে চলবেন। অসুবিধা হলে পরে আবার আসবেন।

দুই : ওষুধ দিলেন তো, কম ওষুধ দিলেন। তিন নম্বরের ওষুধটি সম্বন্ধে বললেন, খেলেও খেতে পারেন, মনে না চাইলে না খাবেন। বয়স হয়ে গেছে, কিছু ল্যাব টেস্ট ছয় মাস পরপর করালে ভালো হবে। এবং ওগুলো দেখিয়ে নেবেন।

তিন : রোগীর সাথে হেসে হেসে কথা বলবেন। আর রোগীকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করবেন যে, আপনার রোগ অত বড় কিছু না। এই ওষুধ দিলাম, আশা করি ঠিক হয়ে যাবেন। এত মাস/ দিন পর আবার দেখা করবেন।

চার : রোগী পূর্বাপর কী ওষুধ সেবন করেছে জানবেন। রোগীকে শুইয়ে প্রাথমিক পরীক্ষাগুলো করবেন। আগের ওষুধ থেকে যেটি অপ্রয়োজনীয় মনে করবেন, সেটি বাদ দেবেন। এভাবে রোগী দেখতে যদি আধা ঘণ্টা যায় যাক, রোগী চাচ্ছে ভালো হতে। সে জন্য রোগী প্রয়োজনীয় ফি
দিতে প্রস'ত।
লেখক : প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, ঢা.বি.

শুক্রবার, ১৬ মার্চ, ২০১২

আওয়ামী লীগ নিজের মাথায় আঘাত করেছে

আওয়ামী লীগ নিজের মাথায় আঘাত করেছে

আওয়ামী লীগ নিজের মাথায় আঘাত করেছে

॥ সিরাজুর রহমান ॥

কাজটা দুঃসাধ্য। তবু অভূতপূর্ব দক্ষতার সাথে আওয়ামী লীগ সে অসাধ্য সাধন করেছে- তারা নিজের মাথায় নিজেই আঘাত করেছে। গত ১২ মার্চ বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট এবং গণতন্ত্রমনা আরো কায়েকটি দলের মহাসমাবেশ সম্বন্ধে অন্য কোনো রায় দেয়া সম্ভব নয়।
বিএনপি যদি সোমবার হরতাল ডাকত, সেটা এতটা সফল হতো কি না বলা কঠিন। কিন' শাসক দল আওয়ামী লীগ গায়ে পড়ে বিএনপিকে অভূতপূর্ব সাফল্য দিয়েছে। বিএনপি এবং অনানুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রসারিত মহা-মহাজোটের সমর্থকেরা মনে মনে নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগকে ধন্যবাদ দেবেন।
অথচ এ দিনের কর্মসূচি বানচাল করে দেয়ার ওপর আওয়ামী লীগ তাদের ভবিষ্যৎ বাজি রেখেছিল। তিন দিন আগে থেকে তারা ঢাকাকে অবরুদ্ধ দুর্গে পরিণত করেছিল। আশা করেছিল যে, সে দুর্গে চোখ বন্ধ করে বসে থেকে তারা এই বলে আত্মপ্রতারণা করবে যে, বিএনপি মহাসমাবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের গদি এখন নিরাপদ। আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমতের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল শনি থেকে সোমবারের মধ্যে সেটা যে সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে চলে গেছে, শাসক দলের কোনো কোনো নেতা হয়তো এখনো সেটা বুঝে উঠতে পারেননি। বড় বড় কথা আর হুমকি-ধমকি দিয়ে তারা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করছেন, যেমন করে অন্ধকারের নিঃসঙ্গ পথিক ভয় কাটাতে শিস দেয়। বাংলাদেশের মানুষকে চিনতে অস্বীকার করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের শুরু থেকে আওয়ামী লীগ বরাবরই স্বৈরতন্ত্রী দল ছিল। বর্তমান সরকারের আমলে এসে সেটা সন্ত্রাসী দলে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা পেয়ে তিনি যে সশস্ত্র ক্যাডার গঠন করেন, তাদের ব্যবহার করা হয়েছিল বিএনপিকে বাকরোধ করার কাজে। বিএনপিকে তারা সভাসমাবেশের জন্য স'ান দেয়নি, রাজপথে বিএনপির মিছিলের ওপর অসংখ্যবার হামলা হয়েছে, ১৯৯৬ সালে রাজধানীর মালিবাগে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ডা: ইকবালের নেতৃত্বে ক্যাডারেরা বিএনপির মিছিলে গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করেছিল। আরো উল্লেখ্য, দ্বিতীয় দফা গদি পেয়ে শেখ হাসিনার সরকার ডা: ইকবাল ও অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিয়েছে।
দ্বিতীয় দফায় গদি পেয়ে আওয়ামী লীগ সশস্ত্র ক্যাডারদের সংখ্যা বহু গুণে বাড়িয়ে তুলেছে। এদের পোষা হচ্ছে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ইত্যাদি আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনগুলোর ছত্রছায়ায়। এবারে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে শুধু বিএনপিকে সভা-সমিতি আর মিছিল করা থেকে বঞ্চিত করাই নয়, বিএনপিসহ সব গণতান্ত্রিক প্রতিপক্ষকে সমূলে উচ্ছেদ করার কাজে। বিএনপিকে সভাসমাবেশ করার অনুমতি কিংবা স'ান দেয়া হয় না। দেয়া হলেও আওয়ামী লীগের ক্যাডারেরা একই সময়ে এবং একই স'ানে ভুয়া সভা, সমাবেশ, মিছিল ইত্যাদি ডেকে বসে। দলীয়কৃত প্রশাসন ‘ওপর-ওয়ালাদের’ নির্দেশমতো ‘শান্তি রক্ষার্থে’ ১৪৪ ধারা জারি করে বিএনপির সভা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। বিগত তিন বছরে এমন ঘটনা বাংলাদেশের সর্বত্র অহরহ ঘটছে।
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস'া ফিরিয়ে আনতে খালেদা জিয়ার আন্দোলনের সাফল্যে সরকার ভীত ও শঙ্কিত। রোডমার্চ করে তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের মানসকন্যা খালেদা জিয়া সিলেট, রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে গেছেন। লাখ লাখ লোক সড়কের ধারে দাঁড়িয়ে তাকে হর্ষধ্বনি দিয়েছেন, পথসভাগুলোতে তার বক্তৃতা শুনেছেন বহু লক্ষ লোক, নির্ধারিত সভাগুলোতে কয়েক কোটি লোক এ যাবৎ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে তার ভাষণে উৎসাহিত হয়েছেন। এসব সভায় নেত্রী একটাই দাবি করেছেন, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস'া ফিরিয়ে আনতে হবে। কোথাও যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গ মুখেও আনেননি। অথচ আওয়ামী লীগের গোয়েবলস আর তাদের প্রচারযন্ত্রগুলো দিন-রাত প্রচার চালাচ্ছে যে, খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের ‘বিচার’ বন্ধ করতে আন্দোলন চালাচ্ছেন।

গণভীতিতে বুদ্ধি বিভ্রম
বাংলাদেশের মানুষ বুঝে গেছে, তারা দেখছে এক দৃশ্য, কিন' আওয়ামী লীগ তাদের বোঝাতে চাইছে অন্য কিছু। এত দিন যারা দ্বিধাসঙ্কটে ভুগছিল, স্বাধীনতা আন্দোলনের দল হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতি যাদের কিছু সহানুভূতি অবশিষ্ট ছিল, তাদেরও এখন মোহভঙ্গ হয়েছে। তারা বুঝে গেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ তাদের সাপের পাঁচ পা দেখাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতারা জানতেন- অবাধে খালেদার ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ আন্দোলন চলতে দিলে কোটি মানুষ দেশের দূরদূরান্ত থেকে ঢাকায় আসত নেত্রীর মুখ থেকে কিছু আশার কথা শুনতে। জনতাকে এরা আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বমুখী চরম ব্যর্থতার কথা, এ সরকারের ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনার কথা, বাংলাদেশকে আরেকটি সিকিম করার বিনিময়ে হাসিনার গদি চিরস'ায়ী করার কথা শুনতে দিতে চায়নি। জনতার প্রতি ভয় এখন আওয়ামী লীগ নেতাদের বুকে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১২ মার্চের ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ আন্দোলন ব্যর্থ করে দেয়ার উন্মাদ সিদ্ধান্ত সে জন্যই তারা নিয়েছিল।
বাংলাদেশের মানুষের নাগরিক অধিকার, তাদের মানবিক অধিকারকে যে আওয়ামী লীগ কানাকড়ি মূল্য দেয় না, ১২ মার্চ সেটা প্রমাণিত হয়েছে। কিন' সে জন্য তাদের কী মূল্য দিতে হবে, তারা ভেবে দেখেনি। নইলে এই চোরাবালিতে তারা পা দিতো না।
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। কোনো না কোনোভাবে প্রত্যেকটি নাগরিকের নাড়ি রাজধানীর সাথে গ্রথিত। কাজকর্মে লোকে রাজধানীতে থাকে। তারা এবং তাদের পরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে গ্রামের বাড়িতে যায়। কিন' আবার ঢাকায় ফিরে আসতে হয়। গ্রামীণ স্বাস'্যব্যবস'া নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতি করছে। হাজারে হাজারে দলীয় কর্মী ও ক্যাডারকে তারা স্বাস'্য বিভাগে চাকরি দিয়েছে, কী স্বাস'্যব্যবস'া তারা দেবে? অতএব, অসুখ হলেই ঢাকায় নিতে হয় রোগীকে। সব ধরনের ব্যবসায়-বাণিজ্যের, এমনকি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও নেতাদের ঘুষ দিতেও যেতে হয় ঢাকায়। প্রবাসী কর্মীদের কর্মস'লে ফিরে যাওয়ার বিমানও ছাড়ে ঢাকা থেকে।
শনি থেকে সোমবার- এই তিন দিন কোনো বাস, লঞ্চ এমনকি প্রাইভেট গাড়িও ঢাকায় আসতে দেয়া হয়নি। প্রবাসী কর্মীদের কতজন যথাসময়ে কাজে যেতে পারেননি বলে চাকরি খুইয়েছেন? চিকিৎসায় বিলম্ব হয়েছিল বলে কতজন হতভাগা প্রাণ হারিয়েছেন? তিন দিন অচল থাকা বাস, ট্রাক, লঞ্চগুলোর মালিকদের কত টাকা লোকসান হয়েছে? কত লোকসান দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা? কত মানুষ প্রতিদিন জেলাগুলো থেকে ঢাকায় আসেন?- তিন লাখ? পাঁচ লাখ? এক কোটি? নিজ দেশে অবাধে বিচরণ তাদের মানবিক অধিকার। সে অধিকারে হস্তক্ষেপ করে সরকার গুরুতর অপরাধ করেছে। ওপরে বর্ণিত তালিকার মানুষগুলোর আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের ওপর ক্রুদ্ধ না হওয়ার কোনো কারণ আছে?

সরকার বিএনপির হরতাল সফল করে দিয়েছে
অবরুদ্ধ রাজধানীর অবরুদ্ধ মানুষের ভোগান্তিও কম হয়নি। গণপরিবহন চলেনি ঢাকায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও তারা কাজকর্মে যেতে পারেননি। পায়ে হেঁটে যারা গিয়েছিলেন কষ্ট করে পায়ে হেঁটেই তাদের ফিরতে হয়েছে। দোকানপাট বন্ধ ছিল। পরিবহন ব্যবসায়-বাণিজ্যের পূর্বশর্ত। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশে পরিবহন বন্ধ ছিল বলে কত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের? রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ ছিল। এ সরকার শিক্ষাকে কেমন গুরুত্ব দেয় এই হচ্ছে তার নমুনা। ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন বন্ধ রেখে, রাজধানীকে দুই টুকরো করে আওয়ামী লীগ সরকার নাগরিকদের সবাইকে ক্রুদ্ধ, অপমানিত করেছে। তার ওপর সোমবার যে অভিজ্ঞতা সাধারণ নাগরিকদের হয়েছে তার তিক্ত স্বাদ দীর্ঘকাল তাদের মুখে লেগে থাকবে, আওয়ামী লীগের কথা মনে করে তারা থুথু ফেলবেন।
ঢাকাকে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করার উদ্দেশ্যে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ১৯ দফা নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সরকারের জ্ঞাত বিরোধীদের গ্রেফতার, যানবাহন তল্লাশি আর বিরোধী দলের সমর্থকদের যানবাহন হুকুমদখল (রিকুইজিশন) করার নির্দেশ সেই ১৯ দফার মধ্যে পড়ে। রাজধানীতেও সে দিন জনসমাবেশ বন্ধ করার জন্য পুলিশকে বহু নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সমাবেশের আগের সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ সমাবেশের অনুমতি দিতে বিলম্ব করেছে, রোববারের রাত বেশ খানিকটা বেড়ে যাওয়ার আগে মঞ্চ তৈরি করতে দেয়া হয়নি, কতগুলো মাইক্রোফোন ব্যবহার করা যাবে তার সংখ্যা বেঁধে দেয়া হয়েছিল, এমনকি সমাবেশের লোক কোথায় দাঁড়াতে পারবে তারও একটা সীমারেখা বেঁধে দেয়া হয়েছিল।
‘অমৃত সায়রে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল’। আওয়ামী লীগের হয়েছে সে অবস'া। যতগুলো উদ্দেশ্যে তারা বিএনপির সমাবেশ বানচাল করতে চেয়েছিল তার প্রত্যেকটিরই হয়েছে উল্টো ফল। প্রকৃত প্রস্তাবে মাইক্রোফোনের অসুবিধা সত্ত্বেও খালেদা জিয়ার সমাবেশ আশাতিরিক্ত সফল হয়েছে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকেরা আমাকে বলেছেন, প্রায় তিন লাখ লোক সমাবেশে এসেছিলেন, সভা শুরু হওয়ার অনেক আগেই পুলিশের নির্দিষ্ট সীমানা ছাড়িয়ে বহু দূরে ছড়িয়ে পড়েছিল সমাবেশ।
খালেদা জিয়ার চারটি রোডমার্চ, বহু পথসভা ও জনসভা এবং আরো পরে বিভিন্ন জেলায় তার জনসমাবেশে কোথাও অশান্তি হয়নি। সোমবারও বিএনপি ও বিরোধী ১৬ দলের জোটের জোট থেকে কোথাও অশান্তি ঘটেনি। কিছু অশান্তি ঘটিয়েছিল ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ক্যাডারেরা। তারা সমাবেশমুখী ছোটখাটো দলের ওপর হামলা করেছে। শেখ হাসিনার এই বরপুত্রদেরই আবার সরকার পুলিশের ভূমিকায় ব্যবহার করেছে। তারা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে লোকজনকে যানবাহন থেকে নামিয়ে এনেছে, তাদের দেহতল্লাশি করেছে।

বাক ও সংবাদের স্বাধীনতা হত্যা
লাখ পাউন্ড ব্যয়ে বিদেশে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে হাসিনা সরকার দাবি করেছে, বাংলাদেশে বাক ও সংবাদের স্বাধীনতা আদর্শস'ানীয়। কিন' এতকাল বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে অন্য ছবি। বিরোধী দলকে তারা সভা-সমিতি করতে দিতে নারাজ। সাংবাদিকদের ওপর বহু নির্যাতন হয়েছে। প্রায় এক ডজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন বর্তমান সরকারের আমলে। খুনিরা অবশ্যই শাসক দলের কাছের মানুষ। নইলে এরা অবশ্যই ধরা পড়ত। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং রুনি-সাগর দম্পতির হত্যা তদন্তের ভার নিয়েছেন, সে কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
অন্য হাজারো ব্যর্থতার মতো এখানেও প্রধানমন্ত্রী চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। খুনিরা ধরা পড়েনি। শোনা যাচ্ছে, দুই খুনিকে নিরাপদে আমেরিকায় চলে যেতে দেয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সমাবেশের সরাসরি লাইভ সম্প্রচারের মধ্যেই একুশে টেলিভিশন, বাংলাভিশন ও ইসলামী টেলিভিশন চ্যানেল তিনটির সংযোগ কেটে দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের স্বল্পবুদ্ধি নেতারা হয়তো নিজেদের ‘সাফল্যে’ বগল বাজাচ্ছেন। কিন' তারা ভুলে গেছেন যে, এই তিনটি চ্যানেলের লাখ লাখ দর্শক শা...বা... বলে সরকারকে গালি দিচ্ছেন, মনে মনে আওয়ামী লীগ নেতাদের মুণ্ডু চিবোচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষক দেশ ভারত ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি প্রীত হওয়ার মতো নয়। সোমবারের সমাবেশ সম্বন্ধে বিদেশী মিডিয়ার বিবরণ সে ভাবমূর্তিতে আরো কয়েক পোঁচ কালি লেপে দিয়েছে। লজ্জা-শরম বলে যদি কোনো কিছু এ সরকারের থেকে থাকে, তাহলে তাদের উচিত লম্বকর্ণ বিশিষ্ট একটি চতুষ্পদ জীবের মতো চিৎকার না করে সুস' মস্তিষ্কে বিএনপির ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে নিজেদের ভূমিকা খতিয়ে দেখা। খালেদা জিয়া ২৯ মার্চ হরতাল ডেকেছেন, তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার ঘোষণা না দিলে ১১ জুন আবার ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ অবিলম্বে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনে নিলে নিজেদেরও অনেক কল্যাণ করবে।
(লন্ডন, ১৩.০৩.১২)
serajurrahman@btinternet.com

বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১২

বন্ধু’ ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত

‘বন্ধু’ ভারতের পানি আগ্রাসনের ইতিবৃত্ত

মাহমুদুর রহমান
প্রথম পর্ব
গত সপ্তাহে সপরিবারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের মুসলিম ঐতিহ্যের বেশ কয়েকটি নিদর্শন রয়েছে। প্রায় পাঁচশ’ বছরের পুরনো ছোট সোনা মসজিদ, হযরত শাহ নেয়ামতউল্লাহ (র.)-এর মাজার এবং মাজার সংলগ্ন মসজিদ দেখতে দেখতে অতীতের বাংলাদেশের কথা কল্পনায় আনতে চেষ্টা করছিলাম। শাহ নেয়ামতউল্লাহর মতো ধর্ম প্রচারকরা এত দূরদেশে কেমন করে এসেছিলেন, কীভাবেই-বা এমন অপরিচিত, অজানা পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়ে ইসলাম প্রচার করে গেছেন, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। যাই হোক, এসব ঐতিহাসিক স্থান দেখা ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদী নিয়ে আমার প্রবল কৌতূহল ছিল। স্কুলজীবনে ভূগোলের বইতে পড়েছিলাম মহানন্দা দার্জিলিং পাহাড় থেকে উত্পত্তি লাভ করে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রাজশাহীর গোদাগাড়িতে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে শেষ হয়েছে মহানন্দার জলপ্রবাহের দীর্ঘ যাত্রা।
আমাদের গাড়ি মহানন্দা সেতুর ওপরে উঠতেই বড় হতাশ হলাম। নদীতে সামান্যই পানি রয়েছে। দেখলাম অনেক মানুষ গোসল করছে। তারা প্রায় মাঝ নদীতে দাঁড়িয়ে গোসল করলেও পানি কোমর পর্যন্তও পৌঁছায়নি। মনে হলো, হেঁটেই মহানন্দা পার হওয়া সম্ভব। কিছুদিন আগে সিরাজগঞ্জে করতোয়া নদী দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিনও একই রকম বিষণ্ন বোধ করেছিলাম। উজানেভারত কর্তৃক অব্যাহত পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের একসময়কার প্রমত্তা প্রতিটি নদীই এখন পূর্বের ছায়ামাত্র। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইনে ভাটির দেশকে পানির ওপর যে অধিকার দেয়া হয়েছে, তার কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না সাম্রাজ্যবাদী ভারতের উন্মত্ত শাসকশ্রেণী। উপরন্তু, সে দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বাংলাদেশকে অধিকারবঞ্চিত করে বিশাল জনগোষ্ঠীর এই দেশটিকে মরুভূমিতে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে। এই প্রসঙ্গের আলোচনা আপাতত দ্বিতীয় পর্বের জন্য তুলে রাখছি।
৫৮টি নদী পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে প্রবেশ করে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ওপর দিয়ে এতগুলো আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত হয়নি। এই নদীগুলোর মধ্যে ৫৪টি এসেছে ভারত থেকে। অবশ্য এই ৫৪টি নদীর সবগুলোই ভারত থেকে জন্মলাভ করেনি। যেমন গঙ্গা নদীর উত্পত্তিস্থল ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্য হলেও ব্রহ্মপুত্র নদের জন্ম হয়েছে চীন দেশের তিব্বত অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমে। তিব্বতের সাংপো (Tsangpo), চীনের ইয়ারলাং জাংবো (Yarlang Zangbo), অরুণাচলের দিহাং (Dihang), আসামের ব্রহ্মপুত্র (Brahmaputra) বাংলাদেশে এসে নাম নিয়েছে যমুনা (Jamuna) নদী। সমস্যা হলো—
নদীগুলোর জন্ম
যে দেশেই হোক না কেন, ৫৮টি আন্তর্জাতিক নদীর ৪টি ব্যতীত সবগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ভারত হয়েই। এই ভৌগোলিক কারণেই ভারতের পক্ষে বাংলাদেশকে তার পানি আগ্রাসনের অসহায় শিকারে পরিণত করাটা সহজ হয়েছে। এ দেশের সাধারণ জনগণ ভারত কর্তৃক উজানে মাত্র চারটি নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে অবগত আছে। এর মধ্যে গঙ্গা, তিস্তা এবং সম্প্রতি সারি নদীতে বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। বরাক নদীর টিপাইমুখে ভারত কর্তৃক বাঁধ নির্মাণ নিয়েও গত তিন বছরে অনেক বিতর্ক হয়েছে।
কিন্তু, নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ। ভারত প্রকৃতপক্ষে কয়েক ডজন নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে চলেছে। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের তত্কালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জাতীয় সংসদে আ ন ম ইউসুফের এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছিলেন, “India hampered the natural flow of 22 rivers and tributaries flowing from India to Bangladesh by constructing groynes and embankments. (Ref. India-Bangladesh Relations, Documents 1971-2002, Volume-II Edited by Avtar Singh Bhasin, Page 997) (ভারত ২২টি নদী ও উপনদীর ওপর গ্রয়েন ও বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে।)
১৯৮৭ সালে যেসব নদী, ছড়া এবং অন্যান্য জলপ্রবাহ থেকে ভারতের পানি প্রত্যাহারের তথ্য বাংলাদেশ সরকারের জানা ছিল, সেগুলো হলো—গঙ্গা, তিস্তা, মহানন্দা, করতোয়া, গোমতি, খোয়াই, মনু, কোদালিয়া, বাসালি ছড়া, ফুলছড়ি, আন্ধারমানিক ছড়া, ছাগলনাইয়া ছড়া, মহামায়ার ছড়া, গয়রা ছড়া, গজারিয়া ছড়া, কচুয়া ছড়া, মাবেসনদী ছড়া, মাতাই ছড়া, উজিরপুর ছড়া, চন্দনা ছড়া, রাজেশপুর-তেতুয়া ছড়া, কমলা ছড়া এবং ভৈরব-সাংলি নদী। ধারণা করতে অসুবিধা নেই, ১৯৮৭ সালের পর থেকে গত ২৫ বছরে আগের ২২টির অতিরিক্ত আরও অসংখ্য আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ থেকে ভারত বাংলাদেশকে অবহিত না করেই একতরফা পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রেখেছে।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত একমাত্র গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন নিয়েই ভারত চুক্তি করেছে। সেটাও সম্ভব হয়েছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অগাধ দেশপ্রেম এবং প্রচণ্ড মানসিক দৃঢ়তার কারণে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের তত্কালীন একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান কোনোরকম চুক্তি ছাড়াই ভারতকে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার অনুমতি দিয়ে দেশের যে সর্বনাশ সাধন করেছিলেন, তার থেকে নিষ্কৃতি পেতে জিয়াউর রহমান ভারতের পানি আগ্রাসনের বিষয়টিকে ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপন করে বাংলাদেশের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি নবীন, দুর্বল রাষ্ট্রটির মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছিলেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তার শত্রু-মিত্ররা বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করে থাকে। আমি বিশ্বাস করি, তিনটি কারণে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন উচ্চতায় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবেন যে আদালতকে ব্যবহার করেও ক্ষমতাসীনরা তার সেই অবস্থান কোনোদিন কেড়ে নিতে সক্ষম হবে না। প্রথমত তিনি কেবল স্বাধীনতা ঘোষণাই করেননি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের সঙ্গে দেশপ্রেমিক সৈনিকদের যে ঐক্য রচিত হয়েছিল, সেটা বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে মহিমান্বিত করেছিল। সর্বশেষ, সম্প্রসারণবাদী প্রতিবেশী ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকশ্রেণীকে চরমভাবে ক্ষুব্ধ করার ঝুঁকি নিয়েও জাতিসংঘে গঙ্গার পানির ওপর আমাদের ন্যায্য অধিকারের দাবি উত্থাপন। হয়তো সে কারণেই ১৯৮১ সালে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তবে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
গঙ্গার পানি সংক্রান্ত বিরোধ জাতিসংঘে পৌঁছে যাওয়ার প্রেক্ষাপটেই ভারত ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে পাঁচ বছরমেয়াদি একটি চুক্তি করতে বাধ্য হয়। সেই চুক্তির ২ এবং ৩ নং ধারায় শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার ন্যূনতম পানি প্রবাহের ৮০ শতাংশ প্রাপ্তির বিষয়ে বাংলাদেশকে Guarantee দেয়া হয়। জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার চুক্তির মেয়াদান্তে ১৯৮২ সালের অক্টোবরে উপরোক্ত Guarantee clause বাদ দিয়ে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে ভারত সরকারের সঙ্গে একটি ১৮ মাস মেয়াদি সমঝোতা স্মারক (MOU) স্বাক্ষর করে, যার মেয়াদ ১৯৮৪ সালের ৩০ মে শেষ হয়। এরপর দীর্ঘ সময় ভারত আর গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন না করে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলকে দ্রুত মরুকরণের দিকে ঠেলে দেয়। এ অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বক্তৃতায় আবারও ভারতের পানি আগ্রাসনের বিষয়টি উত্থাপন করতে বাধ্য হন। সেই বক্তৃতায় তিনি বলেন, “The pledges given by India when the Farakka Barrage was commissioned remain unfulfilled. This unilateral withdrawal of water in complete disregard of the interests of the people of Bangladesh, has brought more than 40 million people in the Ganges basin-or, rather, the Padma basin-face to face with catastrophe, with disaster. ...
While the whole world is voicing concern about protection of the environment, a large proportion of Bangladesh’s population is being pushed to the threshold of poverty and destruction. This is nothing but a gross violation of human rights and justice. To put it simply, our economic structure is faced with disaster because of the Farakka Barrage.” (ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সময় ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অদ্যাবধি অপূর্ণ রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে এই একতরফা পানি প্রত্যাহার গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার ৪ কোটিরও অধিক জনগোষ্ঠীকে সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।...
সমগ্র বিশ্ব যখন পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছে, সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণের এক বৃহত্ অংশকে দারিদ্র্য এবং ধ্বংসের দোরগোড়ায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। এটি মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের চরম লঙ্ঘন। সরলভাবে বললে ফারাক্কা বাঁধের কারণে আমাদের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো চরম দুর্দশায় পতিত হয়েছে।)
বাংলাদেশের মাত্র দু’জন নেতাই ফারাক্কা বাঁধের মতো এদেশের মানুষের জীবন-মরণের ইস্যুটি দেশপ্রেম ও সাহসিকতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্থাপন করতে পেরেছেন। কাকতালীয়ভাবে তারা স্বামী এবং স্ত্রী।
শেষ পর্যন্ত ভারত সরকারের পছন্দের নেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকার গঠন করলে বাংলাদেশের স্বার্থ অনেকাংশে বিসর্জন দিয়ে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছরমেয়াদি গঙ্গা চুক্তি সম্পাদন করা হয়। কিন্তু, ততদিনে বাংলাদেশের জীবন ও জীবিকার কী পরিমাণ ক্ষতিসাধন হয়েছে, সেটি বুঝবার জন্য আজকের ক্ষীণকায়া পদ্মা এবং তার পানিশূন্য শাখা নদীগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলেই চলবে।
এবার তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় কপটতার অভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করা যাক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অব্যবহিত পর তত্কালীন ওয়াপদার (Water and Power Development Authority) চেয়ারম্যান বিএম আব্বাস এ টি নয়াদিল্লিতে ভারতের সেচ ও বিদ্যুত্মন্ত্রী ড. কে এল রাও (উত্. ক. খ. জধড়)’র সঙ্গে আলোচনা শেষে ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি যে যৌথ প্রেসব্রিফিং করেছিলেন সেখানেও তিস্তা প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছিল। উভয় পক্ষ থেকে সেদিন বলা হয়েছিল—’’There could be a joint India-Bangladesh study on silting particularly in the Teesta and other North Bengal river systems. (তিস্তা এবং উত্তরবঙ্গের অন্যান্য নদীসমূহের চর জেগে ওঠা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ সমীক্ষা হতে পারে।)
অর্থাত্ তিস্তার পানি প্রবাহ আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাওয়ায় তখনই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাদের উদ্বেগের বিষয়টি ভারতকে অবহিত করা হয়েছিল। ‘বন্ধু’রাষ্ট্র ভারত বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পানি সঙ্কট সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকা সত্ত্বেও তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণের কাজ বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই অব্যাহত রাখে। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় মন্ত্রী পর্যায়ের যৌথ নদী কমিশনের (Joint River Commission) সভায় প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, গজলডোবা পয়েন্টে প্রাপ্ত পানির ২৫ শতাংশ তিস্তা নদীর বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা হিসেবে অব্যবহৃত রেখে ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ ভারতের প্রাপ্য হবে। সেই সভায় যৌথ নদী কমিশনকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে যথাযথ চুক্তি প্রণয়নের নির্দেশ দেয়া হয়। বলাই বাহুল্য, সেই ৯০ দিন আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি! ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার পানি সমস্যা সমাধানকল্পে Joint Committee of Experts (JCE) গঠিত হয়। নবগঠিত কমিটিকে তিস্তা ছাড়াও মনু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতি, ধরলা এবং দুধকুমার মোট সাতটি নদীর পানি বণ্টন প্রস্তাব দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ভারতের অনাগ্রহে এই কমিটি সময়ক্ষেপণ ব্যতীত আর কিছু যে অর্জন করতে পারেনি, সেটি ২০০০ সালের জানুয়ারির ১২ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের ৩৪তম সভায় প্রদত্ত বাংলাদেশের তত্কালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্যের মাধ্যমেই উঠে এসেছে। তিনি সেদিন বলেছিলেন, During it’s Thirty-second meeting held in July, 1997 the Commission had set up a Joint Committee of Experts (JCE) to work out arrangements for long term sharing of the waters of common rivers between the two countries, according priority to the Teesta. The JCE in its first meeting held in August, 1997 had agreed to take up seven rivers namely the Teesta, Manu, Khowai, Gumti, Muhuri, Dharla and Dudhkumar to work out sharing arrangement in the first phase, according priority to the Teesta as mandated. Thereafter, The JCE, I am informed, had held only two meetings during the years 1999 and 2000. More than three years have elapsed since the JCE was constituted, but it is yet to submit any proposal to the Commission for sharing the flows of the Teesta, let alone other rivers.’’ (১৯৯৭ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত বত্রিশতম বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের কমিটি (JCE) গঠন করে কমিটিকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অভিন্ন নদীগুলির মধ্যে তিস্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সকল নদীর পানিবণ্টনের দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তাব প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। একই বছরের আগস্টে JCE তাদের প্রথম বৈঠকে তিস্তার অগ্রাধিকারসহ মনু, খোয়াই, গোমতি, মুহুরি, ধরলা এং দুধকুমার নদীর পানিসমস্যা প্রথম পর্যায়ে সমাধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই সময় থেকে গত তিন বছরে JCE’র আর মাত্র দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। JCE গঠনের তিন বছরেরও অধিক সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অন্যান্য নদী তো দূরের কথা তিস্তার পানিবণ্টনের কোনো প্রস্তাব পর্যন্ত কমিশনের কাছে উত্থাপন করা হয়নি।)
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একসময় অন্যতম ভারতবান্ধব রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত মরহুম আবদুর রাজ্জাকের বক্তব্যে হতাশার সুরটি এখানে যথেষ্টই স্পষ্ট। সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, “The flow of Teesta has drastically declined from normal 7000 cusec to less than 600 cusec in the first ten days of January this year. অর্থাত্ জানুয়ারির প্রথম দশ দিনের তিস্তার প্রবাহ স্বাভাবিক ৭০০০ কিউসেক থেকে অবিশ্বাস্যভাবে হ্রাস পেয়ে ৬০০ কিউসেকেরও নিচে নেমে গেছে। যৌথ নদী কমিশনের এই সভার কদিন পরই অনুষ্ঠিত JCE’র সভায় তিস্তার পানিবণ্টনের একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির খসড়া বাংলাদেশ উত্থাপন করলেও ভারতীয় পক্ষ এ নিয়ে কোনো আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানায়। বাংলাদেশের সেই প্রস্তাবে গজলডোবা পয়েন্টে ৩০ শতাংশ পানি নদীর জীবনধারণের জন্য রেখে দিয়ে বাকিটা দুই বন্ধুরাষ্ট্রের মধ্যে সমানভাবে ভাগাভাগির প্রস্তাব দেয়া হয়। তিস্তা থেকে ভারতের সেই একতরফা পানি প্রত্যাহার আজও শেষ হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, বাংলাদেশের বর্তমান ভারতপন্থী সরকারের ততোধিক ভারতপন্থী উপদেষ্টাদ্বয় ড. গওহর রিজভী এবং ড. মশিউর রহমান দেশবাসীকে আশার বন্যায় ভাসিয়ে দিলেও উত্তরের তিস্তা পানিশূন্যই থেকেছে। এরপরও আমাদের মেনে নিতে হবে ভারত নাকি বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র! তিস্তা প্রসঙ্গে একটা উড়ো গল্প বলে সাম্রাজ্যবাদী ভারতের পানি আগ্রাসনের প্রথম পর্ব লেখা শেষ করব।
ক’দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি দেশের প্রধান জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক এবং আওয়ামীপন্থী কলামিস্টদের এক নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে আমারও সেখানে দাওয়াত থাকলেও আওয়ামী মিলনমেলার সুর কেটে যাবে ভেবে আমি অনুপস্থিত ছিলাম। আমি গেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে সরকারি পয়সায় সরবরাহকৃত নানারকম সুখাদ্যের স্বাদ অনেকের কাছেই তেতো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। যাই হোক, সেই নৈশভোজে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট সুশীল(?) কলামিস্ট নাকি অনুচ্চ কণ্ঠে তিস্তা চুক্তি প্রণয়নে ব্যর্থতার বিষয়ে দীপু মনির কাছে অনুযোগ করছিলেন। সেই সন্ধ্যায় যথেষ্ট ব্যাকুলতার সঙ্গেই তিনি বলেছেন, তিস্তার সমাধান না হলে তাদের পক্ষে সরকারের দালালী চালিয়ে যাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। ভারতের সঙ্গে অন্তত কোনোরকম চুক্তি একটা না হলে দালালী অব্যাহত রাখাটা তাদের জন্য বিপজ্জনক। ভারতের অব্যাহত প্রতারণায় এ দেশের জনগণ ক্রমেই খেপে উঠতে শুরু করেছে। সুতরাং, পানি আসুক আর না আসুক, নিদেনপক্ষে চুক্তি একটা হলেই সেই চিহ্নিত ভারত বন্ধুরা সদলবলে নাকি দেশপ্রেমিক জনতার ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারতেন। দেখা যাক, বাংলাদেশের জনগণ এই ভারতীয় রাজাকারদের লেখালেখিতে কতদিন আস্থাশীল থাকে।
(দ্বিতীয় পর্ব আগামী বুধবার)
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com
সূত্র: আমারদেশ, 14/03/2012